বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ থেকে বিশ্বকাপে

কোচদের ‘প্রো’ সনদ কোর্স করতে ঢাকায় এসেছেন দক্ষিণ কোরিয়ার হয়ে দুটি বিশ্বকাপে খেলা লি চুন সু। বাংলাদেশ থেকেই শুরু হয়েছিল ফুটবলার হিসেবে তাঁর উত্থানের গল্প।

লি চুন সু ১৯৯৯ সালে ঢাকায় দক্ষিণ কোরিয়ার একটি দলের হয়ে খেলতে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপফাইল ছবি, এএফপি

হোটেল লবিতে সৌজন্য বিনিময় শেষে অনুবাদকের দিকে ইশারা করে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বললেন, ‘দয়া করে তাড়াতাড়ি করুন।’ ১৯৯৯ সালে অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ নিয়ে কথা বলার ইচ্ছার কথা জানাতেই যেন মাস্কের ওপরে চোখ জোড়া জ্বল জ্বল করে উঠল তাঁর। একটু আগেই তাড়া দেওয়া মানুষটা যেন কিছু সময়ের জন্য স্থির হয়ে গেলেন।

বলা হচ্ছে ২০০২ ও ২০০৬ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলে খেলা দক্ষিণ কোরিয়ার লি চুন সুয়ের কথা। দক্ষিণ কোরিয়ার জার্সিতে ৭৮টি ম্যাচ খেলা এই ফরোয়ার্ডের ক্যারিয়ারে বাঁক বদলের গল্প হয়ে আছে বাংলাদেশে খেলে যাওয়া বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ। প্রায় ২৩ বছর আগে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে দক্ষিণ কোরিয়া অনূর্ধ্ব–১৯ দলের হয়ে অভিষেক ম্যাচ খেলেন লি। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। একপর্যায়ে সুযোগ পেয়ে যান দক্ষিণ কোরিয়ার বিশ্বকাপ দলে। ২০০৬ সালে টোগোর বিপক্ষে গোল করে নাম তোলেন বিশ্বকাপ গোলদাতাদের তালিকায়।

প্রো সনদ কোর্স করতে ঢাকায় এসেছেন লি সুন
ছবি: প্রথম আলো

বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপে যুব দলের হয়ে খেলতে এসে থাইল্যান্ডের বিপক্ষে ডাবল হ্যাটট্রিকে শুরু, ৩ ম্যাচে ৮ গোল করে হয়েছিলেন সর্বোচ্চ গোলদাতা। তাঁর ছবি ছাপা হয় দেশের পত্রিকায়। সেই ছবি দেখে যেন নতুন জীবন ফিরে পান লি–র অসুস্থ বাবা। ‘বাবা খুব অসুস্থ ছিলেন। সেই দুশ্চিন্তা নিয়েই টুর্নামেন্টটা খেলেছিলাম। থাইল্যান্ডের বিপক্ষে ৬ গোল করার পর পত্রিকায় আমার ছবি ছাপা হয়। সেই ছবি দেখে বাবা খুব খুশি হয়েছিলেন’—কথা বলতে বলতে দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক ফুটবলার যেন ফিরে গেলেন প্রায় ২৩ বছর আগে।

আমার পেশাদার ফুটবলার–জীবনের সঙ্গেই বাংলাদেশের নাম জড়িয়ে। এখানে খেলে সাফল্য পেয়েছি। পরে অনেকবারই ভেবেছি, সুযোগ পেলে বাংলাদেশে আসব
লি চুন সু, দক্ষিণ কোরিয়ার ফুটবলার

শুরুতে যাঁকে ভাবা হয়েছিল অন্য আট-দশজনের মতোই একজন, বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ শেষে তিনিই হয়ে উঠলেন দক্ষিণ কোরিয়ার ফুটবলের পরবর্তী প্রজন্মের আশার আলো। দুটি বিশ্বকাপের সঙ্গে প্রথম দক্ষিণ কোরিয়ান হিসেবে খেলেছেন স্প্যানিশ লা লিগায়ও। ঢাকায় এএফসি ‘প্রো’ সনদ কোর্স করতে আসা লি–র সেই গল্পগুলো বারবার থেমে যাচ্ছিল বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপে। লি বলছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ আমার জীবনটাই বদলে দিয়েছে। স্কুলে পড়া শেষ করতে করতেই দলে সুযোগ পেয়ে যাই। টুর্নামেন্টে ৮ গোল করে সুযোগ পাই অলিম্পিক দলে। এরপর জাতীয় দলে খেলার সুযোগটাও আসতে দেরি হয়নি।’

দক্ষিণ কোরিয়ার হয়ে ৭৮টি ম্যাচ খেলেছেন লি, খেলেছেন দুটি বিশ্বকাপও
ফাইল ছবি

২০০২ সালের বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলে ইতিহাস গড়েছিল দক্ষিণ কোরিয়া। লির সৌজন্যে চলে যেতে পারত ফাইনালেও। সিউলে জার্মানির বিপক্ষে ১–০ গোলে হারা সেমিফাইনালে তাঁর ডান পায়ের দুর্দান্ত শট ডান দিকে ঝাঁপিয়ে রক্ষা করেন গোলকিপার অলিভার কান। ১৯ বছর আগের সেই স্মৃতি এখনো হতাশা জাগায় লি–র মনে, ‘এখনো ভাবি, অলিভার দারুণ ওই সেভটা না করলে ফাইনালে ব্রাজিলের সঙ্গে আমরাই খেলি। কে জানে, বিশ্বকাপটাও হয়তো উঁচিয়ে ধরতে পারতাম!’ বিশ্বকাপের পারফরম্যান্সে মুগ্ধ হয়ে সেবার লিকে ৩ মিলিয়ন পাউন্ডে দলে ভেড়ায় রিয়াল সোসিয়াদ। কিন্তু স্পেনের ফুটবলে আলো ছড়াতে পারেননি বর্তমানে কোরিয়া ফুটবল ফেডারেশনের নির্বাহী কমিটির সদস্য লি।

ফেডারেশনের কর্মকর্তা ও দেশের শীর্ষ লিগের একটি ক্লাবের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর হিসেবে তিনি নিজের দেশেই ‘প্রো’ কোর্সে অংশ নিতে পারতেন। কিন্তু লির কাছে যে বাংলাদেশ সৌভাগ্যের অন্য নাম, ‘আমার পেশাদার ফুটবলার–জীবনের সঙ্গেই বাংলাদেশের নাম জড়িয়ে। এখানে খেলে সাফল্য পেয়েছি। পরে অনেকবারই ভেবেছি, সুযোগ পেলে বাংলাদেশে আসব। যখন জানতে পারলাম বাংলাদেশে এমন একটা কোচেস কোর্স হবে, তখন এখানেই সেটি করার সিদ্ধান্ত নিই।’

বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপে লি–র সতীর্থ চই তাই–উক বর্তমানে কোরিয়া জাতীয় দলের সহকারী কোচ। লি–রও স্বপ্ন, একদিন দায়িত্ব নেবেন কোনো জাতীয় দলের। মায়ার বাঁধনে জড়ানো বাংলাদেশে কখনো ডাক পেলে সেটা হতে পারে এখানেও।