ফুটবলের ‘পরাজিত নায়ক’ ম্যারাডোনা

১৯৯৪ বিশ্বকাপে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়ের ট্যাকলে মাটিতে পড়ে যাচ্ছেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। এ ম্যাচের পরই ডোপ টেস্টে ধরা পড়েন ফুটবলের মহানায়কফাইল ছবি: এএফপি

ভূরুঙ্গামারী, চিলমারী, ভোলার চর জহিরুদ্দিন কিংবা কুকরিমুকরির মতো সদ্য জেগে ওঠা চরাঞ্চলে বহু দরিদ্র মানুষের বসবাস। এদের কাউকে যদি জিজ্ঞেস করেন, আর্জেন্টিনা কী? ভাবলেশহীন, শূন্য চাহনি দেখতে পাবেন। এ আবার কী জিনিস, খায় না মাথায় দেয়! এবার প্রশ্ন করুন, ম্যারাডোনা কে? আসবে মুচকি হাসিমাখা উত্তর, ‘হেইতে বল খ্যালায়, তুখ্খার হিলিয়ার।

ভোলায় মেঘনাপারের মানুষেরা ‘প’–কে ‘হ’ উচ্চারণ করে। ডিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনার কারণেই বাংলাদেশের জনগণ আর্জেন্টিনাকে চিনেছে। শুধু চেনেইনি, নীল-সাদা পতাকাটিকে ভালোবাসার রঙে রাঙিয়ে, হৃদয়ের গহিন কন্দর থেকে উৎসারিত আবেগ মাখিয়ে শহরে–বন্দরে, গ্রামে–গঞ্জে বা নিজেদের বাসগৃহে উঁচু করে টাঙিয়ে রেখেছে।

আমি বাল্যকাল থেকেই খেলাপাগল। স্বপ্নেও দেখতাম খেলা, মাঠে গোল করছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে এসে খেলার মাঠেই পড়ে থাকতাম। একসময় ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং এবং পাকিস্তান জাতীয় দলের খেলোয়াড় হিসেবে দেশব্যাপী পরিচিতি লাভ করি।

বয়সের কারণে খেলা ছাড়ার পরও খেলার পোকা মাথায় রয়ে গেল। সংগঠক বনে গেলাম। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি, এশীয় ফুটবল কনফেডারেশনের সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করে একসময় বিশ্ব ফুটবল সংস্থা ফিফায় প্রবেশাধিকার পাই। ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত ১০ বছর ফিফার ডিসিপ্লিনারি ও আপিল কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। কৈশোর-যৌবনের রোল মডেল ফুটবল তারকাদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সৌভাগ্য হয় তখন।

ফিফার অনেক অনুষ্ঠানে ব্রাজিলের পেলে, রাশিয়ার লেভ ইয়াশিন, হাঙ্গেরির পুসকাস, জার্মানির বেকেনবাওয়ার ও ফ্রান্সের প্লাতিনির সঙ্গে গল্প করে সুন্দর সময় কাটিয়েছি।

ম্যারাডোনাকে প্রথম দেখা

ম্যারাডোনাকে প্রথমবার কাছ থেকে দেখি ১৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপে অংশগ্রহণের সময়। আর্জেন্টিনা ছিল একটি সাধারণ মানের দল, ম্যারাডোনা এটিকে অসাধারণ বানিয়ে দিলেন। একক নৈপুণ্যে দলকে ফাইনাল পর্যন্ত টেনে নিয়ে যান, ফাইনালে ৩-২ গোলে জার্মানিকে হারিয়ে জয় করেন বিশ্বকাপ।

কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে একাই দুটি গোল করে দলকে জেতান, যার প্রথমটি ছিল হাত দিয়ে করা। সাংবাদিকদের জেরার মুখে তিনি বলেছিলেন, ওই গোলের পেছনে আছে ঈশ্বরের হাত—‘হ্যান্ড অব গড’। ইংল্যান্ডের জনগণ এ জন্য তাঁকে কখনো ক্ষমা করেনি, ম্যারাডোনাও কখনো দুঃখ প্রকাশ করেননি। এ ম্যাচেই তিনি পাঁচজনকে কাটিয়ে আরেকটি গোল করেন, সেটিকে ফিফা বিংশ শতাব্দীর সেরা গোলের মর্যাদা দিয়েছে। সেবার বিশ্বকাপে সেরা খেলোয়াড় হয়ে ম্যারাডোনা ‘গোল্ডেন বল’ জেতেন।

১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ জয়ের পর ফুটবলের সর্বকালের গ্রেটদের তালিকায় ব্রাজিলের পেলে এবং আর্জেন্টিনার আলফ্রেডো ডি স্টেফানোর সঙ্গে ম্যারাডোনার নামও যুক্ত হয়। অবশ্য ফুটবলপ্রেমীদের ভোট নিলে যে ম্যারাডোনাই এক নম্বর তারকা হবেন, এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।

অল্প বয়সে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার আয় করে এবং সেলিব্রিটি মর্যাদা লাভ করে ম্যারাডোনা নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই হারিয়ে ফেলেন। মাদক ও সুন্দরী নারীর প্রতি আগ্রহ তাঁকে অন্ধকার পথে টেনে নিয়ে যায়। মাদক তাঁর ক্রীড়াশৈলী ও শারীরিক সক্ষমতার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। মাদকাসক্তি থেকে নিরাময় লাভের জন্য তিনি কিউবাসহ বিভিন্ন দেশে চিকিৎসা নেন। তবু ভয়ংকর এ নেশা ক্রমেই তাঁকে গ্রাস করতে থাকে। ১৯৯১ সালে মাদক গ্রহণের জন্য ম্যারাডোনাকে ক্রীড়াঙ্গন থেকে দেড় বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়।

নাইজেরিয়ার বিপক্ষে ১৯৯৪ বিশ্বকাপের এই ম্যাচটিই হয়ে আছে ম্যারাডোনার শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ
ফাইল ছবি: এএফপি

গুরুদায়িত্ব নিয়ে বিশ্বকাপে

১৯৯৪ সালে বিশ্বকাপ হয় যুক্তরাষ্ট্রে। ফিফার ডিসিপ্লিনারি কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের আমন্ত্রণ পেয়ে ১৪ জুনের মনোরম সন্ধ্যায় আমি শিকাগো শহরে পৌঁছালাম। সঙ্গে স্কলাস্টিকা স্কুলের ছাত্রী, আমার কিশোরী কন্যা শামামা শাহ্রীন।

ফিফা বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে সবচেয়ে ধনী ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এর রাজসিক কর্মকাণ্ড অতুলনীয়। কর্মকর্তারা উড়োজাহাজের প্রথম শ্রেণিতে ভ্রমণের এবং শহরের সবচেয়ে বিলাসবহুল হোটেলে থাকার সুযোগ পান। তাঁদের বড় অঙ্কের সাম্মানিক ভাতাও দেওয়া হয়। শিকাগো এয়ারপোর্টে নতুন চকচকে লিমোজিনসহ আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন ফিফার লিয়াজোঁ অফিসার।

যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে এ ধরনের গাড়ি সার্বক্ষণিকভাবে আমার সেবায় নিয়োজিত ছিল, তবে চালক প্রতিদিনই বদল হতো। এরা আমেরিকার নাগরিক, স্বেচ্ছাসেবী। একদিন সকালে আমার গাড়িটি চালাতে এলেন এক বাংলাদেশি তরুণ, পেশায় চিকিৎসক। ফিফা লোগো-সংবলিত স্যুট পরা আমাকে দেখে কিছুটা হতাশ হলেন বলে মনে হলো। সম্ভবত আশা করেছিলেন একজন সাদা চামড়ার হোমরাচোমরা কর্মকর্তার সান্নিধ্য পাবেন। বারবার আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনি এখানে কীভাবে এলেন?’ আমি একজন ফিফা কর্মকর্তা, আমার উত্তর। ‘আপনি কি ফিফায় চাকরি করেন?’ তাঁর বোধ হয় বিশ্বাস হচ্ছিল না আমার কথা। না, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। ‘আপনি কী কাজ করেন?’ বঙ্গসন্তানের প্রশ্ন। আমি একজন জাতীয় সংসদ সদস্য, ১০ বছর ধরে ফিফায় ভলান্টারি সার্ভিস দিচ্ছি। আমার বক্তব্য আমেরিকায় বেড়ে ওঠা তরুণের বোধগম্য হলো কি না, বোঝা গেল না। বিলাসবহুল পরিবেশে অনুষ্ঠিত বিশ্বমেলায় একজন বাংলাদেশির পদার্পণ কীভাবে হলো, ডাক্তার সাহেব বুঝে উঠতে পারছিলেন না। পরবর্তীকালে তাঁকে আর পাইনি।

১৭ জুন বেলা একটায় শিকাগোর সোলজার ফিল্ড স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের উদ্বোধন ঘোষণা করেন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। তিনি ব্যান্ডের তালে তালে ৩০ সেকেন্ড নাচলেন এবং মাত্র ১ মিনিট বক্তব্য রাখলেন। মনে মনে ভাবলাম, যদি কোনো বঙ্গসন্তান এমন সুযোগ পেতেন, দর্শকেরা অনেক জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পেতেন। মাঠের মাঝখানে একটি ছোট মঞ্চে গান গাইলেন আমেরিকান টেলিভিশনের জনপ্রিয় তারকা অপরাহ উইনফ্রে। আমার মেয়ে একদৃষ্টিতে তাঁকেই দেখছে। কিসের ক্লিনটন-ফ্লিনটন!

উদ্বোধনী ম্যাচটা তেমন জমেনি। জার্মানি ক্লিন্সমানের দেওয়া একমাত্র গোলে বলিভিয়াকে হারায়। ১৯ জুন শিকাগো থেকে ডালাসে এসে ফোর সিজনস হোটেলে উঠলাম। ফিফার অপারেশনাল হেডকোয়ার্টারও এই হোটেলেই ছিল। ডিসিপ্লিনারি কমিটির সদস্য ছয়জন, প্রতি মহাদেশ থেকে একজন করে। আমি এশিয়ার প্রতিনিধি। বাকি পাঁচজন আসেন মিসর, ইংল্যান্ড, পেরু, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা থেকে।

কমিটির সভাপতি স্পেনের পাবলো পোর্তা। ফিফা সেক্রেটারি জোসেফ ব্ল্যাটার প্রতিটি সভায় উপস্থিত থাকতেন। কমিটির প্রধান কাজ খেলার মাঠে খেলোয়াড় লাল কার্ড পেলে এবং কোনো কর্মকর্তা অসদাচরণের জন্য অভিযুক্ত হলে তাঁর শাস্তি বিধান করা। বলবর্ধক মাদক সেবন বিশ্বক্রীড়াঙ্গনে এক ঘৃণিত অপরাধ, যা ‘ডোপিং’ নামে পরিচিত। বিশ্বকাপ শুরুর কয়েক মাস আগেই ফিফা বলবর্ধক নিষিদ্ধ ওষুধের তালিকা প্রকাশ করে সদস্যদেশগুলোকে জানিয়ে দেয়, যাতে কেউ ডোপিংয়ের শিকার না হন।

যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে গ্রুপ পর্বের খেলা শুরু হলো। ম্যাচ শুরুর আগে অংশগ্রহণকারী দুটি দলের খেলোয়াড়দের নাম লেখা ২২টি কার্ড মাঠে নিয়ে আসা হয়। খেলা শেষ হওয়ার কয়েক মিনিট আগে কার্ডগুলো টেবিলের ওপর আলাদা করে বিছিয়ে রাখা হয়। ফিফার ম্যাচ কমিশনার দুই দল থেকে দৈবচয়নের ভিত্তিতে একটি করে নাম লেখা কার্ড তুলে নেন। কার্ডে যে দুজনের নাম ওঠে, তাঁদের খেলা শেষ হওয়ামাত্র মেডিকেল রুমে নিয়ে মূত্রের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এই নমুনা ডোপ পরীক্ষা করার জন্য ক্যালিফোর্নিয়ার বিখ্যাত ইউসিএলএ গবেষণাগারে পাঠানো হয়। দুই-তিন দিনের মধ্যেই পরীক্ষার ফলাফল চলে আসে। ডোপ নেওয়ার অপরাধের শাস্তি বিধান করা প্রতিযোগিতা কমিটির এখতিয়ারভুক্ত।

১৯৯৪ বিশ্বকাপে গ্রিসের বিপক্ষে ম্যাচেও কড়া ট্যাকলের শিকার হন ম্যারাডোনা। এ ম্যাচে গোলও করেছিলেন তিনি
ফাইল ছবি: এএফপি

ম্যারাডোনার ডোপ টেস্ট

২৫ জুন বোস্টন শহরে অনুষ্ঠিত ম্যাচে আর্জেন্টিনা নাইজেরিয়াকে ২-১ গোলে হারায়। খেলা শেষ হওয়ার কয়েক মিনিট আগে দৈবচয়নের ভিত্তিতে কার্ড থেকে দুজন খেলোয়াড়ের নাম উঠে আসে। ম্যারাডোনার কপাল মন্দ, আর্জেন্টিনা দল থেকে উঠে আসে তাঁর নামের কার্ডটিই। খেলা শেষে তাঁর মূত্রের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। তিন দিন পর ডোপ পরীক্ষার ফলাফলে তিনি পজিটিভ। ম্যারাডোনা নিষিদ্ধ পাঁচটি ওষুধের ককটেল পান করেছেন বলে পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়। এ ধরনের পরীক্ষায় ভুল হওয়া বা এতে কারচুপি করার সুযোগ নেই। একেবারেই নিশ্ছিদ্র ব্যবস্থা।

ফিফা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার আগেই আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন ম্যারাডোনোকে বহিষ্কার করে। তাৎক্ষণিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগের নির্দেশ দেয়। ম্যারাডোনা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আমার মেয়ের কসম, আমি ড্রাগ নিইনি।’ কিন্তু দুদিন পরে বুয়েনস এইরেস বিমানবন্দরে নেমে তিনি বললেন, ‘আমি দুঃখিত, কাউকে দোষ দেব না। আমি এ ঘটনার দায়দায়িত্ব স্বীকার করছি।’ ৩৩ বছর বয়সী ম্যারাডোনা তত দিনে ক্রীড়াজগতের এক বিচিত্র চরিত্র।

৩০ জুন ফোর সিজনস হোটেলে অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতা কমিটির সভায় ম্যারাডোনাকে বিশ্বকাপ থেকে বহিষ্কার করা হয়। প্রতিযোগিতা শেষে তাঁর বিরুদ্ধে আরও শাস্তির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সেখানে। ডিসিপ্লিনারি কমিটির উপস্থিতিতে ফিফা সেক্রেটারি জেনারেল জোসেফ ব্ল্যাটার জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে ম্যারাডোনার বিরুদ্ধে নেওয়া শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথা জানিয়ে দেন।

১৯৯৪ বিশ্বকাপে গ্রিসের বিপক্ষে জয় উদযাপন করছেন ম্যারাডোনা
ফাইল ছবি: এএফপি

বাংলাদেশিদের সরব প্রতিবাদ

ম্যারাডোনা শক্তিবর্ধক মাদক নেওয়ায় বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় ওঠে। আর্জেন্টিনা নীরবে এই বিপর্যয় মেনে নেয়, দেশের মানুষ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু দেখা গেল, পৃথিবীর একমাত্র দেশ বাংলাদেশ, যেখানে অগণিত ভক্ত ম্যারাডোনার পক্ষে অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন শহরে মিটিং-মিছিল শুরু করে। তাদের মতে, তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার, তাঁকে অন্যায়ভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাঁরা মিছিলে স্লোগান দেয়, ‘ফিফার চামড়া, তুলে নেব আমরা।’ আর্জেন্টাইনরা নীরব, কিন্তু বাংলাদেশিরা সরব। প্রতিবাদমুখর এসব মিছিলের কারণে বাংলাদেশ সংবাদ শিরোনাম হলো। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় এ বিক্ষোভের সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হলো।

বাংলাদেশে ম্যারাডোনা–সম্পর্কিত বিক্ষোভের সংবাদ জেনে ফিফার বন্ধুরা আমাকে নিয়ে খানিকটা হাসাহাসি করে। বলে, ‘হেই ম্যান, হোয়াট ইজ রং উইথ বাংলাদেশ।’ আমি মনে মনে লজ্জিত। তাঁদের বলি, বাংলাদেশের অনেকে ম্যারাডোনার অন্ধভক্ত। আমার মেয়েও কষ্ট পায় ম্যারাডোনার পরিণতি দেখে।

রাতে বিছানায় শুয়ে ভাবি, কেন বাংলাদেশিরা ম্যারাডোনার পক্ষ নিয়ে বিক্ষোভ করছে, যেখানে আর্জেন্টাইনরাই নীরব? বাঙালি আসলে হৃদয় উজাড় করে তাঁকে ভালোবেসেছে। আমরা এক বিচিত্র জাতি। সৃষ্টিকর্তা কী দিয়ে আমাদের বানিয়েছেন, তিনিই জানেন। আমাদের পারিবারিক বন্ধন যে কতটা দৃঢ়, তা ইউরোপ-আমেরিকার মানুষ কল্পনাও করতে পারবে না। পেটে হয়তো দুমুঠো ভাত জোটে না, পকেটও খালি, কিন্তু তিন-চার দিন ছুটি পেলেই গ্রামে বসবাসরত পরিবারের সঙ্গে মিলিত হতে মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও ছোটে। পৃথিবীর আর কোথাও কি এমনটি ঘটে! এত ভালোবাসা, মায়া-মমতা কোথায় পেল এই জনমদুঃখী, হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী!
ফিফার বন্ধুরা যখন বাংলাদেশ নিয়ে টিপ্পনী কাটে, মনে মনে বলি, ‘তোমরা ভালোবাসার বোঝো কী?’

বাঙালিরা ম্যারাডোনাকে এত ভালোবাসে কেন? তাঁর শরীর চে গুয়েভারা ও ফিদেল কাস্ত্রোর উল্কিখচিত বলে? সমাজতন্ত্রের প্রতি তাঁর আসক্তির কারণে? অনেকে বলে বাঙালিরা ‘ফলেন হিরো’ বা পরাজিত নায়ককে ভালোবাসে। সাবেক রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদ জীবিত থাকাকালে রংপুরে জনপ্রিয়তা পাননি। কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে পতনের পর জেলে থাকা অবস্থায় জাতীয় সংসদের পাঁচটি আসনে বিজয়ী হলেন। বাইরের মানুষ যখন এরশাদকে দুর্নীতি এবং পরনারীর প্রতি আগ্রহের জন্য কটাক্ষ করে। রংপুরের অনেকে বলে—‘রাজা-বাদশার কিছু দোষ তো থাকেই—সে তো হামার অংপুরের ছৈল (ছেলে)।’

১৯৯৪ সালের ১৭ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসের রোজ বোল স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপ ফাইনাল হলো। ব্রাজিল বনাম ইতালি। নির্ধারিত ৯০ মিনিট গোলশূন্য থাকায় ম্যাচ টাইব্রেকারে গড়াল এবং ৪-২ ব্যবধানে ব্রাজিল বিশ্বকাপ ট্রফি জিতে নিল। প্রায় এক মাস যুক্তরাষ্ট্রে কাটিয়ে দেশে ফিরে এলাম।

দেশে ফেরার পর

ভোলার লালমোহনে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখি, ব্রাজিল ট্রফি জিতলেও আলোচনার কেন্দ্রে ম্যারাডোনা। এলাকাবাসী জানে, আমি বিশ্বকাপ থেকে সদ্য প্রত্যাগত। ময়লা লুঙ্গি পরা এক বৃদ্ধ আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘ছার, ম্যারাডোনারে বলে মদ খাওনের লাই জেলে নিছে?’

‘কই, না তো।’ আমার সংক্ষিপ্ত জবাব।

‘ছার, হেইতে মদ খাইলে কি আঁর হইসা (পয়সা) দি খাইছে? নিজের হইসা দি খাইছে। দোষটা কী?’ বৃদ্ধের উক্তি।

উপলব্ধি হলো, তাঁকে ফিফার আইন বুঝিয়ে লাভ নেই। তিনি হৃদয় উজাড় করে সুদূর আর্জেন্টিনার এই ‘ফলেন হিরো’ বা পরাজিত নায়ককে ভালোবেসেছেন।

ম্যারাডোনার তিরোধানের পর পেলে স্বর্গে তাঁর সঙ্গে ফুটবল খেলার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। সৃষ্টিকর্তা যেন তাঁর ইচ্ছাটি পূরণ করেন। তেমন কোনো খেলার কেউ দর্শক হতে পারলেও তো বিরাট সৌভাগ্য।

লেখক: সাবেক মন্ত্রী ও ফুটবলার।