ফিরে আসার রেকর্ড গড়েই গার্দিওলার অপেক্ষা বাড়াল ইউনাইটেড

ইউনাইটেডের তৃতীয় গোলের পর কাভানির উদ্‌যাপন।ছবি: রয়টার্স

যেন টেনিসের কোনো গ্র্যান্ড স্লাম ফাইনালের ‘ম্যাচ পয়েন্টের’ মতো। নিজেদের পক্ষে গেলেই সেট, ম্যাচ আর ট্রফি ম্যানচেস্টার সিটির, কিন্তু আসি-আসি করেও যেন সেটি আসছে না পেপ গার্দিওলার দলের পক্ষে। তবে গার্দিওলার দলের কপালে ভাঁজ পড়ার কিছু নেই, এ রকম অনেক ম্যাচ পয়েন্ট এখানে তাদের অপেক্ষায়।

গতকাল ভাগ্যটা গার্দিওলার সিটির নিজেদের হাতেই ছিল। চেলসির বিপক্ষে জিতলেই হতো, এক মৌসুম বিরতি দিয়ে আবার প্রিমিয়ার লিগের ট্রফি জেতা হয়ে যেত সিটির। সেটিও তিন ম্যাচ হাতে রেখে। কিন্তু নিজেদের মাঠে এগিয়ে গিয়েও চেলসির কাছে ২-১ গোলে হেরে যায় সিটি।

এরপর আজ আবার শিরোপা নিশ্চিত করে ফেলার উপলক্ষ এসেছিল সিটির জন্য, তবে এবার তাদের কিছু করতে হতো না। আগুয়েরো-স্টার্লিংরা বাড়িতে বসেই তিন ম্যাচ হাতে রেখেই শিরোপা জয় উদযাপন করতে পারতেন, যদি লিগের পয়েন্ট তালিকার দুই নম্বরে থাকা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড আজ হেরে যেত অ্যাস্টন ভিলার মাঠে।

কিন্তু নগর প্রতিদ্বন্দ্বীদের এত সহজে উদযাপনের উপলক্ষ ইউনাইটেডই করে দেবে, তা হয়! হতে দিলেন না ব্রুনো ফার্নান্দেজ, পল পগবা, এদিনসন কাভানিরা। পিছিয়ে পড়েও ভিলার মাঠে আজ ৩-১ গোলে জিতেছে ইউনাইটেড।

এ জয়ে একটা রেকর্ডও হয়েছে ইউনাইটেডের। প্রিমিয়ার লিগে এই মৌসুমে এ নিয়ে ১০ ম্যাচে প্রথমে গোল খেয়েও ফিরে এসে ম্যাচ জিতেছে ইউনাইটেড, লিগের ইতিহাসে আর কোনো দল এক মৌসুমে এত বেশি ম্যাচে ফিরে এসে জিততে পারেনি।

আর এ রেকর্ড গড়ে সিটির শিরোপা উদ্‌যাপন তো পিছিয়ে দিয়েছেই, উলে গুনার সুলশারের ইউনাইটেড লিগের সেরা চারে থেকে নিজেদের আগামী মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলাও প্রায় নিশ্চিত করে ফেলেছে।

প্রায় শব্দটা না লিখলেও হতো, কিন্তু অঙ্কের হিসাবের মারপ্যাঁচকে সম্মান দেখিয়ে লিখতে হচ্ছে। আজ জয়ের পর ৩৪ ম্যাচে ৭০ পয়েন্ট হলো দুই নম্বরে থাকা ইউনাইটেডের। পাঁচ নম্বরে থাকা ওয়েস্ট হামের পয়েন্ট ৩৪ ম্যাচে ৫৮। ইউনাইটেড নিজেদের বাকি সব ম্যাচে হেরে গেলে, আর ওয়েস্ট হামের পাশাপাশি তিন ও চার নম্বরে থাকা চেলসি আর লেস্টার সিটিও নিজেদের বাকি সব ম্যাচে জিতে গেলেও ইউনাইটেডের পাঁচ নম্বরে নেমে যাওয়ার সম্ভাবনা কম।

পেনাল্টি থেকে ইউনাইটেডের প্রথম গোল করেন ফার্নান্দেজ।
ছবি: রয়টার্স

দুই দলের পয়েন্ট সমান হয়ে গেলে প্রিমিয়ার লিগে প্রথমে বিবেচিত হয় দল দুটির গোলব্যবধান, সেখানে এই মুহূর্তে ইউনাইটেড যোজন ব্যবধানে এগিয়ে। তাদের গোল ব্যবধান ৩১, পাঁচে থাকা ওয়েস্ট হামের ১১! হ্যামার্সের বাকি চার ম্যাচে জয়ের পাশাপাশি ইউনাইটেড সব ম্যাচ হারবে, তা-ও ২০ গোলের ব্যবধান ঘুচিয়ে দেওয়া হার...এতটা ভাবা বাড়াবাড়িই। অবশ্য অত হিসাবের জটিলতাও লাগবে না, আজ বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ৯টায় এভারটনের মুখোমুখি হচ্ছে ওয়েস্ট হাম, সেখানে এভারটন জিতে গেলেই চ্যাম্পিয়নস লিগ নিশ্চিত হয়ে যাবে ইউনাইটেডের।

অ্যাস্টন ভিলার মাঠে আজ বিরতিতে অবশ্য ইউনাইটেডের চ্যাম্পিয়নস লিগ নিশ্চিত করা বিলম্বিত হচ্ছে বলেই মনে হচ্ছিল। সে সময় যে ১-০ গোলে এগিয়ে ছিল ভিলাই! ২৪ মিনিটে দুরূহ কোণ থেকে ব্রাট্রান্ড ট্রায়োরের দারুণ ফিনিশিংয়ে এগিয়ে যায় ভিলা। প্রথমার্ধে প্রতিপক্ষের বক্সের আশপাশে কিছুটা ধারহীন ইউনাইটেডের দ্বিতীয়ার্ধে ফিরে আসার ব্যাপারে অবশ্য রেকর্ড সাহস জোগাচ্ছিল।

আজকের আগে প্রিমিয়ার লিগে এই মৌসুমে প্রতিপক্ষের মাঠে ৯ বার প্রথমে গোল খেয়েছিল ইউনাইটেড, কোনোবারই হারেনি। ৮টিতে জিতেছে, ১টি ড্র।

প্রতিপক্ষের মাঠে হারের মুখ থেকে ফিরে আসার রেকর্ডটাকে ‘১০’-এ উঠিয়ে নেওয়ার পথে প্রথম বড় অবদান পল পগবার। গোলের খোঁজে ৫১ মিনিটে ভিলার বক্সে উঠে গেলেন ফরাসি মিডফিল্ডার, তাঁকে আটকাতে গিয়ে বক্সের মধ্যে ফেলেই দেন দুই মৌসুম আগেও সিটিতে খেলা ভিলার ব্রাজিলিয়ান মিডফিল্ডার দগলাস লুইজ। পেনাল্টি পায় ইউনাইটেড, আর ইউনাইটেড পেনাল্টি পেলে কী হয় তা তো জানাই!

ইউনাইটেডের দ্বিতীয় গোল করে গ্রিনউডের উল্লাস।
ছবি: রয়টার্স

ঠান্ডা মাথায় গোল করে ম্যাচে সমতা ফেরান ব্রুনো ফার্নান্দেজ। তাঁরও হলো একটা রেকর্ড ছোঁয়া! মৌসুমে সব টুর্নামেন্ট মিলিয়ে এ নিয়ে ২৭ গোল হলো ইউনাইটেডের পর্তুগিজ মিডফিল্ডারের, প্রিমিয়ার লিগের কোনো ক্লাবের মিডফিল্ডারের মৌসুমে এত গোল করার রেকর্ড দেখতে পিছিয়ে যেতে হবে ২০০৯-১০ মৌসুমে, সেবার ২৭ গোল করেছিলেন চেলসির ফ্র্যাঙ্ক ল্যাম্পার্ড।

ফার্নান্দেজের গোলে প্রাণ ফিরে পায় ইউনাইটেড। চার মিনিট পরই আবার গোলের উদযাপন তাদের। এ বেলায় ভিলার ডিফেন্ডার টাইরন মিংস আর গোলকিপার এমিলিয়ানো মার্তিনেজ দায় এড়াতে পারবেন না। ইউনাইটেডের তরুণ স্ট্রাইকার ম্যাসন গ্রিনউডকেও কৃতিত্ব দিতে হবে। বক্সে মিংসের দুর্বল ‘ম্যান মার্কিং’য়ের সুযোগ নিয়ে দারুণ ঘূর্ণিতে তাঁকে এড়িয়ে যান গ্রিনউড। এরপর তাঁর বাঁ পায়ের শট যখন জালে ঢোকে, মার্তিনেজ হয়তো নিজের কাছের পোস্ট আগলে রাখতে না পারায় নিজেকে শাপশাপান্ত করছিলেন।

কিন্তু ইউনাইটেডকে তখন আর পায় কে! ৬৫ মিনিটে গ্রিনউডের বদলি হিসেবে নামেন দারুণ ছন্দে থাকা এদিনসন কাভানি, ২০ মিনিট পর তিনিও গোল করে ছোটখাটো একটা ক্লাব রেকর্ড ছুঁয়েছেন। ডান দিক থেকে ভেসে আসে মার্কাস রাশফোর্ডের দুর্দান্ত এক ক্রস, দারুণ হেডে সেটি জালে জড়ান কাভানি। এই মৌসুমেই পিএসজি থেকে ইউনাইটেডে আসা ৩৪ বছর বয়সী উরুগুইয়ান স্ট্রাইকার তো মূলত বদলি হিসেবেই নামেন, বদলি হিসেবে গোলের রেকর্ডই ছুঁয়েছেন।

কাভানি লিগে বদলি নেমে গোলের ক্লাব রেকর্ড গড়েছেন।
ছবি: রয়টার্স

আজকের গোলটি নিয়ে বদলি হিসেবে এই মৌসুমে লিগে কাভানির গোল হলো ৫টি—ইউনাইটেডে এক মৌসুমে বদলি নেমে কোনো খেলোয়াড়ের সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড এটিই। এর আগে সমান ৫টি করে গোল করেছিলেন হাভিয়ের ‘চিচারিত’ হার্নান্দেজ (২০১০-১১) ও বর্তমান ইউনাইটেড কোচ উলে গুনার সুলশার (১৯৯৮-৯৯)।

অ্যাস্টন ভিলার এমনিতেই তখন আর ম্যাচে ফেরার সুযোগ তেমন ছিল না, ৮৯ মিনিটে ভিলা স্ট্রাইকার ওলি ওয়াটকিনস লাল কার্ড দেখলে সম্ভাবনা কার্যত শেষই হয়ে যায়। ইউনাইটেড বক্সে ‘ডাইভিংয়ের’ অভিযোগে হলুদ কার্ড দেখেন ওয়াটকিনস, যা ম্যাচে তাঁর দ্বিতীয় হলুদ কার্ড। যদিও আসলেই তিনি পড়ে গিয়েছেন, নাকি ইউনাইটেড গোলকিপার ডিন হেন্ডারসনের সঙ্গে মৃদু ধাক্কা লেগেছিল তাঁর, তা নিয়ে বিতর্ক থাকে। ভিএআরও তো সরাসরি লাল কার্ডের বাইরে এসব ব্যাপারে মাথা ঘামায় না, ওয়াটকিনসের উষ্মা প্রকাশেই তাই ঘটনাটার শেষ।

ইউনাইটেডের তাতে কী! নিজেদের চ্যাম্পিয়নস লিগ নিশ্চিত করতে এই ম্যাচে পগবা-ফার্নান্দেজ-রাশফোর্ডদের নিয়ে প্রথম পছন্দের একাদশ নামিয়েছেন ইউনাইটেড কোচ সুলশার, তাঁর উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে। পাশাপাশি সিটির উদযাপনও একটু পিছিয়ে দেওয়া গেল!