পেলে না ম্যারাডোনা—এখানেই শেষ?

শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে দুজনের লড়াই চলেছে সারা জীবন। তবে সেই বিতর্ক দূরে সরিয়ে রেখে শেষ দিকে বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন ম্যারাডোনা ও পেলেছবি: এএফপি

পেলের কথাটা মন ছুঁয়ে যায়, কিন্তু ফুটবলপ্রেমী যেকেউই চাইবেন দিনটা তাড়াতাড়ি না আসুক। ‘বন্ধু’ ম্যারাডোনাকে শেষযাত্রায় ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছেন, কোনো একদিন একসঙ্গে স্বর্গে ফুটবল খেলবেন।

সে দিনটা যত দেরিতে আসে, ততই ভালো।

মাঠে দুই প্রজন্মের দুজন এখন দুই লোকের বাসিন্দা। ডিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনা নামের সহজ-সরল ধাঁধা তো সব আবেগের ঊর্ধ্বে, অন্যলোকে চলে গেলেন চার দিন হলো। পেলের সুস্থ-সবল বিচরণ এখানে আরও অনেক দিন থাকুক—এ-ই প্রার্থনা।

ম্যারাডোনা না পেলে—বিতর্কটাও না হয় পেলের মধ্য দিয়েই প্রাণ পেল! ম্যারাডোনার আর নিজ থেকে সেখানে বলার কিছু থাকল না, এ-ই যা!

পেলের সঙ্গে আড্ডার মেজাজে ম্যারাডোনা। শত্রু তুমি বন্ধু তুমি?
ছবি: টুইটার

সেরার তর্কে গত এক যুগে ‘মেসি না রোনালদো’ বিতর্কটার চর্চা এত বেশি হয়েছে যে পেলে-ম্যারাডোনা বিতর্ক হালে চলে গেছে আড়ালে। কিন্তু এই শতাব্দীর আগে ফুটবলে তো ওই একটাই বিতর্ক ছিল। কে সেরা —পেলে না ম্যারাডোনা?

মেসি-রোনালদোর চেয়ে একটা জায়গায় অবশ্য দুজন আলাদা হয়ে থেকেছেন সব সময়। কোনো ফুটবলারের আজন্মলালিত স্বপ্ন বিশ্বকাপ ছোঁয়া পেয়েছে দুজনেরই। তা বিশ্বকাপ জেতার গৌরবও তো এ পর্যন্ত ৪৪৫ জন ফুটবলারের জীবন রাঙিয়েছে, কিন্তু পেলে-ম্যারাডোনার মতো করে বিশ্বকাপে অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন কজন?

পেলের তিন বিশ্বকাপ জয়ের কীর্তি আর কারও কখনো ছোঁয়া হবে কি না সংশয় আছে। আর ম্যারাডোনা? তাঁর মতো করে একা হাতে, এত আলোচনায়-বিতর্কে থেকে, মুগ্ধতা ছড়িয়ে বিশ্বকাপ জেতার সৌভাগ্য আর সম্ভবত কারও হবে না।

১৯৬২ বিশ্বকাপের গারিঞ্চার কথা আসতে পারে তুলনায়, দ্বিতীয় ম্যাচেই চোট পেয়ে পেলে টুর্নামেন্টের বাইরে চলে যাওয়ার পর ব্রাজিলকে শিরোপার দিকে উড়িয়ে নিয়ে গেছেন ‘লিটল বার্ড’।

কিন্তু গারিঞ্চার ড্রিবলিং চোখ ধাঁধাতে পারে, ‘পেলে না গারিঞ্চা’ তুলনায় তাঁকে ব্রাজিলিয়ানদের মনের আরও গভীরে ঠাঁই এনে দিতে পারে...কিন্তু ম্যারাডোনার মতো প্রায় অচেনা সতীর্থদের নিয়ে বিশ্বমঞ্চ রাঙানোর সুযোগ গারিঞ্চারও হয়নি।

পেলের কপালে চুমু খাচ্ছেন ম্যারাডোনা। ভক্তরা দুজনকে নিয়ে তর্কে মাতলেও বন্ধুত্ব ছিল তাঁদের
ছবি: টুইটার

হ্যাঁ, মেসি-রোনালদোর মতো দুজন একই সময়ে খেলেননি বলে, কখনো মুখোমুখি হননি বলে পেলে-ম্যারাডোনার সরাসরি তুলনা কখনো হয়নি। কিন্তু মেসি-রোনালদোর মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ফুটবলেই আবার কখনো দেখতে হয়তো অনেক দিন অপেক্ষা করতে হবে।

একই প্রজন্মের সেরা দুই ফুটবলার, তর্ক সাপেক্ষে বিশ্বের সেরা কিন্তু চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই ক্লাবে এতগুলো বছর খেলে গেছেন...এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা কমই। কিন্তু পেলে-ম্যারাডোনারও তুলনায় কমতি ছিল কি?

দুজন ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা—দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশের, দুজনের কাছে ব্রাজিলের হলুদ আর আর্জেন্টিনার আকাশি-সাদায় ‘১০’ নম্বর জার্সিটার আজীবনের কৃতজ্ঞতা, নিজ দেশকে বিশ্বমঞ্চে শ্রেষ্ঠত্ব এনে দিয়েছেন দুজনই...‘পেলে বনাম ম্যারাডোনা’র আকর্ষণ অনন্য!

শুধু বাংলাদেশের কথাই ভাবুন না, ইন্টারনেট-ডিশ টিভি নেটওয়ার্কের কল্যাণে মেসি-নেইমারদের খেলা এখন রাত জেগে দেখা তরুণের সংখ্যা অগুনতি, কিন্তু বছর বিশেক পেছনে ফিরে যান—আন্তর্জাতিক ফুটবল বলতে এ বদ্বীপের তিন কোণে যখন বিশ্বকাপটাই শুধু আলোড়ন ফেলত, সে সময়টায় ব্রাজিল বলতে তো পেলেই ছিলেন, আর্জেন্টিনা মানে ম্যারাডোনা।

পেলের জন্য ‘কালো মানিক’ নামে একটা বইয়ের চ্যাপ্টারই ছিল প্রাথমিক বিভাগে, চিরকালই বইয়ে বাঁধা নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলা ম্যারাডোনার ঠাঁই বই-টইয়ে না হোক, ছিয়াশি বিশ্বকাপ দিয়ে মানুষের মনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত তাঁর।

দুজনের তুলনা তাই না চাইলেও এসে পড়ে। শুধু বাংলাদেশেই কেন, বিশ্বজুড়েই তুলনাটা শিরোনাম হয়েছে বারবার। কিন্তু কে এগিয়ে সেই তুলনায়—প্রশ্নটার মীমাংসা কি তাতে হয়েছে? কখনো কি হবে?

শেষ কয়েক বছরে অবশ্য অন্য যেকারও তুলনায় নিজেরাই বিতর্কটাকে জাগিয়ে তুলেছেন বেশি। সেই আশির দশকে বিতর্কটা শুরু হওয়ার পর থেকেই কতশতবার যে একে অন্যকে খুঁচিয়ে গেছেন, সে হিসাব করতে গেলে ইতিহাসবেত্তা হতে হয়।

কখনোই মুখে লাগাম না–টানা ম্যারাডোনা কখনো ‘পেলের জাদুঘরে যাওয়ার সময় হয়েছে’ বলে খ্যাপানোর চেষ্টা করেছেন, তো নিজের আত্মজীবনীতেই পেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন—পেলে কেন তাঁকে ১৯৬২ বিশ্বকাপ এনে দেওয়া গারিঞ্চাকে এভাবে ধুঁকে ধুঁকে দারিদ্র্যে মরতে দিলেন!

আজীবন নিজেকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা পেলে এভাবে কাঁদা–ছোড়াছুড়িতে যাননি, বিতর্কে তাঁর পাল্টা জবাবগুলো মূলত সীমাবদ্ধ ছিল খেলোয়াড় ম্যারাডোনার খামতি আর তাঁর পূর্ণতার আলোচনায়।

তবে একটা জায়গায় দুজনের বেশ মিল—নিজেকে সেরা বলায় কখনো ছাড় দেননি কেউই! ম্যারাডোনা তো যুক্তির তর্কে মায়ের আবেগও টেনে এনেছেন। বলেছিলেন, ‘আমার মা বলেছে, আমিই সেরা, আর আমি আমার মায়ের কথা সব সময় বিশ্বাস করি।’ যুক্তি বটে!

সেরার বিতর্কে যে কোনো যুক্তিই অবশ্য কতটা ধোপে টেকে, সে এক প্রশ্ন বটে। পেলের শ্রেষ্ঠত্বের প্রশ্নে সংখ্যা তুলে ধরবেন তো ম্যারাডোনার হয়ে গান গাইবে নাপোলি আর আর্জেন্টিনায় মাঝারি মানের দল নিয়েও তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের কীর্তি।

ম্যারাডোনার ড্রিবলিং, খেলা গড়ে দেওয়ার ক্ষমতা, প্রতিপক্ষের তিন-চার খেলোয়াড়কে কাটিয়ে গোল দেওয়ার ক্ষমতা তাঁকে এগিয়ে রাখলে, পেলেকে সামনে টেনে নিয়ে যাবে তাঁর গোল করার আশ্চর্য দক্ষতা আর মুহূর্তের ভগ্নাংশে সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রতিপক্ষকে চমকে দেওয়ার ক্ষমতা।

শুধু সংখ্যায় হিসাব করলে তো ম্যারাডোনা তুলনায়ই আসবেন না! ম্যারাডোনার একটি বিশ্বকাপের বদলে পেলের তিন বিশ্বকাপ জয়ের কীর্তি তো আছেই, শুধু গোলের হিসাবেও ম্যারাডোনার চেয়ে প্রায় এক হাজার গোল এগিয়ে পেলে!

ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তির দাবি, তাঁর ক্যারিয়ারে গোল ১ হাজার ২৮১টি, যেটির জন্য গিনেস রেকর্ড বুকের স্বীকৃতিও পেয়েছেন। আর ম্যারাডোনার ক্যারিয়ারে গোল?

২৯৩টি! যদিও পেলের এত গোলের ৭৬৯টি স্বীকৃত ম্যাচে। ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তির অত গোল নিয়েও খোঁচা মারতে কখনো ছাড়েননি ম্যারাডোনা।

পেলের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর কৌতুকের সুরে আর্জেন্টাইন কিংবদন্তির প্রশ্ন ছিল, ‘অত গোল কার বিপক্ষে করেছিলেন? বাড়ির উঠানে ভাতিজার বিপক্ষে?’

মাঠের তুলনাটা মাঠের বাইরে নিয়ে যান। পেলের নিদাগ চরিত্র তাঁকে এগিয়ে রাখে। কিন্তু ম্যারাডোনার বিতর্ক আর সমালোচনায় ভরা জীবনটাই শেষ দিনটা পর্যন্ত তাঁকে মানুষের কাছে আরও আপন করে রাখেনি, তা কে বলবে? এমনি এমনি তো তাঁকে ‘দ্য মোস্ট হিউম্যান অব গডস’ বলা হয় না!

দিন শেষে তুলনাটা তাই অর্থহীনই। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে তুলনা সম্ভবত কখনো সম্ভবও হবে না। পেলে আর ম্যারাডোনা তাই দিন শেষে নিজ নিজ সমর্থকদের চোখে অন্য রকম এক সম্মোহনের নাম।

পেলে বললে হয়তো মনে পড়বে ১৯৭০ বিশ্বকাপে তাঁর চোখধাঁধানো মিসের কথা। উরুগুয়ের বিপক্ষে ম্যাচে টোস্টাওয়ের থ্রু ধরতে গিয়ে গোলকিপারকে হতবুদ্ধি বানানো সেই সৃষ্টিশীলতা, চাতুর্যই যে পেলে! আর ম্যারাডোনা?

তাঁর মৃত্যুর পর সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ভাইরাল হওয়া ভিডিওটাই মনে করাবে আর্জেন্টাইন কিংবদন্তিকে। ১৯৮৯ উয়েফা কাপের সেমিফাইনালে বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে ম্যাচের আগে গা গরমের সময়ে গানের তালে নাচতে নাচতে বল নিয়ে কারিকুরি করা, তা-ও পুরোটা সময়ে জুতোর ফিতে খোলা থাকা অবস্থাতেই…ম্যারাডোনা তো এমনই খেয়ালি জাদুকর! এই সম্মোহনটাই থাকুক না! তুলনায় যেতেই হবে, এমন দিব্যি কে দিয়েছে!

এখন তো বিতর্কটাতে পেলেকে ম্যারাডোনার খোঁচানোর উপায়ও আর থাকল না। পেলেরও কি এখন আর বিতর্কটা ভালো লাগবে?