তাঁদের বিদায় জানাবে ইউরো
যখন পড়বে না আর পায়ের চিহ্ন ইউরোতে!
লুকা মদরিচ, রবার্ট লেভানডফস্কির বুঝিবা একটু মন খারাপ। এ বেলাতেও তাঁদের ওপর আলোটা এল না! আলোচনা যত ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর শেষ ইউরো নিয়ে। হওয়ারই কথা। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো বলে কথা! ইউরোর তারার জগতের সন্ধ্যাতারা। কিন্তু পর্তুগিজ যুবরাজের বাইরেও কত তারকাকে এবার শেষবারের মতো দেখতে যাচ্ছে ইউরো!
শুধু মদরিচ বা লেভানডফস্কিই কেন, একজন লেফটব্যাকের খোঁজ পাওয়া গেলে শেষবার ইউরো খেলতে যাওয়াদের নিয়ে চোখধাঁধানো একটা দলই বানিয়ে ফেলা যেত। হিসাব করেই দেখুন না!
গোলপোস্টে আপনি বেছে নিতে পারছেন মানুয়েল নয়্যার কিংবা উগো লরিসের একজনকে। রাইটব্যাক রাখলেন সেজার আসপিলিকেতাকে। সেন্ট্রাল ডিফেন্সে বিকল্পের অভাব নেই। পেপে, জর্জো কিয়েলিনি, লিওনার্দো বোনুচ্চি, একটু আগবাড়িয়ে ধরলে ম্যাটস হুমলস...কত সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার লাগবে তা-ই বলুন!
সামনে মাঝমাঠে কাকে খেলাবেন? মদরিচ তো আছেনই, তাঁর পাশে সের্হিও বুসকেতস, টনি ক্রুস, জোয়াও মুতিনিও...কাকে রেখে কাকে নেবেন! মারেক হামসিককে না হয় বেঞ্চেই রাখলেন। সামনে আক্রমণভাগে রোনালদো, বেল, লেভানডফস্কিকে খেলানোর চিন্তা করছেন? ওদিক থেকে ভ্রু কুঁচকে তাকাতে পারেন করিম বেনজেমা। একটু মন খারাপ হতে পারে অলিভিয়ের জিরু কিংবা আর্তেম জিউবাদেরও।
এমন একটা ‘দল’ এবার ইউরোর শেষে আর খেলবে না! প্রতিটি ম্যাচ, প্রতিটি মিনিট, তাঁদের প্রতিটি দৌড়, বলে প্রতিটি স্পর্শ ইউরোকে বলবে, মন ভরে দেখে নাও। এ-ই শেষ।
মদরিচের ফুটবলে ৩৫ বছর বয়সের ধাক্কা এখনো বোঝা যায় না, সদ্য সমাপ্ত মৌসুমেও রিয়াল মাদ্রিদের মাঝমাঠে সৃষ্টিশীলতার প্রতিশব্দ হয়ে ছিলেন ক্রোয়েশিয়ান কিংবদন্তি। কিন্তু ক্রোয়েশিয়ার কোচ জ্লাতকো দালিচ যখন ২০২২ বিশ্বকাপের দল সাজাতে বসবেন, নিশ্চিত তাঁর দীর্ঘশ্বাস পড়বে মদরিচের বিকল্পের খোঁজে নেমে।
ক্রোয়েশিয়াকে ২০১৮ বিশ্বকাপের ফাইনালে তুলে বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হয়েছিলেন, মেসি-রোনালদোর ১০ বছরের ‘দ্বৈধাতিপত্যে’ অবসান টেনে হয়েছিলেন সে বছরের বর্ষসেরাও...মদরিচের বিকল্প খোঁজা কঠিনই নয়, অসম্ভবও। ২০১৮ বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়াকে তাদের ফুটবল ইতিহাসে সর্বোচ্চ সাফল্যের স্বাদ দেওয়া মদরিচ এবার ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড আর চেক প্রজাতন্ত্রের গ্রুপ পেরিয়ে ক্রোয়েশিয়াকে শেষ পর্যন্ত টেনে নিতে পারবেন?
ক্রোয়েশিয়ায় যা মদরিচ, পোল্যান্ডে রবার্ট লেভানডফস্কি হয়তো তার চেয়েও বেশি কিছু। ক্রোয়াটদের তো তবু রাকিতিচ-পেরিসিচের মতো তারকা ছিল, পোল্যান্ডের এক ‘লেভা’ ছাড়া আর আছেনই-বা কে!
বয়সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতিপক্ষ পোস্টের সামনে লেভার ফর্মে যেন আগ্নেয়গিরির লাভা, এই মৌসুমে তো জার্মান লিগে এক মৌসুমে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ডে জার্ড মুলারকে সরিয়ে গড়েছেন ৪১ গোলের নতুন রেকর্ড। গত মৌসুমে বায়ার্ন মিউনিখকে সর্বজয়ী করে বসেছেন এক যুগে মেসি-রোনালদোর বাইরে ফিফার বর্ষসেরা হওয়ার তালিকায় মদরিচের পাশে। স্পেন, স্লোভাকিয়া আর সুইডেনের গ্রুপ থেকে দ্বিতীয় পর্বে ওঠা হয়তো কঠিন হবে না, আরও কিছুদূর যেতে পোল্যান্ডের ৩২ বছরের লেভাকেই দরকার।
ফ্রান্সের হয়তো শুধু বেনজেমার দিকেই তাকাতে হবে না। ২০১৮ বিশ্বকাপ তো বেনজেমাকে ছাড়াই জিতল ফ্রান্স। তবে এমবাপ্পে-গ্রিজমান-পগবাদের সামনে আক্রমণে ‘ফোকাল পয়েন্ট’ হিসেবে এবার ইউরোর জন্য বেনজেমাকে যে সব বিতর্ক ভুলে ছয় বছর পর জাতীয় দলে ফিরিয়েছেন ফরাসি কোচ দিদিয়ের দেশম, তা-ই বলে, দেশমের ইউরো জয়ের স্বপ্নে ৩৩ বছরের বেনজেমা কেন্দ্রীয় চরিত্রে। ফেরানোর কারণও আছে। ফ্রান্স যে পড়েছে পর্তুগাল, জার্মানি আর হাঙ্গেরিকে নিয়ে গড়া মৃত্যুকূপে!
গ্যারেথ বেল আর টনি ক্রুসের বয়স অবশ্য এটিকে তাঁদের শেষ ইউরো মানতে দেয় না। কিন্তু ক্রুস নিজেই জানিয়ে দিয়েছেন, এই ইউরো শেষেই জার্মানির জার্সিকে জানিয়ে দেবেন বিদায়। বেলও শেষের আভাস দিয়ে রেখেছেন, একের পর এক চোট তাঁর ক্যারিয়ারের দীর্ঘস্থায়িত্বে প্রশ্নও এঁকে যায়। ৩১-এ এসেই ইউরোতে ‘শেষ নৃত্যে’ কেমন রাঙাবেন বেল-ক্রুস?
ক্রুসের মতো করে মানুয়েল নয়্যার কোনো ঘোষণা দেননি, গোলকিপার বলে তাঁর ২০২২ বিশ্বকাপে খেলার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে ৩৫ বছর বয়সী হাতজোড়া জার্মানিকে ২০২৪ ইউরোতেও ভরসা দেবে, এতটা আশা করা বোধ হয় বাড়াবাড়ি। স্পেনের ৩২ বছর বয়সী ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার সের্হিও বুসকেতসেরও গল্পটা একই।
জর্জো কিয়েলিনির ক্ষেত্রে অবশ্য ২০২২ বিশ্বকাপে তাঁকে দেখার আশা করাও বাড়াবাড়ি। ৩৬ চলছে তাঁর। ইতালির রক্ষণে তাঁর সঙ্গী লিওনার্দো বোনুচ্চিরও কালে কালে বয়স কম হলো না। ৩৪-এর বোনুচ্চিকেও বড়জোর কাতার বিশ্বকাপ পর্যন্ত আশা করতে পারে ইতালি।
তাহলে পেপের কথা কী বলবেন? ৩৮-এ এসেও যে এখনো দাপটের সঙ্গে পর্তুগালের রক্ষণে প্রথম পছন্দ হয়ে আছেন, এ-ই তো এক বিস্ময়!