পেনাল্টি-ব্যর্থতার পরও বেলের ঝলকেই তুরস্ককে হারাল ওয়েলস

ম্যাচ শেষে দলের জয়ের উদ্‌যাপনের মধ্যমণি বেল।ছবি: রয়টার্স

ম্যাচে দারুণ খেলেছেন গ্যারেথ বেল। ওয়েলসের পাল্টা আক্রমণে বারবার নেতৃত্ব দিয়েছেন। নিচে নেমে এসে দলের খেলাও গড়ে দিয়েছেন। ওয়েলস যে দুটি গোল করেছে, দুটিই তাঁর গড়ে দেওয়া।

৪২ মিনিটে অ্যারন রামসি যে গোলটি করেছেন, সেটিও এসেছে তাঁরই চোখধাঁধানো এক পাস থেকে। এরপর ম্যাচের একেবারে শেষ মুহূর্তে কনর রবার্টসের গোলটিও এসেছে বেলের পাস থেকেই।

কিন্তু আজারবাইজানের বাকুতে ইউরোর ম্যাচটিতে তুরস্কের বিপক্ষে ম্যাচে তবু গ্যারেথ বেল পুরোপুরি খুশি হতে পারছেন না। ৬১ মিনিটে যে পেনাল্টিতে গোল করার সুযোগ পেয়েও সেটি উড়িয়ে মেরেছেন ওয়েলশ অধিনায়ক!

তবে ওই ব্যর্থতাটুকু একপাশে রাখলে বেল স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়েই মাঠ ছাড়তে পেরেছেন। তাঁর পেনাল্টি-ব্যর্থতার পরও তুরস্ককে আজ ২-০ গোলে হারিয়েছে ওয়েলস।

এ জয়ে ইউরোর দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠার স্বপ্নও আরও উজ্জ্বল হলো সর্বশেষ ইউরোতে সেমিফাইনালে খেলা ওয়েলসের! ২ ম্যাচে ৪ পয়েন্ট হলো ওয়েলসের, চার দলের গ্রুপে এই মুহূর্তে শীর্ষে তারা।

দুই ম্যাচেই হেরে যাওয়া তুরস্ক আছে গ্রুপে সবার শেষে, গ্রুপ পর্ব থেকে তাদের বিদায় প্রায় নিশ্চিত বলা যায়। আজ বাংলাদেশ সময় রাত একটায় ইতালি ও সুইজারল্যান্ড নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে মুখোমুখি হবে। ওয়েলস গ্রুপে নিজেদের শেষ ম্যাচ খেলবে আগামী রোববার রোমে ইতালির বিপক্ষে।

বেলের পেনাল্টি বারের অনেক ওপর দিয়ে চলে গেছে।
ছবি: টুইটার

তার আগে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচটাতে কী দারুণই না খেলেছে ওয়েলস! বলের দখল তুরস্কেরই বেশি ছিল, কিন্তু আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে জমে ওঠা ম্যাচে ওয়েলসই গোলের সুযোগ পেয়েছে অনেক বেশি। পাল্টা আক্রমণে বারবার ভয় ধরিয়েছে তুরস্কের রক্ষণে।

প্রথমার্ধে তো যেন একবার এদিকে, একবার ওদিকে আক্রমণ দেখেছে ম্যাচটা! ৬ মিনিটেই ওয়েলসকে এগিয়ে দেওয়া দারুণ সুযোগ হারিয়েছেন রামসি। বেল আর রামসির সমন্বয় ঠিকঠাক হলে যে এই দল নিয়েও ওয়েলস যে কারও বড় পরীক্ষা নিতে পারে, সেটিরই প্রমান ম্যাচে প্রথমবার দেখল তরুণ প্রতিভায় ঠাসা তুরস্ক।

ম্যাচের শুরুতে ৪-১-৪-১ ছকে বাঁ দিকের উইংয়ে খেলা শুরু করা বেলের দারুণ রিভার্স পাস বক্সের দিকে গেল রামসির দৌড়ের গতিপথ অনুসরণ করে। রিয়াল মাদ্রিদ থেকে এই মৌসুমে ধারে টটেনহামে খেলা উইঙ্গারের থ্রু নিয়ন্ত্রণে নিয়ে পায়ের নাচনে রামসি প্রথমে তুরস্কের এক ডিফেন্ডারকে বোকা বানালেন, কিন্তু এরপর জুভেন্টাস মিডফিল্ডারের শট গেল সোজা তুরস্কের গোলকিপারের গায়ে।

৯ মিনিটে তুরস্কের আক্রমণের পালা। ফ্রি-কিক থেকে ডান প্রান্তে বল গেল চেঙ্গিজ উন্দেরের পায়ে, তাঁর ক্রস বক্সে খুঁজে নেয় স্ট্রাইকার ও অধিনায়ক বুরাক ইলমাজকে। কিন্তু ইলমাজের শটে পা লাগিয়ে ওয়েলসকে সে যাত্রায় বিপদমুক্ত করেন মেফাম।

১৪ মিনিটে ইলমাজের পাস ধরে উন্দেরের ভলি গেল ওয়েলস গোলকিপারের দিকে, তিন মিনিট পর উল্টোদিকের বক্সে বেল হেড করে বলটা পোস্টে রাখতে পারলেন না। সেখান থেকে রামসি-মুর হয়ে বল নিয়ে হাঁচোড়-পাঁচোড়ের মধ্যে তুরস্কের ডিফেন্ডার চাগলার সোয়ুঞ্জু বিপদমুক্ত করেন দলকে।

সেগুলো তা-ও অত বড় সুযোগ নয়, ফুটবলের ভাষায় ‘হাফ-চান্স’। কিন্তু ২৪ মিনিটে রামসি যে সুযোগ কাজে লাগাতে ব্যর্থ হলেন, এভাবে সুযোগ হাতছাড়া করার মূল্য ম্যাচ শেষে কীভাবে দিতে হয়, তা ভেবে হয়তো তখন প্রমাদ গুনছিলেন ওয়েলসের ভক্তরা।

বেল ততক্ষণে বাঁ দিক ছেড়ে রাইট উইং থেকে খেলা শুরু করেছেন। রাইট উইং কী, বারবার মাঝমাঠের দিকে নেমে নিখুঁত পাসে খেলা গড়েও দিচ্ছিলেন। এমনই এক অসাধারণ থ্রু খুঁজে নেয় দৌড়ে তুরস্কের বক্সে ঢুকতে থাকা রামসিকে। কিন্তু সামনে শুধু গোলকিপারকে একা পেয়েও রামসি শট মারলেন বার উঁচিয়ে!

২৯ মিনিটে আবার তুরস্কের গোল হতে হতে হলো না! বাঁ দিক থেকে উন্দেরের ক্রস এল বক্সে, সেটিতে মাথা ছোঁয়ালেন তুরস্কের ডিফেন্ডার আয়হান। কিন্তু বল যখন গোললাইন করবে করবে অবস্থা, ওয়েলসের মোরেল এসে বলটাকে দূরে পাঠিয়ে দেন। ৩৭ মিনিটে আবার ইলমাজ শট মারলেন বার উঁচিয়ে।

এমন আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণের ম্যাচে যখন গোলহীন প্রথমার্ধ দেখার শঙ্কা, তখনই এল গোল! তৃতীয়বারে এসে ভাগ্যের দেখা পেলেন রামসি। এবারও উৎসে বেলেরই চোখধাঁধানো পাস! মাঝমাঠের একটু ওপর থেকে বেলের নিখুঁত লম্বা পাস, ওদিকে তুরস্ক বক্সের বাইরে থেকে দৌড়ে বক্সের ভেতরে ঢুকছিলেন রামসি। পাসটা এমন নিখুঁত হলো যে, রামসি অফসাইডের ফাঁদ এড়িয়ে বক্সে যেখানে গেলেন, বলটাও সেখানেই পড়ল।

গোলকিপারকে ফাঁকি দিয়ে জালে জড়াচ্ছে রামসির শট।
ছবি: রয়টার্স

রামসির সামনে শুধু তুরস্কের গোলকিপার, আশপাশে বাধা দেওয়ার মতো তুরস্কের কোনো ডিফেন্ডার নেই। বুক দিয়ে বলটাকে দারুণভাবে নিয়ন্ত্রণে এনে তুরস্কের গোলকিপার চাকিরের নাগালের বাইরে দিয়ে বল জালে পাঠিয়ে দেন রামসি।

দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই দুটি বদল আনে তুরস্ক। আগের ম্যাচে আত্মঘাতী গোল করা ডিফেন্ডার মেরিহ দেমিরালকে এ ম্যাচে একাদশে রাখেননি তুরস্কের কোচ, জুভেন্টাসে খেলা ডিফেন্ডারকে বিরতির পরই মাঠে নামান। তাতে আয়হান রক্ষণ থেকে উঠে গেলেন মাঝমাঠে। ওদিকে মাঝমাঠে ওজান তুফানের বদলে নামান ইউসুফ ইয়াজিচিকে।

৫৪ মিনিটে সেটির সুফল প্রায় পেয়েই গিয়েছিল তুরস্ক। ওয়েলস বক্সে আয়হান দারুণভাবে বল নামিয়ে দিলেন ইলমাজের দিকে, কিন্তু কয়েক গজ দূর থেকে ইলমাজের ভলি চলে গেল পোস্টের ওপর দিয়ে।

বুরাক ইলমাজ অনেক চেষ্টা করেও তুরস্ককে গোল এনে দিতে পারেননি।
ছবি: রয়টার্স

তার চার মিনিট পর আবার ওয়েলসের সুযোগ। ডানদিক থেকে রবার্টসের কাটব্যাক ধরে শট নিয়েছিলেন রামসি। কিন্তু শটটা এক ডিফেন্ডারের গায়ে লেগে সোজা চলে যায় তুরস্কের গোলকিপারের হাতে।

আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে আবার জমে ওঠার ইঙ্গিত দিতে থাকা ম্যাচে এরপর নাটকীয় মোচড় ৬০ মিনিটে। তুরস্ক বক্সের ঠিক বাঁ দিকের রেখার ওপর বেলকে ফাউল করেন তুরস্কের ডিফেন্ডার সেলিক। ব্যস, পেনাল্টির বাঁশি। ভিএআরও দেখে নিশ্চিত করল, ফাউলটা দাগের ওপরই হয়েছে। ওয়েলস সমর্থকদের উল্লাস তখনই শুরু হয়ে গিয়েছিল। হয়তো ধরে নিয়েছিলেন, বেল যেহেতু পেনাল্টি নিচ্ছেন, গোল তো অবধারিত!

কিন্তু ম্যাচের নাটকের চিত্রনাট্যে অন্য কিছু লেখা ছিল। গোলটা পেলে ওয়েলস তখনই অনেকটা নির্ভার হয়ে যায়। জিতলে দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠা অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যাবে, এই তথ্যও তখন হয়তো জপছিলেন ওয়েলশ সমর্থকেরা। কিন্তু পেনাল্টি নিতে এসে বেল কী করলেন! তাঁর শট চলে গেল বার উঁচিয়ে‍! যেন ওয়েলশ রাগবি দলে খেলার যোগ্যতার প্রদর্শনী করলেন বেল!

ওয়েলসের দ্বিতীয় গোলের পর উচ্ছ্বাস গোলদাতা রবার্টসের (১৪ নম্বর জার্সি)।
ছবি: রয়টার্স

তার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই অবশ্য প্রায়শ্চিত্য প্রায় করেই ফেলেছিলেন বেল। পেনাল্টি মিসের পর গোলকিক থেকে তুরস্ক খেলা শুরু করতেই বলের দখল নেওয়ার জন্য বেলের নেতৃত্বে তুরস্কের রক্ষণকে দারুণভাবে চেপে ধরে ওয়েলস। ফলও মিলল।

দুই-তিন পাসের পর বল যখন আবার তুরস্কের গোলকিপার চাকিরের পায়ে গেল, বেল তাঁর দিকে ছুটছেন। উপায়ান্তর না দেখে চাকির উড়িয়ে মারতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বেলও ওদিক থেকে পা বাড়িয়ে দিলেন। চাকিরের স্বস্তি, বেলের পায়ে বল লেগে পেছনের দিকে গেলেও একটুর জন্য পোস্টের বাইরে দিয়ে চলে যায় বলটা!

এরপর ম্যাচে অবশ্য কিছুক্ষণের ঝিমুনি আসে। জেগে ওঠা একেবারে শেষ মুহূর্তে। তুরস্ক তখন অনুভব করছে, হারলেই বিদায় প্রায় নিশ্চিত। ওয়েলস ওদিকে হিসেব কষছে, আজ জয় না পেলে গ্রুপের শেষ ম্যাচে খেলতে হবে ইতালির মাঠে, তখন দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়া অনিশ্চিত হয়ে যাবে।

৮৭ মিনিটে তুরস্কই দারুণ একটা সুযোগ পেয়েছিল সমতায় ফেরার। কর্নার থেকে হাকান চালহানলুর ক্রস আসে বক্সে, দেমিরাল তাতে হেড করেন। কিন্তু দারুণ দক্ষতায় তাঁর হেড ফিরিয়ে দেন ওয়েলশ গোলকিপার ওয়ার্ড।

ম্যাচ শেষে স্বস্তি আর আনন্দের ছাপ বেলের চোখেমুখে।
ছবি: রয়টার্স

আবার তখন আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণের খেলা শুরু। ৮৮ মিনিটে ওয়েলস দারুণ পাল্টা আক্রমণে উঠলেও ড্যানিয়েল জেমসের শেষ পাসটা ঠিকঠাক হয়নি। ৯০ মিনিটে তুরস্কের ইলমাজ শট নেওয়ার আগেই কোনো রকমে হেড করে বল সরিয়ে দেন ওয়েলশ ডিফেন্ডার রোডন।

যোগ করা চার মিনিট সময়ে তখন টানটান উত্তেজনা। কে পাবে গোল? কেউ কি পাবে? তুরস্ক ড্র করবে, নাকি ওয়েলশ এগিয়ে থাকার ব্যবধানটা ধরে রাখবে?

এত যখন প্রশ্ন, যোগ করা চার মিনিট সময়ের চতুর্থ মিনিটে কর্নার পেল ওয়েলস। ছোট কর্নার থেকে বল গেল বেলের পায়ে। রিয়াল উইঙ্গার সময় নষ্ট করলেও সেটা মেনে নিতেন সবাই, কিন্তু বেলের সম্ভবত তখনো পেনাল্টি মিসের দুঃখ যায়নি!

দুই ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে বক্সের ভেতরে ঢুকে গেলেন বেল, এরপর পাস বাড়ালেন তুরস্কের পোস্টের পাঁচ-ছয় গজ দূরে দাঁড়ানো কনর রবার্টসের দিকে। পা বাড়িয়ে শুধু বলটা জালে পাঠাতে অসুবিধা হলো না রবার্টসের।

রবার্টস উচ্ছ্বাসে ভাসলেন। ওয়েলস জয়োল্লাসে মাতল। আর বেল বুঝি-বা আনন্দের পাশাপাশি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন!