ফুটবলের রোগ সারাতে দরকার সঠিক ওষুধ, সেটা কোথায়?

জাতীয় দলের সাবেক কোচ মারুফুল হক। ফাইল ছবি
জাতীয় দলের সাবেক কোচ মারুফুল হক। ফাইল ছবি
>এসএ গেমস ফুটবলে প্রত্যাশিত সোনার পদক জেতা হয়নি অনূর্ধ্ব-২৩ দলের ছদ্মাবরণে বাংলাদেশের ‘প্রায়’ জাতীয় দলের। এর আগে ২০১১ সাল থেকে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে সেমিফাইনাল থেকে গেছে স্বপ্ন হয়েই। দেশের ফুটবলের এমন অবস্থার কারণটা বিশ্লেষণ করেছেন জাতীয় দলের সাবেক কোচ মারুফুল হক

দক্ষিণ এশীয় গেমসের ফুটবলে সোনা আরও আগেই জিতেছে বাংলাদেশ। ১৯৯৯ ও ২০১০ সালে দুবার সোনার পদক এলেও সেটি এসেছিল অনেক কাঠখড় পুড়িয়েই। ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত ৭টি দক্ষিণ এশীয় গেমসে ৪ বার ফাইনালে উঠেও সোনা অধরাই থেকেছিল বাংলাদেশের। দক্ষিণ এশীয় গেমসকে একটা সময় দেশের ফুটবলের ‘দুঃখ’ বলতেন অনেকেই। দুবার সোনার পদক জেতার পর সেই দুঃখটা দূর হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ফুটবল এ গণ্ডি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারেনি কখনোই।

সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ চালুর পরেও এ অঞ্চলের সেরার কাতারে নিজেদের তর্কহীনভাবে তুলে ধরতে পারেনি বাংলাদেশ। ২০১১ সালের পর তো দক্ষিণ এশীয় ফুটবলের আসরে সেমিফাইনালেই খেলা হয় না। সাফ বা এসএ গেমস ফুটবলের প্রায় ভুলে যাওয়া দুঃখটা এবার আবার মাথাচাড়া দিয়েছে কাঠমান্ডুতে। ভারত-পাকিস্তানহীন আসরেও ব্রোঞ্জ নিয়েই তুষ্ট থাকতে হয়েছে আমাদের। হারতে হয়েছে ভুটানের কাছে। নেপালের বিপক্ষেও হারের ধারাবাহিকতা বজায় থেকেছে। কিছু দিন আগে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স আমাদের ফুটবল নিয়ে নতুন করে আশাবাদী করে তুলেছিল। কিন্তু এসএ গেমস সেই আশাবাদকে আবারও চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছে। আবারও হতাশ দেশের ফুটবলপ্রেমীরা—ফুটবল কি কখনোই আমাদের এতটুকু আনন্দের উপলক্ষ হয়ে আসবে না?

দেশের একমাত্র উয়েফা ‘এ’ লাইসেন্সধারী কোচ মারুফুল হক বাস্তববাদী। এসএ গেমসে এবারের ব্যর্থতা তাঁর ভাষায় ফুটবলের সামগ্রিক অবস্থারই প্রকাশ। তাঁর মতে, এটাই আমাদের ফুটবলের মানদণ্ড। চিরদিন ধরেই আমাদের ফুটবলের লক্ষ্যহীন পথচলার প্রতিক্রিয়াতেই বারবার ফুটবলের এই ব্যর্থতা। তিনি মনে করেন, এই অচলায়তন ভাঙতে না পারলে দু-একটি চমক ছাড়া ফুটবলের অবস্থার পরিবর্তনের কোনো সুযোগই নেই।


এবারের এসএ গেমসে ভারত দল পাঠানোর প্রয়োজনীয়তাই অনুভব করেনি। তারা অবশ্য সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ নিয়েও খুব বেশি আগ্রহী নয়। তারা নিজেদের লক্ষ্যটাকে আরও বহুদূর ছড়িয়ে দিয়েছে। ভুটানও সুন্দর পরিকল্পনা করে এগিয়ে যাচ্ছে, যে দলটি দক্ষিণ এশীয় গেমসের ফুটবলে আগে কখনো পদকই জিততে পারেনি, তারা এবার ফাইনালে খেলছে। নেপাল ভবিষ্যতের দল খেলিয়েই হারিয়েছে আমাদের জাতীয় দলের খেলোয়াড়সমৃদ্ধ দলকে। মালদ্বীপও তাদের দেশের সেরা তারকাদের বিশ্রাম দিয়ে দল পাঠানোর বিলাসিতা দেখাতে পারে।

অথচ, আমরা প্রায় জাতীয় দল পাঠিয়েও সাফল্য পাই না। এ অবস্থা তৈরি হয়েছে দিনের পর দিন ধরে চলা ফুটবলের অব্যবস্থাপনার কারণে—মারুফুল মনে করেন এমনটাই। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাদ দিয়ে নগদ সাফল্যের আশায়  শর্টকাট উদ্যোগ আমাদের ফুটবলকে শেষ করে দিচ্ছে। ফুটবলের রোগ সারাতে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার বিকল্প নেই বলেই জানিয়েছেন এই কোচ।

ফুটবলের এ অবস্থার জন্য মারুফুল পাঁচটি কারণকে দায়ী করেন। এ কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে যেকোনো ফুটবলপ্রেমীই বুঝতে পারবেন ফুটবল উন্নয়নের মৌলিক দিকগুলিতে অবহেলাই দিন দিন ফুটবলকে শেষ করে দিচ্ছে।

পরিকল্পনাহীনতা
বাস্তবিক অর্থে আমাদের কোনো পরিকল্পনা নেই। ৫ বছর বা ১০ বছর পর দেশের ফুটবলকে আমরা কোথায় দেখতে চাই, সেটি আমরা কেউই জানি না। আর লক্ষ্য না থাকলে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। যেভাবে চলছে, এভাবে চালিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু কখনোই এই পর্যায় থেকে বের হয়ে ভালো অবস্থানে যাওয়ার সুযোগ থাকবে না।

খেলোয়াড় তৈরির অনীহা
আমরা সবাই জানি সবাই বুঝি সাফল্যের জন্য প্রয়োজন মানসম্পন্ন খেলোয়াড় এবং সেটা তৈরি করে নিতে হবে। খেলতে খেলতে ফুটবলার হয়ে ওঠা খেলোয়াড়দের নিয়ে ঠেকার কাজ চালিয়ে নেওয়া গেলেও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা যায় না। মাঝেমধ্যে দেখানো যেতে পারে চমক। কিন্তু সাফল্য কখনোই আসবে না। কারণ, ১৬ বছরের একটি ছেলেকে ফুটবল শিখিয়ে এশিয়ান পর্যায়ে খেলার স্বপ্ন দেখা বোকামি। এখন তো সাফ অঞ্চলেই হাবুডুবু খেতে হচ্ছে। কারণ, অন্যরা একাডেমি তৈরি করে মানসম্পন্ন ফুটবলার তৈরি করছে, যাদের সঙ্গে যোগ্যতায় আমাদের ফুটবলাররা কুলিয়ে উঠতে পারছে না।

জুনিয়র পর্যায়ে ভালো মানের কোচ না থাকা
দেশে সঠিক উপায়ে ফুটবল শেখার কোনো জায়গা নেই—এটাই বাস্তবতা। দেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফুটবল ফেডারেশনের নিজস্ব ভালো একটা একাডেমি নেই, ক্লাবগুলোরও নেই তেমন কোনো অবকাঠামো। যেখানে অল্প বয়স থেকে তৈরি হবে ‘শিক্ষিত ফুটবলার’। আনকোরা কোচদের হাতে গড়ে উঠছে ভবিষ্যৎ ফুটবলাররা। একে তো বেশি বয়সে গিয়ে ফুটবল শেখার চেষ্টা, দ্বিতীয়ত মানহীন কোচের হাত ধরে শেখা। স্বাভাবিকভাবেই যোগ্য ফুটবল তৈরি হয় না।

খেলার ধরন
আমরা এখনো জানি না আমরা কোন স্টাইলে ফুটবল খেলব। আমাদের শারীরিক সক্ষমতার বিষয়টি মাথায় রেখে আমাদের খেলার ধরন ঠিক করা উচিত ছিল অনেক আগেই। সে লক্ষ্য সামনে রেখে কোচ নির্বাচন করা থেকে শুরু করে সাজানো উচিত ছিল বয়সভিত্তিক দলগুলোর পরিকল্পনা। জাতীয় দল খেলছে এক কৌশলে, বয়সভিত্তিক দল খেলছে অন্যভাবে। ফলে নির্দিষ্ট একটা কৌশল কখনোই আয়ত্ত করা যাচ্ছে না।

খেলোয়াড় নির্বাচন
এই সব কটি কারণ ফুটবলের সামগ্রিক ব্যর্থতার জন্য দায়ী। এসএ গেমসে ব্যর্থতার পেছনে এই কারণগুলোর সঙ্গে যোগ হয়েছে খেলোয়াড় নির্বাচনে দুর্বলতা। কোচ ঘরোয়া ফুটবল মাঠে বসে না দেখায় খেলোয়াড়দের সঠিক নির্বাচন হয়নি। কোচ মাঠে না থেকেও টিভিতে খেলা দেখে খেলোয়াড়দের ওপর চোখ রাখতে পারেন। কিন্তু আমাদের তো সে অবস্থা নেই।

একজন খেলোয়াড়কে কখনোই অনুশীলন দেখে বিচার করা যায় না। উদাহরণস্বরূপ এই কারণেই মতিন মিয়ার মতো ফরোয়ার্ড জাতীয় দলে বদলি হিসেবেও খেলোয়াড় সুযোগ পায় না। কারণ, ঘরোয়া ফুটবলে তার খেলা তো কোচ মাঠে বসে দেখেননি। একটা বিষয় স্পষ্ট এবারের দলে কোনো ভালো হোল্ডিং মিডফিল্ডার ছিল না। শেষ ম্যাচে প্রথাগত লেফটব্যাককে দিয়ে খেলানো হয়েছে হোল্ডিং মিডফিল্ডার পজিশনে। অথচ কোচ ঘরোয়া ফুটবল দেখলে ভালো কিছু মিডফিল্ডারের সন্ধান পেতেন।