ফুটবলের দরজা খোলা থাকুক বিদেশিদের জন্য

বিশ্বকাপ খেলা কলিন্দ্রেস ঢাকার দর্শকদের হৃদয় কেড়েছিলেনছবি: প্রথম আলো

‘আমরা রানার্সআপ হওয়ার দল নই। তাই তোমাদের (সতীর্থ খেলোয়াড়) কাছে অনুরোধ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রানার্সআপ ট্রফি নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করো না। একদিন চ্যাম্পিয়ন হয়েই আমরা ট্রফি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি পোস্ট করব।’ দানিয়েল কলিনদ্রেসের কণ্ঠে ২০১৮ সালের অক্টোবরে ফেডারেশন কাপের ফাইনালে আবাহনীর কাছে হারের কষ্ট এভাবেই ঝরে পড়েছিল। সঙ্গে রানার্সআপ হওয়াটাও যেন তাঁর দলের জন্য ব্যর্থতা, মনে করিয়ে দিয়েছিলেন তাও।

এ মৌসুমে মেসির সঙ্গে খেলা আর্জেন্টাইন ফুটবলার হার্নান বার্কোসকে এনেছিল বসুন্ধরা। কিন্তু দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের দর্শকদের। করোনার কারণে এএফসি কাপের একটি ম্যাচেই বার্কোসের বাংলাদেশ–অধ্যায় শেষ হয়ে গেছে
ছবি: প্রথম আলো

বসুন্ধরা কিংসের জার্সিতে প্রায় দেড় মৌসুম বাংলাদেশের ফুটবলে আলো ছড়িয়ে গত জুলাইয়ে বিদায় নিয়েছেন কোস্টারিকার জার্সিতে ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপ খেলা ফুটবলার কলিনদ্রেস। কিন্তু বিশ্বকাপ খেলা কলিনদ্রেস কিন্তু ঠিকই তাঁর চ্যাম্পিয়ন মানসিকতাটা রেখে গিয়েছেন তাঁর দল বসুন্ধরা কিংসের বাকি খেলোয়াড়দের মধ্যে। সেই তালিকায় আছেন ১৪ জন জাতীয় দলের ফুটবলারও। কলিনদ্রেসের কাছে তাঁর দল পেয়েছে সেরা নৈপুণ্য। স্থানীয় ফুটবলাররা শিখেছেন অনেক। আর মাঠের বাইরে বিপলু আহমেদ, তপু বর্মণ, তৌহিদুল আলমেরা শিখেছেন একজন পেশাদার ফুটবলারের আচরণ কেমন হওয়া উচিত।

কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, কলিনদ্রেসের মতো ফুটবলাররা বাংলাদেশের ক্লাবে খেলার সুযোগ পাবেন আসন্ন নতুন ঘরোয়া মৌসুমে? এখনো পরিষ্কার কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে বাফুফের লিগ কমিটির সঙ্গে গত মঙ্গলবার সভায় উপস্থিত প্রিমিয়ার লিগের ১০টির মধ্যে ৭টি ক্লাবই নতুন মৌসুমটা বিদেশি ছাড়া খেলার প্রস্তাব দিয়েছে। আর এটা কে না জানে, ক্লাবগুলো যা চায় সেটিই হয়। বাফুফের ভূমিকা বরাবরই সাক্ষী গোপালের মতো। নির্বাচন সামনে রেখে ক্লাবকে অখুশি করার পথে যে দেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা হাঁটবে না, তা অনুমান করে নিচ্ছেন অনেকে। তবে একটা জায়গায় সবাই একমত, শেষ পর্যন্ত বিদেশি ছাড়া খেলা হলে জৌলুশ হারাবে ঘরোয়া ফুটবল।

এমনিতেই ঘরোয়া ফুটবলে দর্শক উন্মাদনা হারিয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। অনেকের মুখে আফসোস সেই রুম্মান বিন ওয়ালি সাব্বির, শেখ আসলামদের মতো ফুটবলাররা কোথায়! সেই আজামত রহিমভ, ভিজেন তাহেরিদের মতো বিদেশি ফুটবলাররাই আর আসেন না কেন! এই আফসোস একপাশে সরিয়ে রেখেই এখনো গুটি কয়েক দর্শক গ্যালারির ধুলো মাখা চেয়ার মুছে বসেন। ভালো একটি গোল, একটি পাস, মোহনীয় কোনো আক্রমণ দেখে তাঁরা শিহরিত হন। আগে স্থানীয় ফুটবলারদের পায়েও এসব ঝলক দেখতেন দর্শকেরা। এখন তা দেখার জন্য তাকিয়ে হয় বিদেশি ফুটবলারদের দিকেই। ফুটবলের আসল সৌন্দর্য ও উত্তেজনা যে গোলে, দেশি ফুটবলাররা তা করছেন কমই।

নাইজেরিয়ান সানডে চিজোবা আবাহনীর হয়ে সব সময়ই ছিলেন দুর্দান্ত।
ছবি: প্রথম আলো

স্থানীয় ফুটবলাররা ঘার ঘুড়িয়ে বলতে পারেন, ‘দেশি ভাই হয়ে শুধু বিদেশি ফুটবলারদের প্রশংসা!’ পরিসংখ্যান যে বিদেশিদের পক্ষেই কথা বলছে। পেশাদার লিগ নাম নিয়ে আয়োজিত বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের গত এগারোটি আসরে দশবারই সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার উঠেছে বিদেশি স্ট্রাইকারদের হাতে। অবশ্য বিদেশিদের দাপটে ফরোয়ার্ড লাইনে স্থানীয় ফুটবলারদের অনেকে সুযোগ পাচ্ছেন না এটাও সত্য। এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনাও ছিল।

নিম্নমানের বিদেশি কেন? এই প্রশ্ন কয়েক বছর আগেও জোরালো ছিল দেশের ফুটবলে।

নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকে বড় শরীরের নিম্নমানের আফ্রিকান ফুটবলার আসতে শুরু করেছিল দেশের ফুটবলে। তবে সাম্প্রতিক বছরে সনি নর্দে বা লি টাকের মতো ঝলক দেখানো ফুটবলার ছাড়া কম টাকায় পাওয়া আফ্রিকানরাই ছিল বড় ভরসার নাম। এ দুরবস্থা থেকে হঠাৎ চেহারা ফিরতে শুরু করেছে গেল দুই মৌসুমে। এই সময়ে কয়েকজন বিদেশির দুই পায়ে হয়তো চোখ ধাঁধানো বিশ্ব মানের শিল্পিত রূপ ছিল না, তবে পাওয়া গিয়েছে ফুটবলের সৌন্দর্য। ঘাড়ের ওপর প্রতিপক্ষ দুই ডিফেন্ডারের নিশ্বাসের মধ্যে থেকেও কলিনদ্রেসের নিখুঁত ফিনিশিং, বাইসাইকেল কিকে জাল কাঁপিয়ে দিয়েছেন মার্কোস ভিনিসিয়ুস, কাতারের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে এসে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বসুন্ধরার জার্সিতে মাঠে নেমে দলের আত্ম নিবেদনের স্বাক্ষর রেখেছেন কিরগিজ মিডফিল্ডার বখতিয়ার দুশবেকভ। এরকম উদাহরণ দেওয়া যাবে আরও বেশ কয়েকটি।

ভালো মানের বিদেশিদের সঙ্গে খেললে পরিপক্কতা অর্জনের সুযোগ পান বাংলাদেশি ফুটবলাররা।
ছবি: প্রথম আলো

আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের সাবেক স্ট্রাইকার হার্নান বার্কোসের কথাই ধরুন। লিওনেল মেসির সঙ্গে আর্জেন্টিনা জাতীয় দলে খেলা এই স্ট্রাইকার ৩৫ বছর বয়সেই পা রেখে ঢাকা মাতিয়ে দিয়েছেন। এএফসি কাপের প্রথম ম্যাচেই দলের ৫-১ গোলের জয়ে এক হালি গোল করে বার্কোস বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি মেসির সতীর্থ ছিলেন। এরই মধ্যে তাঁকে হারানোর শঙ্কায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হতাশা প্রকাশ করেছেন অনেকেই। ইতালির গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী বার্কোস কথা বার্তা চালিয়ে নিচ্ছেন দেশটির চতুর্থ বিভাগের এক ক্লাবের সঙ্গে। ডিসেম্বরে বসুন্ধরার সঙ্গে চুক্তি শেষে যে কোনো ক্লাবে যেতেই পারেন, কিন্তু তাঁকে কোনো সাহসে ধরে রাখতে চাইবে বসুন্ধরা?

নতুন মৌসুমে বিদেশি থাকবে কি না সেটিরই তো ঠিক নেই। বার্কোসের বর্তমান বসুন্ধরা উঁচু মানের নতুন দুই ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার দলে ভিড়িয়েও থাকতে হচ্ছে উৎকণ্ঠায়। এশিয়ান কোটায় ভেড়াতে পারছে না বিশ্বকাপ খেলা এক ডিফেন্ডারও।

এই শঙ্কার মধ্যেই আজ সকালের ফ্লাইটে ঢাকা ছাড়ছেন এ দেশের ঘরোয়া ফুটবলে পরীক্ষিত এক সৈনিক নাইজেরিয়ান সানডে চিজোবা। লেফট উইং থেকে কোনাকুনি বক্সের দিকে প্রবেশ করে তাঁর ডান পায়ের প্লেসিংটা যখন দূরের পোস্ট দিয়ে জালে জড়াত, আবাহনী সমর্থকেরা নেচে উঠতেন। অথচ বিদায় বেলায় সানডের জানা নেই নতুন মৌসুমকে সামনে রেখে তাঁর আর ঢাকায় ফেরা হবে কিনা!

এই সানডে, কলিনদ্রেসদের বিপক্ষে খেলেই পরিপক্ব হয়ে উঠতে পারেন বাংলাদেশের তরুণেরা। শুধুই স্থানীয় ফরোয়ার্ডদের ঠেকিয়ে তাঁরা কীভাবে সামাল দেবেন বিশ্বকাপ ও এশিয়ান কাপের যৌথ বাছাইয়ে কাতারের এশিয়ান কাপ জয়ী ফরোয়ার্ডদের বা ভারতের সুনিল ছেত্রীকে? করোনায় আর্থিক দুরবস্থার অজুহাতে বিদেশি ফুটবলার বাদ দেওয়া হতে পারে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত, সাধারণ মানুষও সম্ভবত একমত হবেন। আর্থিক সংকটে বিদেশি ফুটবলারের সংখ্যা ৪ থেকে কমানো যেতে পারে। এতে আকর্ষণ যেমন থাকবে, স্থানীয়দের খেলার সুযোগটাও হয়তো আরও বাড়বে।