তিন হাজার কোটির লোভেও বার্সাকে দুঃখ পেতে দেয়নি পিএসজি

রিয়াল মাদ্রিদ ছাড়ার চিন্তা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মাথায় কবে এসেছিল? ২০১৮ বিশ্বকাপের মাঝপথে রিয়াল মাদ্রিদ ছাড়ার ঘোষণা দেন রোনালদো। তবে এ সিদ্ধান্ত যে তিনি আগেই নিয়েছিলেন, সেটা জানা যায় পরে, জানিয়েছিলেন রোনালদোই। বলা হয়েছিল, জানুয়ারিতেই ক্লাবের কাছে বেতন বাড়ানোর কথা বলেছিলেন। কিন্তু ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ রাজি হননি। এরপর চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে জুভেন্টাসের মাঠে বাইসাইকেল কিকে গোল করার পর তুরিনের দর্শকদের অভিবাদন দেখেই নাকি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সেখানেই যাবেন।

জুভেন্টাস বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়তো সেদিনই নিয়েছেন রোনালদো। তবে রিয়ালের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ার ঘটনা এর আগের বছরই শুরু হয়েছিল। যখন ব্যালন ডি’অর বিজয়ী ঘোষণার অনুষ্ঠানে বিজয়ী রোনালদোকে ফেলে নেইমারকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন পেরেজ। প্রকাশ্যে বলেছিলেন, এমন কিছু জিততে চাইলে রিয়াল মাদ্রিদে যেতে হবে। দাবি করা হয়, নিজের ওপর থাকা পাদপ্রদীপের আলো এভাবে সরিয়ে নেওয়া মেনে নিতে পারেননি রোনালদো।

এত দিন পর জানা গেল, শুধু কথার কথাই বলেননি পেরেজ। আসলেই নেইমারকে কেনার চেষ্টা করেছিলেন তারকাপুঞ্জ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে চলা এই সভাপতি। এমনকি পিএসজিকে ৩০০ মিলিয়ন (৩০ কোটি) ইউরো দেওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছিল রিয়াল। বাংলাদেশি মূল্যমানে ৩ হাজার ২৫ কোটি টাকার এ প্রস্তাবে পিএসজি রাজি হলে বড় এক ধাক্কা খেত বার্সেলোনা। কিন্তু পিএসজি নেইমারকে বিক্রি করতে রাজি হয়নি তখন।

২০১৮ সালের চ্যাম্পিয়নস লিগের ম্যাচে রোনালদো নেইমার!
ফাইল ছবি

২০১৭ সালের দলবদলের বাজার ফুটবলের ইতিহাসে বড় পাদটীকা হয়ে থাকবে। এক মাসের মধ্যে বার্সেলোনা ও রিয়াল মাদ্রিদকে স্তব্ধ করে দিয়ে প্রথমবারের মতো ইউরোপকে নিজেদের শক্তির কথা জানিয়েছিল পিএসজি। প্রথমেই বার্সেলোনাকে নেইমারের বাই আউট ক্লজের ২২ কোটি ২০ লাখ ইউরো দিয়ে নিয়ে এসেছিল নেইমারকে। সে সময়কার দলবদলের বিশ্ব রেকর্ডের দ্বিগুণেরও বেশি ছিল সে অঙ্ক। এটুকু হজম করতেই সমস্যা হচ্ছিল। কিন্তু দলবদলের বাজার শেষ হওয়ার আগেই এল আরেকটি ঝড়।

আগের মৌসুমে ইউরোপকে চমকে দিয়েছিল ১৭ বছরের এক কিশোর। আবির্ভাবের পর থেকেই গুঞ্জন তার ওপর নজর পড়েছে রিয়াল মাদ্রিদের। এতটাই দুর্দান্ত খেলছে সে যে তাকে পেতে ১২ কোটি ইউরো দিতেও রাজি রিয়াল। মৌসুমে শেষ হতে হতে তার বয়স ১৮ হয়ে যায়। সে সঙ্গে দামটা বেড়ে যায় এক লাফে। দলবদলের বাজারে গুঞ্জন উঠে ১২ কোটি তাকে কেনা সম্ভব নয়, ১৮ কোটি ইউরো দিয়েই নিতে হবে তাকে। মাত্রই লা লিগা ও চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা রিয়াল পিছপা হয়নি। কিলিয়ান এমবাপ্পের জন্য সেটা দিতেই রাজি হয়েছিল স্প্যানিশ পরাশক্তিরা।

দলবদলের একদম শেষভাগে এসে এই দলবদল ছিনতাই করে পিএসজি। রিয়ালে গেলে মূল একাদশে নিয়মিত জায়গা পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তার শঙ্কা কাজে লাগিয়ে আর বাড়তি বেতনের হাতছানিতে এমবাপ্পেকে দলে নিয়ে দলবদলের বাজারের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অঙ্কটাও নিজেদের কাছে রেখে দেয় পিএসজি। একসঙ্গে নেইমার ও এমবাপ্পের মতো প্রজন্মের অন্যতম সেরা দুই ফরোয়ার্ডকে দলে টেনে নেয় পিএসজি।

নেইমারকে বহুবার কেনার চেষ্টা করেছেন পেরেজ।
ফাইল ছবি: রয়টার্স

কয়েক মাস পরই খবর আসে, নতুন দলে ভালো লাগছে না নেইমারের। নিজের ভুল বুঝে ফিরতে চান স্পেনে। ব্যালন ডি’অর পুরস্কারের দিন পেরেজের হাতছানি ছিল। আবার বার্সেলোনা থেকে দুই বন্ধু লিওনেল মেসি ও লুইস সুয়ারেজের আহ্বানও ছিল। কিন্তু নেইমারের ফেরা হয়নি। পেরেজ তবু হাল ছাড়েননি। রোনালদো রিয়াল ছাড়ার পর ভেবেছিলেন গ্যারেথ বেল হয়তো তাঁর শূন্যস্থান পূরণ করবেন। কিন্তু এক মৌসুমেই যখন নিশ্চিত হয়ে যায়, বেলের পক্ষে সেটা কখনোই সম্ভব হবে না। তখনই হাত বাড়িয়েছেন আবার।

নেইমারের বাবাই এখন ছেলের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করছেন। এক সময় এই দায়িত্বটা ছিল ওয়াগনার রিবেইরোর। নেইমার–সংক্রান্ত খবরে তাই তাঁর ওপর ভরসা রাখেন সবাই। ২০১৯ সালে পেরেজ যে নেইমারকে পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, আবার সে খবরটা রিবেইরোই জানালেন।

লে’কিপকে বলেছেন, ‘ওই সময় নেইমার রিয়াল মাদ্রিদে যাওয়ার পথে ছিল। মাদ্রিদ ওর জন্য ৩০ কোটি ইউরো দিতে রাজি ছিল। ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ নিজে বলেছে আমাকে, কিন্তু নাসের আল খেলাইফি (পিএসজি সভাপতি) রাজি হননি। বলেছিলেন, “১০০ কোটিতেও না, তাকে আমরা ছাড়ব না।”’

বার্সার জার্সিতে রিয়ালএক বেশ ভুগিয়েছেন নেইমার।
ফাইল ছবি

এমবাপ্পে ও নেইমার দুজনকেই পিএসজিতে রাখতে বদ্ধপরিকর খেলাইফি। সে কারণেই নেইমারের জন্য আরেকবার দলবদলের রেকর্ড ভাঙার দৃশ্য জন্ম নিতে পারেনি। রিয়াল এরপর এডেন হ্যাজার্ডের দিকে নজর দিয়েছে। বার্সেলোনা নেইমারকে ফেরানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে; যদিও খেলাইফির এই গোঁয়ার্তুমি পিএসজির জন্য বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে।

২০১৭ সালে যোগ দেওয়া দুই তারকাই এখনো চুক্তি নবায়ন করেননি। ২০২২ সাল পর্যন্ত চুক্তিবদ্ধ এ দুজন যদি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে চুক্তি নবায়ন না করেন, তাহলে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে অন্য যেকোনো ক্লাবের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন আর জুলাইয়েই মুফতে ক্লাব ছাড়তে পারবেন।

কিছুদিন আগেই শোনা গিয়েছিল, নেইমার নতুন চুক্তি করার পথে এগিয়ে গেছেন অনেক। কিন্তু এখন নতুন করে খবর এসেছে, চুক্তি নবায়ন না করে আবার বার্সেলোনায় ফেরার চেষ্টা করছেন নেইমার। ২০২১ সালে পারলে ভালো, আর না হলে একেবারে ২০২২ সালে মুফতেই প্রিয় ক্লাবে যাবেন নেইমার। তবে রিবেইরোর ধারণা, নেইমারের পক্ষে আর ক্লাব বদলানো সম্ভব হবে না।

নেইমার ও এমবাপ্পের অন্তত একজনকে পেতে চান পেরেজ।
ফাইল ছবি: রয়টার্স

কারণ? নেইমারের বেতন। করোনাপরবর্তী পৃথিবীতে নেইমারের বেতন নাকি বার্সেলোনা বা রিয়াল মাদ্রিদ কেউই দিতে পারবে না, ‘সে ওখানে সুখে আছে। বিশ্বের কোনো ক্লাব পিএসজি যা দিচ্ছে, সেটা দিতে পারবে না। একমাত্র ওরাই নেইমারকে পালতে পারবে। মাদ্রিদের আর্থিক সমস্যা আছে। বার্সা? ওদের অবস্থা তো আরও খারাপ। ইতালিতে, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বা সিটিতে? আমার মনে হয় না। প্যারিসে সে খুব ভালো আছে এবং খুব ভালো এক দলে খেলছে। এ মৌসুমে ওরা চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতবে এবং নেইমার ব্যালন ডি’অর পাবে।’

এ মৌসুমে পিএসজির ইউরোপের সেরা টুর্নামেন্ট জেতার স্বপ্ন বেশ ভালোভাবেই বেঁচে আছে। বায়ার্ন মিউনিখের মাঠে ৩-২ ব্যবধানে জিতে আসা দলটি সেমিফাইনালে ওঠার পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। গতবার ফাইনালে উঠে একটুর জন্য শিরোপা না জেতা দলটি এবার আছে দারুণ ফর্মে। আজ রাতে নিজেদের মাঠে বায়ার্নকে আটকে দিতে পারলেই সেমিফাইনালে উঠে যাবে তারা।