দশে একবারই ৯ সালাউদ্দিন

>ফুটবলে ১০ নম্বর জার্সির কথা উঠলেই ভেসে ওঠে কিছু কিংবদন্তির মুখ। বিশ্ব ফুটবলে পেলে-ম্যারাডোনা থেকে শুরু করে রোনালদিনহো-জিদান হয়ে বর্তমানের লিওনেল মেসি-নেইমারের গায়ে শোভা পায় ১০ নম্বর। বাংলাদেশের জাতীয় দলের ইতিহাসে যাদের গায়ে উঠেছে মর্যাদার এই ১০ নম্বর জার্সি, তাদের কয়েকজনকে নিয়েই নতুন এই ধারাবাহিক 'বাংলাদেশের ১০ নম্বর'
তাঁর সময়ে বাংলাদেশের `১০ নম্বর` মানেই ছিল সালাউদ্দিন। ফাইল ছবি
তাঁর সময়ে বাংলাদেশের `১০ নম্বর` মানেই ছিল সালাউদ্দিন। ফাইল ছবি

বাংলাদেশের ফুটবলের সর্বকালের সেরা ফুটবলার কে?

তর্ক-বিতর্ক অনেকই হতে পারে। তবে বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন যে কাজী সালাউদ্দিন, এ ব্যাপারে সম্ভবত কারোই দ্বিমত নেই। বল নিয়ে ছোটার সময় তাঁর ঝাঁকড়া চুলের দোল খাওয়া, অভিজাত চলন-বলন- সব কিছুই ছিল রাজসিক। দেশের প্রথম ফুটবলার হিসেবে বিজ্ঞাপনের (লাইফবয় সাবান) মডেল হওয়া সালাউদ্দিন হংকংয়ের পেশাদার ফুটবলও খেলেছেন। জাতীয় দলের '১০ নম্বর' জার্সিটি দীর্ঘদিন ছিল তাঁর অধিকারেই।

বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের প্রথম ১০ নম্বর জার্সিটাই উঠেছিল কাজী সালাউদ্দিনের গায়ে। ১৯৭৩ সালের ২৬ জুলাই ফিফা স্বীকৃত প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ দল। মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত মারদেকা কাপে থাইল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে উড়েছিল বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা। সেই ঐতিহাসিক ম্যাচেই সালাউদ্দিন প্রথম পরেন জাতীয় দলের ১০ নম্বর জার্সি। মাঝে দুটি টুর্নামেন্টে তিনি ছিলেন না। বাকি সময়টা বাংলাদেশের '১০ নম্বর' মানেই ছিল সালাউদ্দিন।

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের গর্বিত খেলোয়াড়দের একজন ছিলেন তিনি। জাতীয় দলে খেলেছেন স্বাধীনতার ঊষালগ্ন থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত। জাতীয় দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন দুবার, যা নিয়ে আজও তিনি গর্বিত। সালাউদ্দিন বলেন, 'সাধারণত দেশের সেরা স্ট্রাইকারদের গায়েই থাকে ১০ নম্বর জার্সি। এই রীতি শুরু হয় ব্রাজিলের পেলের কাছ থেকে। আমি জাতীয় দলে সব ম্যাচই ১০ নম্বর নিয়ে খেলেছি। এটা বিরাট গর্বের। তবে আমি কিন্তু ১০ নাম্বার জার্সি চেয়ে নিইনি।'

১৯৭৫ সালে মারদেকা কাপে প্রথম জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব পান সালাউদ্দিন। দ্বিতীয়বার অধিনায়ক হন ১৯৭৯ সালে কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে। সেই টুর্নামেন্টের ঠিক আগের টুর্নামেন্টেই ১৯৭৯ সালে ঢাকায় এশিয়ান কাপের বাছাইপর্বে অধিনায়কত্বের সঙ্গে ১০ নাম্বার জার্সিটিও তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়। ওই ঘটনা এখনো পোড়ায় সালাউদ্দিনকে, '১৯৭৯ সালে আমার কাছে থেকে জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব ও ১০ নম্বর জার্সি কেড়ে নিয়ে ব্রাদার্সের মহসীনকে (মোহাম্মদ মহসীন) দেওয়া হয়। এর পেছনে রাজনৈতিক কারণ থাকতে পারে। জাতীয় দলে ওই প্রথম ১০ নম্বর ছাড়া খেললাম আমি। অবশ্য পরে অধিনায়কত্ব ও ১০ নম্বর জার্সি দুটোই ফিরে পাই।'

দুইটি মারদেকা কাপ, এশিয়ান কাপের বাছাই ও চূড়ান্ত পর্ব মিলিয়ে তাঁর নামের পাশে আনুমানিক ২৭-২৮ টি আন্তর্জাতিক ম্যাচের অভিজ্ঞতা। ১৯৭৩-১৯৮৩ পর্যন্ত বাংলাদেশ ম্যাচ খেলেছে ৩৮টি। জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব নিয়ে গোলমালে ১৯৭৮ ব্যাংকক এশিয়ান গেমসে সালাউদ্দিনসহ আবাহনীর ৭ খেলোয়াড় যাননি। এরপর ১৯৮২ সালে দিল্লি এশিয়ান গেমসে ছিলেন না সালাউদ্দিন। ওই দুটি টুর্নামেন্ট এবং চোট-আঘাত ইত্যাদি মিলিয়ে জাতীয় দলের বেশ কয়েকটি ম্যাচ খেলা হয়নি তাঁর। ১৯৭৯ সালের এশিয়ান কাপের বাছাইপর্বের চারটি বাদ দিলে জাতীয় দলের হয়ে আনুমানিক ২৩-২৪টি ম্যাচে ১০ নম্বর জার্সি পরেন সালাউদ্দিন। জাতীয় দলের জার্সিতে তাঁর নামের পাশে গোল আছে ৮টিরও বেশি। সালাউদ্দিন গোল করেছেন উত্তর কোরিয়া এবং কাতারের মতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিপক্ষেও। দেশের ফুটবলের আন্তর্জাতিক তথ্য কোথাও সংরক্ষিত নেই, তাই মুখের কথা আর অনুমানের ওপরেই ভরসা রাখতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের বর্তমান সভাপতি ১৯৭২ থেকে একটানা ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত আবাহনীতে খেলেন। আবাহনীতেও '১০'-ই লেখা ছিল তাঁর পিঠে। সালাউদ্দিনের অবসরের পর প্রায় দশ বছর তুলে রাখা হয়েছিল আবাহনীর ১০ নম্বর জার্সি। ১৯৬৮ সালে দিলকুশার হয়ে দ্বিতীয় বিভাগ দিয়ে ঢাকার ফুটবলে পা রাখা সালাউদ্দিন স্বাধীনতার আগে খেলেন ওয়ারী এবং মোহামেডানে। ক্লাব ক্যারিয়ারে একটি ডাবল হ্যাটট্রিকসহ অন্তত ১০ টি হ্যাটট্রিক আছে তাঁর।

জাতীয় দলের হয়ে সালাউদ্দিনের প্রথম গোল ১৯৭৩ সালে মারদেকা কাপে। সেটি ছিল থাইল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচেই। নির্ধারিত সময়ে ২-২ গোলে অমিমাংসিত ম্যাচে বাংলাদেশের পক্ষে দ্বিতীয় গোলটি ছিল সালাউদ্দিনের। সালাউদ্দিনের চোখে সেটিই জাতীয় দলের ক্যারিয়ারে তাঁর সেরা গোল। সালাউদ্দিন বলেন, 'জীবনের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ, খুব উত্তেজনা অনুভব করছিলাম। এক গোল দিয়ে দুই গোল খাওয়ার পর আমার গোলে ড্র! যতটুকু মন পড়ে, মাঝমাঠের ওপর থেকে বলটি পেয়েছিলাম। বল নিয়ে জোরে দৌড় দিতেই ডিফেন্ডাররা আমার পেছনে পড়ে যায়। এরপর বক্সের ওপর থেকে শট নিয়ে গোল।' ম্যাচটাতে বাংলাদেশ শেষ পযন্ত টাইব্রেকারে হেরে যায়।

সালাউদ্দিন জাতীয় দলে থেকেও ১০ নম্বর জার্সি পাননি, এরকম ঘটনা একবারই ঘটেছে। সেবার জার্সিটা পান সে সময়ের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার ব্রাদার্সের স্ট্রাইকার মোহাম্মদ মহসীন। সালাউদ্দিনের জার্সি ও অধিনায়কত্ব হঠাৎ তাঁর কাছে আসবে, এর জন্য বিন্দুমাত্র প্রস্তুত ছিলেন না মহসীন। আজ এত বছর পর পেছন ফিরে বলেন, '১৯৭৯ সালে ঢাকায় এশিয়ান কাপের বাছাইয়ে যখন আমাকে বলা হলো, ১০ নম্বর জার্সি তুমি পরবে, আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। সালাউদ্দিন ভাই থাকতে আমি ১০ নম্বর পরব! খেলোয়াড়ি জীবন থেকেই আমি তাঁকে খুব সম্মান করি। আমার এখনো মনে হয় সেবারও জার্সিটা সালাউদ্দিন ভাই পরলেই ভালো হতো। আমার কাছে খারাপ লেগেছে সালাউদ্দিন ভাই কেন পেলেন না। অধিনায়কত্বের ক্ষেত্রেও তাই।'