প্রতিপক্ষ ভালো বুঝলেই হাল ছেড়ে দেন মেসি

আরেকবার চ্যাম্পিয়নস লিগে ব্যর্থ মেসি।ছবি: রয়টার্স

দল নিশ্চিত হারের মুখে পড়েছে—এই অবস্থায় লিওনেল মেসির কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ার ছবি কম দেখা যায়নি। আগে ছবিটা দেখা যেত আর্জেন্টিনার জার্সিতে। ২০১৪ বিশ্বকাপে ১১৩ মিনিটে জার্মানি গোল করার পর কিংবা ম্যাচ শেষের কিছুক্ষণ আগে তাঁর ফ্রি-কিক বারের ওপর দিয়ে চলে যাওয়ার পর মেসিকে এমন ভঙ্গিতে দেখা গেছে।

কয়েক বছর ধরে বার্সেলোনার জার্সিতেও নিয়মিত হয়ে উঠেছে ছবিটা, বিশেষ করে চ্যাম্পিয়নস লিগে দল হারের মুখে পড়ার পর। যা মেসির নেতৃত্বগুণ নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। ১৯৯০ বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলা আর্জেন্টিনা দলের ফরোয়ার্ড ক্লদিও কানিজিয়া অবশ্য বলছেন অন্য কথা। নিশ্চিত হার নয়, প্রতিপক্ষ নিজের দল থেকে ভালো বুঝতে পারলেই নাকি হাল ছেড়ে দেন মেসি!  

গত মৌসুমে লিসবনে কোয়ার্টার ফাইনালে বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে দল একের পর এক গোল খাওয়ার পর মেসির শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকা কিংবা কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার ছবি নজরে পড়েছে সর্বশেষবার। তার আগের মৌসুমে সেমিফাইনালে ০-৩ গোলে পিছিয়ে দ্বিতীয় লেগ শুরু করা লিভারপুল ৪-৩ গোলে এগিয়ে যাওয়ার পর কিংবা তারও আগের মৌসুমে কোয়ার্টার ফাইনালে প্রথম লেগে ক্যাম্প ন্যু-তে ৪-১ গোলে হেরে যাওয়া রোমা নিজেদের মাঠে ৩-০ গোলে এগিয়ে যাওয়ার পর মেসিকে হতাশ হতে দেখা গেছে।

‘রোনালদো না মেসি’ এই বিতর্কটাতে মেসিকে এই জায়গাতেই অনেকে পিছিয়ে রাখেন। দল পিছিয়ে পড়লে গোল করতে পারুন আর না পারুন, রোনালদোকে যতটা তৎপর হতে দেখা যায়, মেসিকে দেখা যায় উল্টো। হয়তো নিজের মতো করে দলকে ফেরানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু দল গোল খেলে, নিশ্চিত হারের মুখে পড়লে মেসির ওই ছবিগুলো বার্সা বা আর্জেন্টিনা সমর্থকদের চোখে লাগারই কথা।

ফুটবলে মেসি কী করেছেন, সেটি ইতিহাস সব সময়ই বলবে। বার্সেলোনার জার্সিতে এখন পর্যন্ত ৬৩৪ গোল, আর্জেন্টিনার জার্সিতে ৭০টি। বার্সেলোনার হয়ে হেন কোনো শিরোপা জেতা বাকি নেই। রেকর্ড ছয়বার বর্ষসেরা ফুটবলারও হয়েছেন। কিন্তু আর্জেন্টিনার জার্সিতে মেসি রিক্ত। এক ২০০৫ যুব বিশ্বকাপ আর ২০০৮ অলিম্পিক বাদ দিলে আর্জেন্টিনার হয়ে কিছু জিতেননি। আলবিসেলেস্তেদের সিনিয়র দলে তাঁর অর্জন বলতে ২০১৪ বিশ্বকাপ আর ২০০৭, ২০১৫ ও ২০১৬ কোপা আমেরিকার ফাইনালে খেলা। তাঁকে ঘিরে আশা বেশি ছিল বলেই হয়তো কিছু না জেতায় আর্জেন্টিনায় মেসির সমালোচনাও হয় বেশি।

বেলা গড়াতে গড়াতে এখন মেসির বয়স ৩৩, আর্জেন্টিনার হয়ে আর কিছু জেতার সুযোগ বলতে আগামী বছরে আর্জেন্টিনা-কলম্বিয়ায় হতে যাওয়া কোপা আমেরিকায় একটা সুযোগ পাবেন। তারপরের বছর কাতারে বিশ্বকাপও আছে। কিন্তু কানিজিয়ার মেসির নেতৃত্বগুণে বিশ্বাস নেই। আর্জেন্টাইন চ্যানেল কানাল ২৬-এ মেসিকে নিয়ে কানিজিয়ার বিশ্লেষণ, ‘সম্ভবত মেসির নেতৃত্বগুণ তেমন নেই। যদি ওর দল অপেক্ষাকৃত ভালো না হয়, ও গুটিয়ে যায়।’

১৯৯০ বিশ্বকাপে ইতালির ফ্রাঙ্কো বারেসির সঙ্গে বলের দখলে কানিজিয়া (বাঁ থেকে দ্বিতীয়)।
ছবি: ফিফাডটকম

মেসির চরিত্রের অন্য গুণ, মাঠে সবকিছু দিয়ে দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে সংশয় না থাকলেও শুধু এই একটা জায়গাতেই সমস্যা দেখেন কানিজিয়া, ‘ও পুরো দলের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে নেয়। এটা পরিষ্কার যে ওর চরিত্রটাই এ রকম। জানি না (বার্সায়) কী হয়েছে, কিন্তু আমি যেটা ওর ব্যাপারে বলি সেটা হলো, ও যখন দেখে ওর দল প্রতিপক্ষের চেয়ে ভালো নয়, ওর খেলার ছন্দ নষ্ট হয়ে যায়। ও মাঠে গিয়ে যখন দেখে ওর দল অপেক্ষাকৃত ভালো নয়, জেতা সহজ হবে না, ওর সেটা ভালো লাগে না। বিরুদ্ধ অবস্থায় ও ভালো করতে পারে না।’

কানিজিয়া কথা বলেছেন মেসির বার্সা ছাড়তে চাওয়া ও শেষ পর্যন্ত থেকে যেতে হওয়ার উত্তেজনার সময়টা নিয়েও। গত ২৫ আগস্ট ক্লাবকে এক বুরোফ্যাক্স পাঠিয়ে মেসি জানিয়ে দেন, তিনি ক্লাব ছাড়তে চান। মেসি চাইলে যে কোনো মৌসুমের শেষে মুফতে ক্লাব ছাড়তে পারবেন—চুক্তির এই শর্ত দেখিয়েই ক্লাব ছাড়তে চান মেসি। কিন্তু বার্সা তাঁকে যেতে দেয়নি। যেতে হলে শেষ পর্যন্ত ক্লাবকে আদালতে নিতে হতো মেসিকে। কিন্তু যে ক্লাব ১৩ বছর বয়স থেকে তাঁর ঘর, যে ক্লাব তাঁর ছোটবেলায় হরমোনজনিত সমস্যার চিকিৎসা করিয়ে তাঁকে আজকের মেসি হতে সাহায্য করেছে, সেই বার্সেলোনাকে আদালতে নিতে চাননি জানিয়ে শেষ পর্যন্ত মেসি জানিয়ে দেন, তিনি চুক্তির এই শেষ মৌসুমটা বার্সাতেই থাকবেন।

এই পুরো ঘটনাক্রম দেখে কানিজিয়ার উপলব্ধি, ‘মেসিকে ভুল পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ওরা (মেসির আইনজীবীরা) ওকে বুঝিয়েছে ও চাইলে মুফতে ক্লাব ছাড়তে পারবে। শুরু থেকেই এটা স্পষ্ট ছিল যে ও বার্সা ছাড়তে পারবে না।’

মেসির বিরক্তিটা তো আর ক্লাবের ওপর নয়, জোসেপ মারিয়া বার্তোমেউর অধীন ক্লাবের বোর্ডের ওপর। ক্লাব ছাড়তে না পেরে তাই মেসি ঘোষণা দিয়েছেন, ক্লাবে থাকবেন এবং বার্সার জার্সিটার সম্মান রাখার জন্য মাঠে আগের মতোই সবকিছুই করবেন। নতুন কোচ রোনাল্ড কোমানের অধীনে এরই মধ্যে অনুশীলনে নেমেছেন, তিনটি প্রাক-মৌসুম প্রস্তুতি ম্যাচও খেলেছেন। আগামী রোববার বাংলাদেশ সময় রাত ১টায় মেসির বার্সা মৌসুমের প্রথম ম্যাচে নামবে ভিয়ারিয়ালের বিপক্ষে।