দুঃখের আঁধারে ঢাকা আলোর জীবন

আলেয়া আলো যখন ক্রিকেটার। ছবি: সংগৃহীত
আলেয়া আলো যখন ক্রিকেটার। ছবি: সংগৃহীত

কেমন আছেন?
‘এই তো চলে যাচ্ছে।’
‘এই তো চলে যাচ্ছে।’ দীর্ঘশ্বাস, চাপা কষ্ট ও বোবা কান্না। মা-বাবাকে হারিয়ে প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন আলেয়া আলো। সুখ নামের আলেয়ার পেছনে ছোটাই সার। ব্যাট হাতে ও মুখে বাঁশি নিয়ে উত্তাল সাগর পাড়ি দেওয়ার লড়াই করে যাচ্ছেন। ২৭ বছর বয়সী চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের মেয়েটি বর্তমানে একাধারে ক্রিকেটার ও ফুটবল রেফারি।

জাতীয় দলে খেলা না হলেও মেয়েদের প্রিমিয়ার লিগে পরিচিত মুখ। ছেলেদের ফুটবলেও রেফারিং করার অভিজ্ঞতা আছে তাঁর। অবশ্য নজর কেড়েছেন বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা ফুটবলের ফাইনালে রেফারির দায়িত্ব পালন করে। একাধারে ক্রিকেটার আর ফুটবল রেফারি, আলেয়ার পরিচয়টা অদ্ভুত।

জীবনটাই এক অদ্ভুত ধারাপাত শিখিয়েছে তাঁকে। সেই শৈশব থেকে। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া মেয়েটির সবেই বোঝার বয়স শুরু। হঠাৎ একদিন ঘুম ভেঙে দেখলেন মায়ের নিথর দেহ ঘর থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। চিৎকার করে কেঁদেছেন সেদিন। ‘আমার মাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন! আমার মাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন!’ বাবা ফছিউদ্দিন মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে শান্ত করেছেন, ‘মা নেই। আমি তো আছি। আজ থেকে আমিই তোর বাবা-মা।’

তবু মাকে হারানোর যন্ত্রণা ভোলা যায়! বাবার আদর ও বড় বোনদের স্নেহে এর মধ্যেই পার করেছেন কৈশোর। পেরিয়ে গেছেন মাধ্যমিকের গণ্ডি। কিন্তু বরাবরই ভাগ্য মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে আলেয়ার কাছ থেকে। একটু সুখের আলো দেখতে দেখতেই মৃত্যুর অন্ধকার থাবা কেড়ে নিয়ে গেল বাবাকেও। মায়ের মৃত্যুর সাত বছর পর সড়ক দুর্ঘটনায় বিদায় নিলেন বাবা। নিজেকে টিকিয়ে রাখার প্রায় নিঃসঙ্গ লড়াইয়ে আলেয়া বেছে নিলেন খেলাকে।

ছোটবেলা থেকেই হতে চাইতেন ক্রিকেটার। স্কুলশিক্ষক মেজ বোন জাহানারা বেগমের সহায়তায় পড়াশোনার সঙ্গে লুকিয়ে লুকিয়ে ক্রিকেটটাও চালিয়ে নিতে লাগলেন আলেয়া। চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ২০১১ সালে স্থানীয় ক্রিকেট কোচ শ্যামল দাসের হাত ধরে জায়গা করে নিলেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় দলে। খেলার জন্য পায়ের নিচে পাওয়া গেল মাটি। স্বপ্নটাকে আরও এগিয়ে নিতে এবার ঢাকায় যেতে হবে।

রেফারির দায়িত্ব শেষে পুরস্কার হাতে আলেয়া আলো। ছবি: সংগৃহীত
রেফারির দায়িত্ব শেষে পুরস্কার হাতে আলেয়া আলো। ছবি: সংগৃহীত

কিন্তু বিভাগীয় পর্যায় থেকে ঢাকা লিগে এসে খেলবেন, সে উপায় নেই। কোথায় থাকবেন, কী খাবেন! অবশেষে ক্রিকেটার রাশেদা রহমান রুবি, আদুরি ও লতা মণ্ডলের সহায়তায় ২০১২ সালে ঢাকায় পাড়ি জমালেন আলেয়া। এর পরে শেখ জামাল, কলাবাগান ও আনসার মিলিয়ে সাত মৌসুম ধরে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে খেলে যাচ্ছেন। তাই তাঁদের প্রতি আলেয়ার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই, ‘রুবি, আদুরি ও লতা আপু না থাকলে আমার কখনোই ঢাকায় এসে খেলা হতো না। তাঁরা আমার থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, খেলার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তাঁদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।’

একজন ক্রিকেটার হিসেবেই গল্পটা শেষ করা যেত। কিন্তু শেষ বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা ফুটবলের ফাইনালে দেখা গেল বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে রেফারির ভূমিকায় বাঁশি হাতে দৌড়াচ্ছেন। খেলা শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গলায় ঝুলিয়ে দিলেন মেডেল। এখন ক্রিকেটের পাশাপাশি রেফারিংও চালিয়ে যাচ্ছেন দিব্যি।

ক্রিকেট ছেড়ে হঠাৎ রেফারিং কেন, দিলেন সে ব্যাখ্যা। জীবনের তাগিদেই নতুন কিছু খুঁজে নেওয়া, ‘আসলে শুধু ক্রিকেট খেলে আমি চলতে পারছিলাম না। তাই বিপিএড করে রেফারিং কোর্স করি। সেখান থেকে আবদুল হান্নান মীরন স্যারের সহায়তায় রেফারিংয়ে আসা। এখন তো আমি চট্টগ্রামে ছেলেদের ফুটবলেও রেফারিং করছি।’

একটা সময় শুধু ক্রিকেট নিয়েই ভেবেছেন। কিন্তু সেখানে প্রত্যাশামাফিক সাফল্য আসেনি। তাই এবার রেফারিং নিয়েই স্বপ্ন দেখেন আলেয়া, ‘যেহেতু আমার ফিটনেস ভালো আছে। তাই স্বপ্ন দেখি এখন ফিফা রেফারি হওয়া।’

বলতে বলতেই ডাক আসে আলেয়ার। ছুটে যান মাঠে। মুখে বাঁশি তুলে ফুঁ দেন। তাঁর ফুঁতেই চলে খেলা, থামে, শেষ হয়। আলেয়া শুধু ভাবেন, তাঁর জীবনের ভাগ্য নামের ৯০ মিনিটের অনিঃশেষ ম্যাচের বাঁশি বাজাচ্ছেন যে রেফারি, তিনি কবে সদয় হবেন!