ফুটবলের ভালোবাসায় হার 'সাকিব' হওয়ার ইচ্ছার

আপনার শিশুকে ছয়টি টিকা এবং একটি করে ক্রিকেট ব্যাট ও বল দিন!
ক্রিকেটই এখন বাংলাদেশের মানুষের সবচেয়ে প্রিয় খেলা। ক্রিকেটের প্রতি এই ভালোবাসা-উন্মাদনা শিশু-কিশোরদের মধ্যেও ছড়িয়ে গেছে। বিশেষ করে যে দেশে বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডার থাকে, সেই দেশের শিশুরা বড় হলে ‘সাকিব’ই হতে চায়।
কিন্তু ব্যতিক্রমও আছে নিশ্চয়ই। নিপু-সাদরা যেমন। ফুটবল খেলাটার প্রতি তাদের ভালোবাসা এত তীব্র, সেই ভালোবাসার কাছে হার মেনেছে ক্রিকেটার হওয়ার ইচ্ছা। তারা বরং ফুটবলারই হতে চেয়েছে। হতে চায় বড় ফুটবলার। ফুটবল খেলেই লাল-সবুজ পতাকা নিয়ে যেতে চায় বিশ্বের দরবারে। সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবলের শিরোপা সেই স্বপ্নেরই প্রথম ভিত্তি।
সারোয়ার জামান নিপু। নামটা কদিনেই খুব প্রিয় হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীদের কাছে। সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবল প্রতিযোগিতার টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কারটা এমনি ওঠেনি নিপুর হাতে। নিপুর খেলা দেখে মুগ্ধ ফুটবলবোদ্ধারাও। তারকাখরার বাংলাদেশের ফুটবলাঙ্গনে আলো জ্বেলে দিতেই এসেছে দারুণ সম্ভাবনাময় এই খেলোয়াড়। এমন দারুণ পায়ের কাজ, প্রতিভাদীপ্ত ফুটবলশৈলী আর ফুটবল-জ্ঞানে দেশের ফুটবলের সুন্দর আগামীর স্বপ্নই দেখাচ্ছে এ কিশোর।
নজর কেড়েছে সাদ উদ্দিনও। বয়সের তুলনায় একটু লম্বা চওড়া। পুরো টুর্নামেন্টে মধ্যমাঠে বাংলাদেশের ডিএনএ হয়ে নিজের দায়িত্ব পালন করেছে দারুণভাবে। নিপুর মতো গতি হয়তো নেই। কিন্তু পায়ের কাজ আর ফুটবল জ্ঞানে সাদ দুর্দান্ত। গতকাল ভারতের বিপক্ষে ফাইনালে নিপুর অনুপস্থিতি অনেকটাই পুষিয়ে দিয়েছিল সাদ। ভারতের রক্ষণভাগে বারবারই আতঙ্ক ছড়িয়েছিল। বাংলাদেশের ফুটবলে আগামীর তারকা হওয়ার বার্তাই যেন দিয়ে রাখল এ কিশোর।

শুধু এ দুজন নয়; কিশোর ফুটবলাররা প্রত্যেকে আলো ছড়িয়েছে—প্রতিভার, সম্ভাবনার।
নিপুর বাড়ি কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে। সাদের সিলেটের দক্ষিণ সুরমা। নিপুর ফুটবলার হয়ে ওঠার ইচ্ছেটা কীভাবে জানেন? বাজিতপুরে একটি স্থানীয় ফুটবল ম্যাচ দেখে। মাঠের বাইশজন জন ফুটবলারের খেলা দেখতে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাজার হাজার মানুষের আগমণ আর গগনবিদারী হর্ষধ্বনিই নিপুর মধ্যে বুনে দিয়েছিল স্বপ্নের বীজ। শৈশবেই অনুভব করেছিল, সব আনন্দ-রোমাঞ্চ এ ফুটবলেই। পরতে পরতে উত্তেজনা ছড়িয়ে দেওয়া এই ফুটবলই হবে জীবনের আরেক অধ্যায়। খেলোয়াড় যদি হতে হয়, তবে ফুটবলারই হব—এই ব্রত যেন নিয়েছিল নিপু। থাকুক না ক্রিকেটে অর্থ, খ্যাতি আর গ্ল্যামার। থাকুক না চোখের সামনে সাকিব-মাশরাফিদের মতো তারকা ক্রিকেটারের উদাহরণ । রোমাঞ্চ-পিয়াসী নিপুর সব ধ্যান-জ্ঞান তখন থেকেই ফুটবল।
বাজিতপুরে একটি স্থানীয় ফুটবল একাডেমিতে আনুষ্ঠানিক পাঠ শুরু নিপুর। সেখান থেকে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সেইলর অনূর্ধ্ব-১৫ ফুটবল প্রতিযোগিতায় মাঠ মাতিয়েই লাল সবুজ দলের জার্সি গায়ে তুলে নেওয়া। অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবল দলের কোচ সৈয়দ গোলাম জিলানির উচ্চাশা নিপুকে নিয়ে, ‘ওর দেখভালটা যদি ভালো হয়, ও নিজে যদি সিরিয়াস হয়, তাহলে সে খুব শিগগিরই দেশের ফুটবলের বড় তারকা হয়ে উঠবে। বিরাট বড় তারকা হয়ে ওঠার সবকিছুই নিপুর মধ্যে আছে।’
নিপুও স্বপ্ন দেখছে ফুটবল খেলে মানুষের ভালোবাসা জয় করার, ‘আমাদের এলাকায় যে ফুটবল প্রতিযোগিতা হয়, সেখানে ঢাকা থেকে একবার খেলতে এসেছিলেন জাতীয় দলের ফুটবলার আতিকুর রহমান মিশু। তাঁর প্রতি মানুষের যে আগ্রহ-ভালোবাসা দেখেছি, চাই আমাকে নিয়েও মানুষ ঠিক তেমনই আগ্রহ দেখাক, ভালোবাসুক।’
নিপুর তুলনায় সাদের উত্থানটা অবশ্য হুট করে নয়। সিলেটের দক্ষিণ সুরমা বেড়ে ওঠা সাদের বাবাও ছিলেন একজন ফুটবলার। বাবার মুখ থেকে এ দেশের ফুটবলের রোমাঞ্চকর অতীত, আবাহনী-মোহামেডান দ্বৈরথের গল্প শুনতে শুনতেই ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন জন্ম নিয়েছে মনের গহিনে। দক্ষিণ সুরমায় ‘ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড’ নামের একটি একাডেমিতে অনুশীলন করতে করতেই নিজেকে তৈরি করেছে। এই মুহূর্তে সিলেটে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের ফুটবল একাডেমির কৃতী ছাত্র সাদের স্বপ্ন বাংলাদেশের ফুটবলের স্বপ্নসারথি হওয়া।
নিপু-সাদ দুজনেই লিওনেল মেসির বিরাট ভক্ত। টেলিভিশনে বার্সেলোনার খেলা দেখালেই হারিয়ে যায় ইউরোপীয় ফুটবল রাজ্যে। নিপু তো একদম হুবহু অনুসরণের চেষ্টা করে মেসিকে। বলল, ‘মেসির চেয়ে প্রিয় ফুটবলার আর কেউ নেই।’ সাদেরও কণ্ঠেও একই কথার অনুরণন, ‘আমার দৃষ্টিতে মেসিই পৃথিবীর সেরা ফুটবলার।’
অনূর্ধ্ব-১৬ দলে খেলে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হয়ে উঠেছে নিপু-সাদ দুজনের। মাঠের খেলা তো খেলেছেই। দুজনের কাছেই আনন্দদায়ক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে আন্তর্জাতিক ফুটবলের বিভিন্ন কায়দা-কানুন দেখে। নিপু যেমন জানাল, তার নিজের নাম লেখা একটা জার্সির খুব শখ ছিল। সেই শখ দারুণভাবে পূরণ হয়েছে এ প্রতিযোগিতায় খেলে। তার সংগ্রহে এখন নিজের নাম লেখা কয়েক সেট জার্সি। জার্সিগুলোর বুকে আছে গর্বের লাল-সবুজ পতাকাও।
নিপু-সাদ লাল-সবুজের পতাকা বুকে ধারণ করবে বহু দিন, এমন প্রার্থনা পূণ্যভূমি সিলেট থেকে ছড়িয়ে পড়েছে গোটা দেশেই।