তবু তিনি জীবন্ত

ম্যারাডোনা নেই, শোনার পর তাঁর ম্যুরালে মাথা ঠুকে কাঁদছেন আর্জেন্টাইন কিংবদন্তির ভক্ত। ২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর, বুয়েনস এইরেসে
রয়টার্স ফাইল ছবি

সম্ভবত ১১ জুলাই দিনটাতে তাঁকে মনে মনে সবচেয়ে বেশি খুঁজেছেন আর্জেন্টাইনরা। কী উদ্‌যাপনই না সেদিন করতেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা!

চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলকে তাদেরই মাটিতে হারিয়ে কোপা আমেরিকা জিতেছেন সেদিন লিওনেল মেসিরা, ঘুচিয়েছেন একটা আন্তর্জাতিক শিরোপার জন্য আর্জেন্টিনার ২৮ বছরের দুঃসহ অপেক্ষা। করোনার কারণে স্টেডিয়ামে যাওয়া তো সম্ভব হতো না, ঘরে বসেই হয়তো সেদিন ম্যারাডোনা পাগলাটে কিছু করে ফেলতেন।

কিংবা ১১ সেপ্টেম্বর? নিজেদের মাঠ স্তাদিও মনুমেন্তালে সেদিন বলিভিয়ার বিপক্ষে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে মেসির হ্যাটট্রিকে ৩-০ গোলে জিতল আর্জেন্টিনা, ম্যাচ শেষে কোপা আমেরিকার শিরোপা নিয়ে উদ্‌যাপন হলো আর্জেন্টাইনদের সঙ্গে। করোনাকালে সেদিনই প্রথম আর্জেন্টিনার কোনো স্টেডিয়ামে দর্শক এসেছিল। নিশ্চিত, সেদিন ম্যারাডোনার স্টেডিয়ামে যাওয়া কেউ ঠেকাতে পারত না। কে জানে, হয়তো মাঠে নেমে মেসিদের সঙ্গেই নাচানাচি করতেন। হয়তো স্নেহের চুমু এঁকে দিতেন মেসির কপালে। হয়তো...।

কল্পনার বানে বাধা নিষ্ঠুর বাস্তবতা। মনে করিয়ে দেয়, ‘হয়তো’গুলো শুধুই তাঁকে খুঁজে ফেরা মনের অবাস্তব কল্পনা। ছিয়াশি বিশ্বকাপজয়ী আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি নিজেই যে কল্পলোকে বাস করছেন আজ এক বছর হলো! গত বছর এই ২৫ নভেম্বরের সন্ধ্যায়ই এসেছিল দুঃসংবাদ হয়ে আসা বজ্রপাত নিয়ে—ম্যারাডোনা নেই!

শুধু আর্জেন্টিনা নয়, শুধু ফুটবল নয়; তাঁর মৃত্যুতে দীর্ঘশ্বাসে বাতাস ভারী হলো বিশ্বের প্রতিটি কোণে। ম্যারাডোনা যে ফুটবল ছাপিয়েও সর্বজনীন, আর্জেন্টিনা ছাড়িয়ে সবার। সেই দুঃস্বপ্ন দিনের পর তাঁর স্মৃতি ভাসল মুখে মুখে, তাঁর বিতর্ক-ভালোবাসায় হাত ধরাধরি করে চলা ৬০ বছরের জীবনের টুকরো টুকরো ছবি ভাসল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। আর্জেন্টিনা তিন দিনের জাতীয় শোক পালন করল, আর্জেন্টাইনদের মন শোকে ছেয়ে থাকল আরও অনেক দিন। হ্যাঁ, জীবনের নিয়মে এরপর নৈমিত্তিকে ফিরেছেন আর্জেন্টাইনরা, ফুটবলে আবার প্রাণ ফিরেছে। এর মধ্যে আজ আরেকটি ২৫ নভেম্বর এসে মনে করিয়ে দিল—ম্যারাডোনার না থাকার ৩৬৫ দিন হয়ে গেল!

ম্যারাডোনার স্মরণে রোববার তাঁর ছবি আঁকা জার্সি পরেই ইতালিয়ান লিগে ইন্টার মিলানের বিপক্ষে ম্যাচে নামে নাপোলি
ছবি: নাপোলির টুইটার

ম্যারাডোনার প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা শিশুতোষ ভাবভঙ্গি হয়তো আর দেখা যায় না, তাঁকে ঘিরে থাকা বিতর্কে তাঁর জবাব আর মেলে না। হাসপাতাল-বাড়ি করতে থাকা ব্রাজিল কিংবদন্তি পেলেকে হাসপাতালে যাওয়ার পর সাহস জোগানো আর হাসপাতাল থেকে ফেরার পর আবার খোঁচানো কথা ম্যারাডোনার দিক থেকে আর শোনা যায় না। বার্সেলোনা ছেড়ে গত আগস্টে তাঁর স্নেহের মেসি যে পিএসজিতে চলে গেলেন, সে ব্যাপারে ম্যারাডোনার বিশ্লেষণের চেয়েও আবেগে ভারী বক্তব্য আর পাওয়া গেল না। তবু ম্যারাডোনা নেই, কে বলবে?

আর কোথাও থাকুন-না থাকুন, বিতর্কে তো ৬০ বছরের জীবনের মতো মৃত্যুর পরের বছরেও তাঁর জলজ্যান্ত উপস্থিতি! তাঁর মৃত্যু ঘিরেই তো বিতর্কের শেষ নেই। মৃত্যু নাকি চিকিৎসকদের অবহেলায় হত্যা, সে নিয়ে বিতর্ক এখনো চলছে। তাঁর মেয়েরা অভিযোগ করেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পেছনে চিকিৎসকদের অবহেলা ছিল। কদিন পর খবর আসে, চিকিৎসকদের অবহেলার কারণেই শেষ সাত–আট ঘণ্টা অনেক কষ্ট পেয়েছেন ম্যারাডোনা। শেষ পর্যন্ত তদন্ত শেষে ম্যারাডোনার চিকিৎসকসহ সাতজনের বিরুদ্ধে মামলাই হলো। আর্জেন্টিনার চিকিৎসক নেলসন কাস্ত্রো দুদিন আগে দাবি করলেন, হৃৎপিণ্ড ছাড়াই নাকি সমাহিত করা হয়েছে ম্যারাডোনাকে।

এ তো গেল বিতর্ক। মুদ্রার উল্টো পিঠে ভালোবাসার বানে কি কোথাও কমতি আছে? মৃত্যুর চার দিন পর তাঁর প্রিয় মেসি বার্সেলোনার জার্সিতে গোল করে তাঁকে স্মরণ করেছিলেন বিশেষভাবে। বার্সার জার্সি উঁচিয়ে দেখিয়েছিলেন ভেতরে থাকা নিওয়েলসের ‘১০’ নম্বর জার্সি—যে জার্সি পরে ম্যারাডোনা খেলেছিলেন! তাঁর পুরোনো দুই ক্লাব বোকা জুনিয়র্স ও নাপোলির স্টেডিয়ামের নাম বদলে হয়েছে ‘ডিয়েগো ম্যারাডোনা’ স্টেডিয়াম। তাঁর স্মরণে আর্জেন্টিনার রোজারিওতে একটা গির্জা তো তাঁর জীবদ্দশায়ই হয়েছিল, গত জুলাইয়ে মেক্সিকোতে আরেকটি গির্জা হয়েছে ম্যারাডোনার নামে!

এক বছর কেন, পাগলামিতে ঠাসা এ ভালোবাসা হয়তো অনন্তকালেও ফুরাবে না। ম্যারাডোনা নামের সম্মোহনই যে এমন!