বখাটেদের উৎপাত সয়েই তাঁরা রাগবিতে, ফুটবলেও

অনেক চড়াই–উতরাই পেরিয়েই রেখা–রুমার খেলোয়াড়ি জীবন

এশিয়ান রাগবি সেভেনস খেলতে গত বছর আগস্টে ইন্দোনেশিয়ায় গিয়েছিলেন রেখা আক্তার। কয়েক বছর আগেও তাঁর খেলার মাঠে যাওয়াই ছিল মানা। বাবা বুলবুল আহমেদ একেবারেই চাইতেন না মেয়ে খেলাধুলা করুক। অথচ তিনিই কিনা ইন্দোনেশিয়াযাত্রার সময় রেখাকে রংপুর শহর পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসেছিলেন!

রংপুর সদরের সদ্যপুষ্করিণী ইউনিয়নের পালিচড়া গ্রামের মেয়ে রেখা। দরিদ্রের মধ্যে তাঁর বেড়ে ওঠা। কেবল রেখাই নন, পালিচড়া গ্রামের বেশির ভাগ মেয়ের গল্পই একই রকম। পরিবারগুলোর আর্থিক অবস্থাতেও কোনো পার্থক্য নেই। পাশাপাশি আর দশটা মেয়ের মতোই এলাকার বখাটেদের উৎপাত সয়ে তাঁদের জীবন। সমাজপতিদের চোখ রাঙানি তো আছেই। সেই গ্রামেরই রেখা যখন বাংলাদেশ জাতীয় রাগবি দলের হয়ে বিদেশ সফর করেন, তখন ব্যাপারটা অন্য রকম একটা আবেশ ছড়ায়। হয়ে ওঠে দারুণ একটা গল্পও।

‘শুরুতে বাবা খেলতে বাধা দিতেন। আশপাশের লোকেরা খুব খারাপ কথা বলত। বাবা বাড়িতে এসে বলতেন, মেয়েরা খেলাধুলা করতে পারবে না। আর খেলতে হলে এই মেয়েদের কোনো ভরণপোষণ দেবেন না।’
রুনা আক্তার, রাগবি ও ফুটবল খেলোয়াড়

রেখার মতো রুনা আক্তারও পালিচড়া গ্রামের মেয়ে। তিনিও রাগবি জাতীয় দলের সদস্য। গিয়েছিলেন ইন্দোনেশিয়াও। রুনার বাবা রবিউল ইসলাম সদ্যপুষ্করিণী বাজারে ছোট্ট একটি রেস্তোরাঁ চালান। বখাটেদের উৎপাত সয়ে খেলোয়াড় হয়ে ওঠা তাঁর। এই দুজন নিজেদের খেলোয়াড়ি সত্তাকে নিয়ে গেছেন অন্য মাত্রায়। কেবল রাগবি? রেখা-রুনার পদচারণের ব্যাপ্তি পৌঁছে গেছে ফুটবলেও। রাগবি তো খেলেনই, ফুটবলেও নিজেদের প্রতিভার জানান দিয়েছেন তাঁরা দুজন।

ঢাকায় চলছে মেয়েদের ফুটবল লিগ। এফসি উত্তরবঙ্গ ক্লাবের হয়ে খেলছেন রেখা ও রুনা। লিগের প্রথম পর্বের ৬ ম্যাচে ৩ জয় এফসি উত্তরবঙ্গের। জয়গুলোয় বড় অবদান মিডফিল্ডার রেখা ও ডিফেন্ডার রুনার। গতকালও বেগম আনোয়ারা স্পোর্টিং ক্লাবকে ৪-১ গোলে হারিয়েছে এফসি উত্তরবঙ্গ। খেলা শেষে কমলাপুর স্টেডিয়ামে দাঁড়িয়ে রুনা বলছিলেন, ‘রাগবি নয়, আমার ভালো লাগে ফুটবল খেলতে।’ কেবল রুনাই নন, তাঁর পাঁচ বোনের তিনজনই ফুটবলার। রুনার পাশাপাশি রুমি আক্তার ও জয়নব বিবি খেলছেন এবারের মেয়েদের লিগে। যদিও চোটের কারণে রুমি আপাতত দর্শকের গ্যালারিতে।

‘ছোটবেলা থেকেই আমার খুব ইচ্ছা ছিল উড়োজাহাজে চড়ব। যখন খবর পেলাম ইন্দোনেশিয়ায় খেলার সুযোগ পেয়েছি, খুশিতে সারা রাত ঘুমাইনি।’
রেখা আক্তার, রাগবি ও ফুটবল খেলোয়াড়

রুনার কোনো ভাই নেই। মেয়েদের খেলাধুলা মোটেও পছন্দ করতেন না রুনার বাবা। শুরুর সেই কষ্টের দিনগুলোর কথা বলছিলেন রুনা, ‘শুরুতে বাবা খেলতে বাধা দিতেন। আশপাশের লোকেরা খুব খারাপ কথা বলত। বাবা বাড়িতে এসে বলতেন, মেয়েরা খেলাধুলা করতে পারবে না। আর খেলতে হলে এই মেয়েদের কোনো ভরণপোষণ দেবেন না।’

তবে বাবার কথায় মোটেও দমে যাননি রুনা। ফুটবলে জেএফএ কাপ অনূর্ধ্ব-১৪ দলে খেলেছেন রংপুরের হয়ে। জাতীয় বয়সভিত্তিক অনূর্ধ্ব-১৫ দলের হয়ে হংকংয়ের টুর্নামেন্টে খেলেছেন। জেলা রাগবি টুর্নামেন্টে গত বছর রংপুর রানার্সআপ হলেও সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জেতেন রুনা। এমনকি ইন্দোনেশিয়ায় বাংলাদেশ দলের ভরাডুবির মধ্যেও দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে পয়েন্ট পাওয়া একমাত্র খেলোয়াড় ছিলেন রুনা। দিন বদলেছে রুনার। বাবা আগের মতো খেলাধুলায় বাধা দেন না, ‘রাগবি খেলে ১০ হাজার টাকা পেয়েছিলাম। ওই টাকা বাবার হাতে তুলে দিই। বাবা খুব খুশি হয়েছিলেন। এখন বাবা খেলাধুলায় উৎসাহ দেন।’

ঢাকায় চলছে মেয়েদের ফুটবল লিগ। এএফসি উত্তরবঙ্গের হয়ে খেলছেন রেখা–রুনা–দুজনই।
Shamsul Haque Tanku

রেখার বাবা কৃষক। তিন বোন ও এক ভাইয়ের পরিবারে রেখা একাই খেলাধুলা করেন। ফুটবল খেলতে কখনো দেশের বাইরে যাননি রেখা। তবে রাগবি খেলার সুবাদে প্রথম উড়োজাহাজে ওঠার সুযোগ হয়। সেই স্মৃতি রোমন্থনে রোমাঞ্চ ভর করল রেখার কণ্ঠে, ‘ছোটবেলা থেকেই আমার খুব ইচ্ছা ছিল উড়োজাহাজে চড়ব। যখন খবর পেলাম ইন্দোনেশিয়ায় খেলার সুযোগ পেয়েছি, খুশিতে সারা রাত ঘুমাইনি।’

২০১৪ সাল থেকে ফুটবল খেলছেন রেখা। জেএফএ কাপ ফুটবলের পাশাপাশি, জাতীয় অনূর্ধ্ব-১৫ ও অনূর্ধ্ব-১৭ বয়সভিত্তিক দলে খেলেছেন। পালিচড়া গ্রাম থেকে উঠে এসে জাতীয় দলে খেলছেন সিরাত জাহান, ইসরাত জাহানেরা। রেখাও জাতীয় দলের জার্সিতে মাঠে নামতে চান, ‘আপুদের মতো আমিও খেলতে চাই জাতীয় দলে।’

২০১৮ সালে মেয়েদের অনূর্ধ্ব-১৮ সাফে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। ওই টুর্নামেন্টে জেতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্য খেলোয়াড়দের মতো সিরাত জাহান, ইসরাত জাহানদের দিয়েছিলেন ১০ লাখ টাকার অর্থ পুরস্কার। পালিচড়ার সব মেয়েই এখন স্বপ্ন দেখেন খেলাধুলা করে বাবার সংসারের হাল ধরবেন। আর সেই পথে এগিয়ে চলতে রাগবি, ফুটবল। কোনো খেলাকেই আলাদা চোখে দেখেন না রেখা-রুনাদের মতো মেয়েরা।