নেইমারদের লিগ থেকে বাংলাদেশের লিগে

ফ্রেঞ্চ লিগে খেলা ক্রিস্টিয়ান কুয়াকু খেলছেন ঢাকা প্রিমিয়ার ফুটবল লিগের দল বাংলাদেশ পুলিশ ক্লাবে।

ক্রিস্টিয়ান কুয়াকু খেলেছেন ফ্রেঞ্চ লিগে।ছবি: প্রথম আলো

মধ্যদুপুরে খাটের কোনায় মোমবাতি জ্বলছে। ধর্মীয় প্রার্থনার জন্য ওখানে সারা দিনই মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখা হয়। পাশেই ক্লোদিং র‍্যাকে ঝুলছে দামি পোশাক। এক কোনায় সচ্ছলতার বিজ্ঞাপন বাহারি রঙের সাত-আট জোড়া জুতা। রাজধানীর নিকুঞ্জে ক্লাবের ফ্ল্যাটে ছোট এক রুমে এভাবেই নিজের মতো করে সংসার সাজিয়েছেন ফ্রেঞ্চ লিগে ২৫টি ম্যাচ খেলা ক্রিস্টিয়ান কুয়াকু। মোনাকো ক্লাবের বিপক্ষে বাইসাইকেল কিকে দৃষ্টিনন্দন একটা গোল আছে তাঁর। কুয়াকু ফরাসি কাপে খেলেছেন নেইমার, ডি মারিয়া, কিলিয়ান এমবাপ্পেদের পিএসজির বিপক্ষেও।

সর্বশেষ আজারবাইজান প্রিমিয়ার লিগে খেলা ৩০ বছর বয়সী আইভরিকোস্টের এই স্ট্রাইকারকে মধ্যবর্তী দলবদলে নিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ ফুটবল ক্লাব। গত ৩০ এপ্রিল আবাহনী লিমিটেডের বিপক্ষে জোড়া গোল করে বাংলাদেশ অধ্যায় শুরু করে নিজের জাত চিনিয়েছেন। তাঁর জোড়া গোলের সৌজন্যেই দুবার পিছিয়ে পড়েও আবাহনীর বিপক্ষে ড্র করে পুলিশ। দ্বিতীয় গোলটি করেছেন বক্সের মধ্যে প্রতিপক্ষের চার খেলোয়াড়ের মাঝে থেকে বাঁ পায়ের জোরালো শটে। অবশ্য এমন অভিষেকেও সন্তুষ্ট নন কুয়াকু, ‘ম্যাচের ভিডিওটা দেখেছি। মনোযোগ ধরে রাখতে পারলে ৪ গোল করতে পারতাম। অন্তত ৩ গোল তো করাই উচিত ছিল।’

—তাহলে তো অনেক গোল করার লক্ষ্য নিয়েই বাংলাদেশে এসেছেন?

সামনে বসে হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজে দেওয়া প্রশ্নটি গুগলে অনুবাদ করে কুয়াকুর জবাব, ‘ইয়েস...ইয়েস...৷’

‘থাকার ঘরটা ছোট না বড়, সুযোগ-সুবিধা কম না বেশি, সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। এসব জেনেই আমি এখানে খেলতে এসেছি। আমাকে আমার কাজটা করতে হবে।’
ক্রিস্টিয়ান কুয়াকু, ফ্রেঞ্চ লিগে খেলা পুলিশ ফুটবল ক্লাবের স্ট্রাইকার
ফ্রেঞ্চ কাপে পিএসজির বিপক্ষে একটি ম্যাচে কুয়াকু (১৩ নম্বর জার্সি)
ছবি: সংগৃহীত

২০০৭ সালে কুয়াকু বেলজিয়ামের বিখ্যাত ক্লাব আন্ডারলেচেটের নজরে আসেন। অবশ্য যুবদলে খেললেও ক্লাবটির মূল দলে তাঁর খেলা হয়নি। বেলজিয়াম পর্ব চুকিয়ে থাইল্যান্ড, ফ্রান্স, চেক প্রজাতন্ত্র, আজারবাইজান হয়ে এবার এলেন বাংলাদেশে। ছয়টি দেশের আট ক্লাবে খেলা কুয়াকুর পেশাদার ফুটবলজীবনে অর্ধযুগই কেটেছে ফ্রান্সে। স্তাদ মালেরব কাঁতের হয়ে প্রিমিয়ার লিগ খেলা ছাড়াও ১২২টি ম্যাচ খেলেছেন টোর ও নিমস অলিম্পিয়ানের হয়ে ফ্রেঞ্চ লিগ টুতে। সব মিলিয়ে গোল আছে তাঁর ৩৫টি।

লিগে মোনাকো, অলিম্পিক লিওর বিপক্ষে খেললেও পিএসজির বিপক্ষে মাঠে নামা হয়নি। বেঞ্চে বসেই নেইমারদের বিপক্ষে ৩-১ গোলে হার দেখেছেন কুয়াকু। ম্যাচ শেষে নেইমারের বিপক্ষে জার্সি বদলের গল্প শোনালেন এই প্রতিবেদককে, ‘ম্যাচ শেষে নেইমারের সঙ্গে জার্সি বদল করতে চাইলে নেইমার রাজি হয়ে গেলেন। সেই জার্সি আইভরিকোস্টে আমার বাড়িতে সাজানো আছে।’ আবিদজান শহরের সে বাড়িতেই ছয় বছরের একমাত্র ছেলেকে নিয়ে থাকেন কুয়াকুর স্ত্রী।

নেইমার–এমবাপ্পেদের বিপক্ষে খেলে কুয়াকু এখন বাংলাদেশ লিগে।
ছবি: প্রথম আলো

আইভরিকোস্টে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষা মিশনের কল্যাণে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভালো ধারণা ছিল কুয়াকুর। আপাতত কোনো ক্লাবের সঙ্গে চুক্তি না থাকায় বাংলাদেশের ডিজিয়ার সকার এজেন্সির মাধ্যমে পুলিশ ক্লাবের প্রস্তাবটি পেয়ে চলে এলেন ঢাকায়। ইউরোপের সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশের ফুটবলের সুযোগ-সুবিধা খুব সামান্যই। তবে বাস্তবতা জেনেই এখানে এসেছেন কুয়াকু, ‘থাকার ঘরটা ছোট না বড়, সুযোগ-সুবিধা কম না বেশি, সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। এসব জেনেই আমি এখানে খেলতে এসেছি। আমাকে আমার কাজটা করতে হবে।’ ঢাকার মাঠে খেলতে নেমে কিছু সমস্যায়ও পড়ছেন কুয়াকু। তবে সেটাকে তিনি দেখছেন পেশাদার দৃষ্টিতেই, ‘এখানে শক্ত মাঠে খেলেছি বলে আমার সিন বোনে (হাত দিয়ে দেখালেন) প্রচুর ব্যথা হয়েছে। আগের ক্লাবগুলোতে আমার সঙ্গে একজন ফিজিও থাকত, কিন্তু এখানে সেটা নেই বলে অভিযোগ করতে পারি না। আমি তো জেনেবুঝেই এসেছি।’

যুব জাতীয় দলে খেলা কুয়াকু একবার ডাক পেয়েছিলেন আইভরিকোস্টের মূল জাতীয় দলের প্রাথমিক ক্যাম্পে। তবে ফ্রেঞ্চ লিগে খেলার সুবাদে দেশটির স্থানীয় ফুটবলাররা তাঁকে বড় ফুটবলার হিসেবেই সম্মান করেন। সতীর্থ হিসেবে কুয়াকুকে পেয়ে উচ্ছ্বসিত পুলিশের অন্য দুই আইভরিয়ান ল্যান্সিন তোরে ও ফ্রেডরিক পুদা। অধিনায়ক তোরে বলেছেন, ‘বড় ক্লাবে খেলতেন বলে আমরা তো তাঁকে আগে থেকেই চিনতাম। এখন একই ক্লাবে খেলতে পেরে ভালো লাগছে। তাঁর ফ্রেঞ্চ ও ইউরোপা লিগে খেলার অভিজ্ঞতা আমাদের কাজে লাগবে।’