দর্শকপ্রিয় মোহামেডানের জেগে ওঠার অপেক্ষা

জেগে ওঠার অপেক্ষায় দর্শকপ্রিয় মোহামেডান।ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

২০১৮ সালের আগস্ট। আরামবাগের ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা মমিনুল হক সাঈদ মোহামেডানের অডিটরিয়াম ভাড়া নেন। আবুল কাশেম নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে সেখানে জুয়া-ক্যাসিনোর আসর বসান মমিনুল। প্রথম ছয় মাস মোহামেডান ভাড়া পেত দৈনিক ৫০ হাজার টাকা করে। পরের ৭ মাস ৭০ হাজার টাকা। মোহামেডানে কাঁচা টাকা আসতে থাকে। কিন্তু ক্যাসিনো-কাণ্ডে ভূলুণ্ঠিত হয় ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটির অর্জিত সব সম্মান।

১৯৮৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৯০ সালের ১৫ মার্চ পর্যন্ত প্রথম বিভাগ লিগে অপরাজিত ছিল মোহামেডান। ১৬৫০ দিনে ঘরোরা লিগে তারা টানা ৭৬টি ম্যাচে হারেনি। অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয়! অথচ ৮৪ বছরের পুরোনো ক্লাব সেই মোহামেডানের যাবতীয় গৌরবে কালি ছিটিয়েছে ক্যাসিনো-কলঙ্ক। গত বছর ২২ সেপ্টেম্বর ক্লাবটির ক্যাসিনো খেলার অডিটরিয়ামে তালা মারে পুলিশ। অন্য ক্যাসিনো ক্লাবগুলো বন্ধ থাকলেও মোহামেডান খোলা, সেখানে স্বাভাবিক কার্যক্রম চলছে।

এই এক বছরে কিছু বদল এসেছে ক্লাবটিতে। ফুটবল ম্যানেজার পদে আর নেই ক্লাবের ডিরেক্টর ইনচার্জ লোকমান হোসেন ভূঁইয়ার ঘনিষ্ঠ আমিরুল ইসলাম। বাফুফের লিগ কমিটির সভায় মোহামেডানের প্রতিনিধির চেয়ারও ফাঁকা পড়ে ছিল গত কিছুদিন। ৩ অক্টোবর বাফুফের নির্বাচনে মোহামেডানের সাবেক ফুটবলার বা কর্মকর্তাদের মধ্যে জিতেছেন মাত্র একজন। অর্থাৎ ক্লাবটি মাঠে-মাঠের বাইরে সবখানেই খারাপ অবস্থায়। ক্যাসিনো-কাণ্ডের পর হয়ে পড়েছে অভিভাবকহীন।

তবে ক্লাবের অনেক সাবেক ফুটবলার ও সংগঠক এগিয়ে আসেন সংস্কারের আশায়। সাবেক ফুটবলার বাদল রায়, ৭১ টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল বাবু, সাংবাদিক রেজাউর রহমান হাল ধরেন ক্লাবের। তাঁরা তহবিল সংগ্রহ করেন ফুটবল দল গড়তে।

৩ কোটি টাকার মতো ওঠে তখন। গত অক্টোবর-নভেম্বরে ফুটবল দল গড়া হয় এবং সেই দল তুলনামূলক ভালোই করেছে। আগামী ডিসেম্বরে নতুন মৌসুমে মাঠে নামবে মোহামেডান। বাদল রায়সহ অন্যদের দিকনির্দেশনায় মাঠপর্যায়ে দল গঠনসহ সবকিছু দেখছেন আবু হাসান চৌধুরী। সংগঠক ফজলুর রহমান বাবুলসহ কয়েকজন আছেন ক্লাবের সঙ্গে। সংস্কারপন্থীদের দলে ক্লাবের সাবেক অতিরিক্ত সাধারণ সম্পাদক মোস্তাকুর রহমান থাকলেও তিনি সরে গেছেন। ক্লাবকে ৫ লাখ টাকা ‘ধার’ দিয়ে সেটি ফেরত নিয়েছেন।

এক সময় মাঠে দোর্দণ্ড প্রতাপ ছিল সাদা–কালো শিবিরের।
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

ক্যাসিনো-কাণ্ডের পর মোহামেডানকে সহায়তা করতে যাঁরা এগিয়ে আসেন, তাঁদের মধ্যে আছেন ক্লাবটির সাবেক সভাপতি ওবায়দুল করিমও। অবশ্য ক্যাসিনো-কাণ্ডের আগেই গত বছরের ২৮ আগস্ট তাঁকে সরিয়ে আদালত মোহামেডানের অন্তর্বর্তীকালীন সভাপতি করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আমিন উদ্দিনকে। সম্প্রতি তিনি অ্যাটর্নি জেনারেল হয়েছেন। তবে আদালত মোহামেডানের ছয় বছরের মেয়াদোত্তীর্ণ পরিচালনা পর্ষদ বহাল রাখেন। মোহামেডানের ইতিহাসে এত দুর্বল ও নিষ্ক্রিয় পরিচালনা পর্ষদ নজিরবিহীন। তিন-চারজন ছাড়া এই বোর্ডের বাকিরা আছেন শুধুই নামে। আগামী বোর্ডে পরিচালক হতে তাই বছরে অন্তত ২৫ লাখ টাকা দিতে হবে, এমন নিয়মের কথা ভাবছেন সংস্কার-উদ্যোগীরা। তবে এতে ক্লাবের নিবেদিতপ্রাণ কর্মকর্তাদের অবমূল্যায়নের সুযোগ তৈরি হতে পারে।

নতুন নেতার খোঁজে: আগামী ৯ জানুয়ারি মোহামেডানের সাধারণ সভা ও পরিচালনা পর্ষদের বহুল আলোচিত নির্বাচন। ১৬ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদে লোকমান হোসেন ভূঁইয়া থাকবেন না বলে জানিয়েছেন তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরা। নতুন ডিরেক্টর ইনচার্জ কে হবেন, সেটি ঠিক হবে নির্বাচনের পর। অবশ্য পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা কমই। সংস্কারের সঙ্গে যুক্তরা একক একটি পর্ষদ তৈরির কাজ করছেন। যেখানে বিদায়ী বোর্ডের মাহবুবুল আনাম, হানিফ ভূঁইয়া, মেঘনা গ্রুপের মোস্তফা কামালসহ চার-পাঁচজন ছাড়া বাকিদের বাদ পড়ার আশঙ্কাই বেশি। সব ঠিকঠাক থাকলে মোহামেডানে নতুন সভাপতি হতে যাচ্ছেন সাবেক সভাপতি ওবায়দুল করিম। এমনটাই জানিয়েছে ক্লাবের একটি সূত্র।

মোহামেডান ক্লাব এত দিন বলতে গেলে একক হাতে চালাতেন লোকমান হোসেন ভূঁইয়া। ক্যাসিনো বসানোর আগে বোর্ডের লিখিত অনুমতি নেননি তিনি। বোর্ড সভাও ডাকেননি। এটা তাঁর বড় ভুল বলে তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরা বলেন। তা ছাড়া সভাপতির সঙ্গে তাঁর ভালো যোগাযোগ ছিল না। তবে ক্লাবে ক্যাসিনো বসার দায় লোকমান ভূঁইয়া এককভাবে নিতে রাজি নন, ‘আমরা হল ভাড়া দিয়েছি। ক্যাসিনো বসাতে বলিনি। জোর করে ওরা এটা করেছে। আমি বোর্ড সদস্যদর সঙ্গে কথা বলেছিলাম। কিন্তু সভাপতির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। আমাদের করার কিছু ছিল না। ক্যাসিনো সম্পূর্ণ অবৈধ জিনিস, অবৈধভাবেই এটা করেছে ওরা।’

ক্যাসিনোর ঘটনার পর লোকমান গ্রেপ্তার হয়ে ১৯ দিন রিমান্ডে ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধ মানি লন্ডারিং, দুদক ও বাসায় মদ রাখার মামলা আছে। ছয় মাস জেলে কাটিয়ে তিনি এখন জামিনে আছেন। তবে ক্লাবে আর আসেননি। ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক হলেও তিনি সেখানেও যান না।

তবে লোকমান হোসেন ভূঁইয়াকে আগামী ৯ জানুয়ারি মোহামেডানের সাধারণ সভায় থাকতেই হবে। কারণ, এখনো তিনি ক্লাবটির ডিরেক্টর ইনচার্জ। সাধারণ সভায় গত সাত বছরের রিপোর্ট তিনিই পড়বেন। লোকমান হোসেন ভূঁইয়া সেটি করবেন বলে জানা গেছে। অবশ্য বাদল রায়ের শঙ্কা, ‘লোকমান সাহেব ক্লাবটাকে ধ্বংস করে এখন আবার ফেরার ষড়যন্ত্র করছেন। ওনার সঙ্গীরাও অপতৎপরতা চালাচ্ছেন।’ তবে লোকমান হোসেন ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাকে বাদ দিয়ে কমিটি করলে করুক। কেউ একজন মোহামেডানের হাল ধরুক। ক্লাবের ভেতর কেউ সংস্কার চাইলে করুক। আমার আপত্তি নেই। কেউ এসে মোহামেডানকে এগিয়ে নিতে পারলে আমি খুশিই হব।’

খুশি হবে ক্লাবটির লাখো সমর্থক এবং দেশের ফুটবলাঙ্গনও।