মরিনিওর অভিজ্ঞতাতেই রোমার মুক্তি?

এ এস রোমার নতুন কোচ হয়েছেন জোসে মরিনিওছবি : রয়টার্স

খোলা চোখে ড্যান ফ্রেডকিনকে নিঃসন্দেহে অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় একজন মানুষ হিসেবে আখ্যা দেওয়া যায়।

থ্রিলার ও ড্রামা ঘরানার সিনেমার দিকে প্রচণ্ড ঝোঁক, যুদ্ধবিমানও চালাতে পারেন অনায়াসে। ‘ডানকার্ক’ সিনেমাটার কথা মনে আছে? ওই যে ২০১৭ সালে মুক্তি পাওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওপর নির্মিত ক্রিস্টোফার নোলানের সেই সিনেমা, যেখানে একটি বিশেষ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বিখ্যাত সিনে তারকা টম হার্ডি। হার্ডির ‘স্টান্ট ডাবল’ হিসেবে ওই সিনেমায় যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর একটা ‘স্পিটফায়ার’ যুদ্ধবিমানও চালিয়ে দিয়েছিলেন এই ড্যান ফ্রেডকিন।

রোমার বর্তমান সভাপতি ড্যান ফ্রেডকিন
ছবি : টুইটার

তবে সিনেমার সঙ্গে ফ্রেডকিনের গাঁটছড়া শুধু এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়; বেশ কিছু বিখ্যাত সিনেমা পরিচালনা করেছেন, প্রযোজনা করেছেন। বলা বাহুল্য, সিনেমাগুলোর অধিকাংশই থ্রিলার বা ড্রামা ঘরানার। ক্লিন্ট ইস্টউডের ‘দ্য মিউল’, কিংবা রিডলে স্কটের ‘অল দ্য মানি ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’, ‘দ্য লাস্ট ভারমির’—প্রতিটি হয় পরিচালনা, না হয় প্রযোজনা করেছেন এই ভদ্রলোক। সামনে আসছে বিখ্যাত পরিচালক মার্টিন স্করসেজির ওয়েস্টার্ন ক্রাইম থ্রিলার ‘কিলারস অব দ্য ফ্লাওয়ার মুন’, সেখানে অভিনয় করবেন লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিওর মতো তারকা। সেখানেও প্রযোজকের তালিকায় নাম আছে ড্যান ফ্রেডকিনের।

উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া ব্যবসার হাল ধরেছেন, বিশ্বখ্যাত গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টয়োটার ফ্র্যাঞ্চাইজি পরিবেশক হিসেবে কাজ করে ফ্রেডকিন পরিবারের প্রাইভেট কোম্পানি ‘গালফ স্টেট টয়োটা’। যুক্তরাষ্ট্রে টয়োটার যত গাড়ি আর যন্ত্রাংশ বিকোয়, তার প্রায় ১৩ শতাংশই আসে এই কোম্পানির কল্যাণে। কিন্তু তা সত্ত্বেও থ্রিলার ও ড্রামা ঘরানার সিনেমার সঙ্গে ফ্রেডকিনের যোগ দেখলে তাঁকে অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষ না ভাবাটাই হয়তো অস্বাভাবিক!

রোমাকে শীর্ষে তোলার লক্ষ্য ফ্রেডকিনের।
ছবি : রোমা টুইটার

ওহ্‌, ফ্রেডকিনের আরেকটা পরিচয় দিয়ে রাখা ভালো। তিনি ইতালিয়ান ক্লাব এএস রোমার বর্তমান সভাপতি। যে মানুষ ব্যক্তিগত ও পেশাদার জীবনে একটু নাটকীয়তা পছন্দ করেন, পছন্দ করেন ‘থ্রিল’, তিনি ফুটবলে এসেও হুট করে দুনিয়া কাঁপিয়ে দেওয়া কাজ করবেন না, তা কি হয়?

কয়েক দিন আগে নিজেদের নতুন কোচ হিসেবে জোসে মরিনিওর নাম ঘোষণা করেছে রোমের লাল ক্লাবটা। হ্যাঁ, জোসে মরিনিও। রোমার মতো কোনো ক্লাব মরিনিওর মতো কাউকে নিজেদের কোচ হিসেবে পাবে, সেটা কে ভেবেছিল কবে? ফ্রেডকিনের কল্যাণে এখন এটাই বাস্তব। অবশ্য ফ্রেডকিনকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা হয়তো এই খবরে চমকাননি। ফ্রেডকিন তো এমনই!

মরিনিওর রোমায় আসার খবরটা যে কত বড় চমক হয়ে এসেছে, তা বোঝা যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রোমা–ভক্তদের প্রতিক্রিয়ায়। কোচ পাওলো ফনসেকার না থাকার প্রশ্নটা ‘কেন?’ থেকে ‘কবে?’–তে এসে ঠেকেছিল। মৌসুম শেষে ফনসেকা চলে গেলে রোমার হাল ধরতে কে আসবেন, সেটাই বরং রোমাভক্তদের চিন্তাভাবনার বড় অংশ দখল করে রেখেছিল। আলোচনায় ছিল মরিজিও সারির নাম। নাপোলি, চেলসি, জুভেন্টাসের সাবেক এই কোচের অধীনে রোমা আবারও নতুন করে শুরু করবে, এমনটাই প্রত্যাশা ছিল। ইতালিয়ান সংবাদমাধ্যম ‘গাজেত্তা দেল্লা স্পোর্ত’ তো সারির সম্ভাব্য আগমনের খবরে এতটাই নিশ্চিত ছিল যে এসি মিলানের সাবেক কোচ আরিগো সাচ্চির একটা সাক্ষাৎকারও ছাপিয়ে দিয়েছিল দুদিন আগে। প্রিয় বন্ধু সারি রোমায় এসে কীভাবে দলটাকে বদলে দেবেন—সাচ্চির বক্তব্যের প্রতি পরতে পরতে ছিল ইতিবাচকতার ছাপ।

ক্লিন্ট ইস্টউডের 'দ্য মিউল'-এর মতো সিনেমাও প্রযোজনা করেছেন ফ্রেডকিন।
ছবি : টুইটার

সারি আসছেন, আসবেন—এই খবরগুলোর মধ্যে হুট করে মরিনিওর আসার খবরটা অনেকটা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো এসেছে। তবে অবশ্যই ভালো দিক দিয়ে। কিন্তু ক্যারিয়ারের এই পর্যায়ে মরিনিও কি আসলেও রোমার মতো ক্লাবে এসে সফল হবেন?

রিয়াল মাদ্রিদ ছাড়ার পর মরিনিও যে জায়গাতেই গেছেন, বেশি দিন টিকতে পারেননি। সর্বশেষ চাকরিগুলোর সময়সীমা দিন দিন কমেছে। চেলসি, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে থেকেছেন আড়াই বছর করে, টটেনহামে তো আরও কম—দেড় বছরের মতো। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছাঁটাই হয়েছেন, প্রতি ক্ষেত্রে আরও ভালোভাবে নিশ্চিত হয়েছেন সবাই—মরিনিওর কৌশল আর চলে না। অন্তত প্রিমিয়ার লিগে তো না-ই। বলা যায় গত কয়েক বছরে শিরোপার চেয়ে বদনামই বেশি কুড়িয়েছেন এই কোচ।

তাই বলে মরিনিওর মতো কোচ হেরে যাবেন? কর্মহীন হয়ে বসে থাকবেন? মরিনিওরা তো হেরে বসে থাকার পাত্র নন! কিছুদিন আগে টটেনহাম থেকে ছাঁটাই যখন হলেন, জানা গেল, লন্ডনের ক্লাবটার কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ বাবদ পেয়েছেন ১ কোটি ৫০ লাখ পাউন্ড, যা শর্ত সাপেক্ষে ২ কোটি পাউন্ডও হতে পারে। তিনি চাইলেই বসে বসে ক্ষতিপূরণের টাকা তুলতে পারতেন, কোচিং না করিয়ে বিভিন্ন টিভি-চ্যানেলে ‘পণ্ডিতি’ করতে পারতেন। কিন্তু না। নিজেকে প্রমাণ করার একটা বিষয় তো ছিলই। যে প্রমাণ করার তাড়না থেকে আগের চাকরি যাওয়ার মাসখানেকের মধ্যে কম বেতনে আবারও ফিরেছেন কোচিংয়ে। ফিরছেন ইতালিতে, যে ইতালিতে এখনো তাঁকে সর্বজয়ী মানা হয়। ফিরছেন বদনাম ঘোচানোর লক্ষ্য নিয়ে।

ইন্টারে ট্রেবল জেতার সময়ে...
ছবি : টুইটার

দীর্ঘ ১১ বছর পর ইতালিয়ান ফুটবলে ফিরছেন মরিনিও। ২০০৮ সালে ইন্টার মিলানের দায়িত্ব নিয়ে যে দুই বছর ক্লাবটিতে ছিলেন, দুবার সিরি ‘আ’ জেতার সঙ্গে ২০১০ সালে সান সিরোর ক্লাবটিকে ‘ট্রেবল’ জিতিয়েছিলেন ‘স্পেশাল ওয়ান’খ্যাত এ কোচ। সেটা ছিল কোনো ইতালিয়ান ক্লাবের প্রথম ট্রেবল জয়। রোমাভক্তরা স্বপ্ন দেখবে নাই–বা কেন?

গত ১০ বছরে মরিনিও ম্যানেজার হিসেবে ছিলেন রিয়াল মাদ্রিদ, চেলসি, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও টটেনহামে। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই এই পর্তুগিজ কোচের সময়টা ঘুরেফিরে এক রকম। প্রথম এক-দুই মৌসুমে কিছু না কিছু জেতেন, জেতার পর থেকেই স্কোয়াডে ধরে ভাঙন, ফর্ম নামতে থাকে নিচের দিকে। ব্যর্থতার দায় ইনিয়ে-বিনিয়ে ফর্মহীন খেলোয়াড়দের ঘাড়েই চাপাতে থাকেন মরিনিও। তখন পর্তুগিজ এই কোচের সংবাদ সম্মেলনগুলো হয় দেখার মতো। পর্দার আড়ালে মরিনিওর পক্ষে-বিপক্ষে স্পষ্টত দুভাগ দেখা যায়। রিয়ালের কথা মনে নেই? মরিনিওর শেষ সময়ে শোনা গেল, দলের বেশ কিছু তারকা মরিনিওকে সহ্যই করতে পারছেন না। চেলসিতে নেমানিয়া মাতিচ, উইলিয়ান, এদেন হ্যাজার্ড কিংবা রামিরেসদের চোখের মণি হয়ে থাকলেও কেভিন ডি ব্রুইনা, হুয়ান মাতা, রোমেলু লুকাকুরা সহ্য করতে পারতেন না মরিনিওকে। শোনা গিয়েছিল, অধিনায়ক জন টেরির সঙ্গেও রয়েছে তাঁর বিরোধ।

স্পার্সে দেড় বছরের বেশি টিকতে পারেননি মরিনিও
ছবি: রয়টার্স

ইউনাইটেডে পল পগবা, আলেক্সিস সানচেজ, অ্যান্থনি মার্সিয়াল, লুক শ, বাস্তিয়ান শোয়াইনস্টাইগার—ওল্ড ট্রাফোর্ডের মরিনিও বন্ধুর চেয়ে হয়তো শত্রুই বানিয়েছেন বেশি। সর্বশেষ চাকরিক্ষেত্রেও বিরাগভাজন হয়েছেন উগো লরিস, টোবি অল্ডারভেইরেল্ড, গ্যারেথ বেলদের। মরিনিওর কৌশল পুরোনো, আধুনিক আক্রমণাত্মক ফুটবলের সঙ্গে যায় না, ইনিয়ে-বিনিয়ে লরিস এসব কথাই বলেছেন কোচের ছাঁটাই হওয়ার কিছুদিন আগে।

খোলা চোখে রোমায় মরিনিওর এমন সমস্যা হবে, মনে হচ্ছে না। কারণ, বছরের পর বছর ধরে যাদের সঙ্গেই মরিনিওর ঝামেলা বেধেছে, প্রত্যেকেই ওই ক্লাবের প্রতিষ্ঠিত তারকা ছিলেন। মূল একাদশের খেলোয়াড় ছিলেন। রোমায় কি এমন কেউ আছেন? দলের সাবেক অধিনায়ক বসনিয়ান স্ট্রাইকার এদিন জেকোর কথা বলা যায়। ৩৫ বছর বয়সী এই স্ট্রাইকার নিজেই আছেন রোমা ছাড়ার অপেক্ষায়, ইন্টার হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাঁকে। ফেদেরিকো ফাজিও, হাভিয়ের পাস্তোরে, স্তিভেন এনজনজি, আলেসসান্দ্রো ফ্লোরেঞ্জি-কেউই দলের গুরুত্বপূর্ণ কোন অংশ নন। বাকি থাকেন হেনরিখ মিখিতারিয়ান ও ক্রিস স্মলিং—যাঁদের প্রত্যেকের সঙ্গে অতীতে মরিনিওর বিরোধ থাকলেও ক্যারিয়ারের এই পর্যায়ে এসে তাঁদের তারকা বলা যায় কি না, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

পেলেগ্রিনি-ক্রিস্তান্তের মতো প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের রোমায় পাচ্ছেন মরিনিও।
ছবি : রোমা টুইটার

এ ছাড়া রোমা দলটাকে তারুণ্যনির্ভরই বলা যায়, যাঁরা নতুন কিছু শেখার অপেক্ষায় আছেন, কীভাবে জিততে হয়, সেটা শেখার অপেক্ষায় আছেন। রক্ষণভাগে জিয়ানলুকা মানচিনি, মারাশ কুমবুলা ও রজার ইবানেজ, মাঝমাঠে নিকোলো জানিওলো, লরেঞ্জো পেলেগ্রিনি, ব্রায়ান ক্রিস্তান্তে ও আমাদু দিয়াওয়ারা, আক্রমণভাগে জাস্টিন ক্লুইভার্ট ও চেঙ্গিজ উনদের—রোমার দলটায় প্রতিভার অভাব নেই। কিন্তু কীভাবে এদের দিয়ে কিছু জেতা যায়? সেটা শেখানোই মরিনিওর দায়িত্ব এখন।

যে দলে তেমন কোনো তারকা নেই, সেই দলের প্রত্যেকে যদি মরিনিওর কথা শোনে, তাহলে কী হতে পারে, সেটা ক্যারিয়ারের শুরুর দিকেই করে দেখিয়েছেন এই পর্তুগিজ ম্যানেজার। ২০০৪ সালের সেই পোর্তো দলটাকে কে চিনত? বেশ কয়েকজন প্রতিভাবান খেলোয়াড়ের পাশাপাশি সে দলে এমন কিছু খেলোয়াড় ছিলেন, যাঁরা তারকা না হলেও অভিজ্ঞতার দিক দিয়ে ছিলেন বেশ এগিয়ে।

পোর্তোর সেই দলটার মতো রোমার এই দলের আছে অভিজ্ঞতা ও তারুণ্যের মিশেল। তারকাখ্যাতির আড়ালে থাকা পোর্তোকে নিয়ে মরিনিও যা করে দেখিয়েছেন, রোমাকে নিয়েও সেটা করে দেখাতে পারবেন?
ছবি : উয়েফা

পোর্তোর ওই দলের সঙ্গে রোমার এই দলের তুলনা করা গেলে বেশ কিছু জিনিস চোখে পড়ে, চমক জাগায়। মোটামুটি ৪-৪-২ ছকে খেলে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছিল পোর্তো। চারজন মিডফিল্ডারের অবস্থান ছিল অনেকটা ‘ডায়মন্ডের’ মতো, চার কোনায় চারজন থাকতেন। নিচে আদর্শ রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার হিসেবে প্রতিপক্ষের আক্রমণ নষ্ট করে দেওয়ার পাশাপাশি নিজেদের আক্রমণ গড়ে তোলার কাজ করতেন ব্রাজিলের কস্তিনহা। পাশে দুই বক্স-টু-বক্স মিডফিল্ডার হিসেবে ইঞ্জিনের মতো ক্রমাগত ওঠানামা করে প্রতিপক্ষকে তটস্থ রাখতেন, হুটহাট বক্সে উঠে শট নিতেন দুই পর্তুগিজ ম্যানিশ আর পেদ্রো মেন্দেস। চার মিডফিল্ডার হিসেবে অপেক্ষাকৃত আক্রমণাত্মক হিসেবে খেলতেন ডেকো, ওপরে থাকা দুই স্ট্রাইকারকে আক্রমণ বানিয়ে দেওয়াই যাঁর মূল কাজ ছিল।

পেলেগ্রিনি, ক্রিস্তান্তে ও জর্দান ভেরেতুর মতো মিডফিল্ডাররা মেন্দেস কিংবা ম্যানিশের ভূমিকায় বেশ ভালোই মানিয়ে যেতে পারবেন, যদি মরিনিওর কথামতো চলতে পারেন। আর খেলোয়াড়ের প্রতিভা থাকলে মরিনিও যে মাঠের মধ্যে তাঁদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ করে দেন, সেটা রিয়াল মাদ্রিদে মরিনিওর অধীনে ওজিল, পোর্তোর হয়ে ডেকো কিংবা কিংবা চেলসিতে হ্যাজার্ডের ভূমিকা দেখলেই মোটামুটি অনুমান করা যায়। সে ভূমিকায় খেলার জন্য মরিনিওর হাতে এর মধ্যেই নিকোলো জানিওলোর মতো একজন ফুটবলার আছেন, যাকে ইতালিয়ান ফুটবলের আগামী দিনের অন্যতম বড় তারকা মানা হচ্ছে। ক্রমাগত চোট সমস্যা কাটিয়ে এই জানিওলো নিজেকে মরিনিওর অধীনে ফিরে পেলে খেলোয়াড়, কোচ ও ক্লাব—তিন পক্ষেরই লাভ।

রক্ষণভাগে দুই ফুলব্যাকের মধ্যে মরিনিও সব সময় একজনকে বেশি আক্রমণ করার লাইসেন্স দিতেন তখন, আরেকজনকে অপেক্ষাকৃত নিচেই থাকতে বলতেন, থাকতে বলতেন সাবধানী। পোর্তোতে লেফটব্যাক নুনো ভ্যালেন্তে, চেলসিতে অ্যাশলি কোল কিংবা ইন্টারে রাইটব্যাক মাইকন—নিজ নিজ দলের ফুলব্যাক জোড়ার মধ্যে অপেক্ষাকৃত আক্রমণাত্মক ভূমিকা এঁরাই পালন করতেন, যেখানে তাঁদের জুটির বাকিজন পাওলো ফেরেইরা (পোর্তো ও চেলসি) আর ক্রিস্টিয়ান কিভুর (লেফটব্যাক) মনোযোগটা মূলত রক্ষণেই থাকত। রোমার এই দলে বর্তমানে যে ফুলব্যাক জোড়া খেলছেন, এঁদের মধ্যেও একই রসায়ন দেখা যায়। লেফটব্যাক লিওনার্দো স্পিনাৎসোলা বেশি আক্রমণাত্মক, ওদিকে ডাচ রাইটব্যাক রিক কার্সডর্প সাবধানী।

টেরি-কারভালিওর মতো একাধিক তরুণ সেন্টারব্যাককে গড়ে তুলেছেন মরিনিও।
ছবি : টুইটার

তরুণ সেন্টারব্যাককে গড়ে তুলে বিশ্বসেরা বানানোর নজির মরিনিওর আছে বেশ। চেলসির জন টেরির কথাই ধরুন, কিংবা পোর্তোর রিকার্দো কারভালিও-মরিনিওর ছত্রচ্ছায়ায় আসার পরেই দুজনের খেলা আরও খোলতাই হয়েছে। একই কথা বলা চলে রিয়ালের সের্হিও রামোসের ক্ষেত্রে। মরিনিওর অধীনে রোমার প্রতিভাবান সেন্টারব্যাক মানচিনি, ইবানেজ কিংবা কুমবুলার যে–কারও মধ্যে যে সেই উন্নতির ছাপ দেখা যাবে না, বলা যায় না।

রোমাতে এসেই মরিনিও প্রথমে যে দুটি জিনিস চাইবেন, সেটা হলো একজন আদর্শ রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার ও একজন স্ট্রাইকার। আগে যে ক্লাবেই গিয়েছেন, নিজের পছন্দের একজন রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার কিনেছেন এই পর্তুগিজ কোচ। চেলসিতে প্রথম দফায় জন ওবি মিকেল ও মাইকেল এসিয়েন, ইন্টারে থিয়াগো মোত্তা, রিয়ালে সামি খেদিরা, চেলসির দ্বিতীয় দফায় ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে নেমানিয়া মাতিচ, টটেনহামে পিয়েরে এমিল হইবিয়া—সাধারণত নতুন কোনো ক্লাবে যাওয়ার পর সে ক্লাবের রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডারকে অত ভরসা করেন না মরিনিও। রোমাতেও অমন একটা কিছু দেখা যাবে, যদি আমাদু দিয়াওয়ারা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত না করতে পারেন।

দলে আন্দ্রেয়া বেলোত্তির মতো নতুন একজন স্ট্রাইকার চাইবেন মরিনিও।
ছবি : তোরিনো টুইটার

পোর্তোর সেই দলে মরিনিওর স্ট্রাইকার ছিলেন বেনি ম্যাকার্থি। দক্ষিণ আফ্রিকার যে স্ট্রাইকার সে মৌসুমে গোল করেছিলেন ২৫টি। মরিনিওর প্রতিটি দলেই এমন সব স্ট্রাইকার ছিলেন, যাঁরা মৌসুমে অন্তত ২০টির বেশি গোল করার যোগ্যতা রাখেন। যে কারণে চেলসিতে দিদিয়ের দ্রগবা ও দিয়েগো কস্তা, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে রোমেলু লুকাকু ও ইব্রাহিমোভিচ, ইন্টারে দিয়েগো মিলিতো ও সামুয়েল ইতো, রিয়ালে হিগুয়েইন ও বেনজেমা, টটেনহামে হ্যারি কেইনরা মরিনিওর অধীনে ঝলক দেখিয়েছেন। রোমাতেও এমন কাউকে লাগবে মরিনিওর। ৩৫ বছর বয়সী জেকোর ওপরে ভরসা রাখবেন না তিনি, এটা বলাই যায়। এর মধ্যে হয়তো তুরিনোর আন্দ্রেয়া বেলোত্তি কিংবা ফিওরেন্তিনার দুসান ভ্লাহোভিচকে পাওয়ার জন্য রোমা বোর্ডের কাছে আবদারও করে ফেলেছেন এই কোচ!

১০ বছর আগে টমাস দি বেনেদেত্তোর মাধ্যমে রোমায় যখন যুক্তরাষ্ট্রীয় মালিকানা এল, দলটার লক্ষ্য ছিল আধুনিক ফুটবলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন ধ্যানধারণা ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল দিয়ে শিরোপা জেতার চেষ্টা করা। যে লক্ষ্যে প্রথমেই দলটায় আসেন বার্সেলোনা ‘বি’ দলের সাবেক কোচ লুইস এনরিকে। স্পেনের কল্যাণে টিকিটাকার বাজার তখন রমরমা। রোমাও ভেবেছিল, স্পেনের তরুণ কোনো ম্যানেজার এসে তাদেরকেও ইতালির সেরা ক্লাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবেন, যে অব্যর্থ কৌশল শ্রেষ্ঠত্বের স্বাদ পাইয়ে দিয়েছে স্পেন জাতীয় দলকে, বার্সেলোনাকে।

রোমার সমর্থকেরা মরিনিওকে নিয়ে এতটাই আশাবাদী, এর মধ্যেই শহরের এক দেয়ালে মরিনিওর ম্যুরাল বানিয়ে বসেছে!
ছবি : রয়টার্স

লাভ হয়নি। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জড়িয়ে ক্লাব ছাড়েন এনরিকে। পরে আরেক তরুণ ম্যানেজার আন্দ্রে ভিয়াস বোয়াসকে আনার চেষ্টা চালিয়েছিল রোমা, পারেনি। লিলের হয়ে লিগ আঁ জেতা রুডি গার্সিয়া, নিজেদের লিগের তরুণ প্রতিভা ইউসেবিও দি ফ্রান্সেসকো কিংবা শাখতারে কম বয়সে আলো ছড়ানো পাওলো ফনসেকাদের আনার পেছনেও সেই দীর্ঘমেয়াদি চিন্তাভাবনাই কাজ করেছিল রোমার। অবশ্য মাঝখানে যে লুসিয়ানো স্পালেত্তি, ক্লদিও রানিয়েরি কিংবা জদেনেক জেমানের মতো ‘বুড়ো’রা আসেননি, তা নয়। তবে রোমায় তাঁদের ভূমিকাটা ছিল পরবর্তী তরুণ কোচ আসার আগপর্যন্ত দলটাকে ঠিকঠাক করে দিয়ে যাওয়া। কাউকেই দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য বেঁধে দেয়নি রোমা। স্প্যালেত্তি, রানিয়েরিরা থাকলেও, রোমা সব সময় খুঁজে গেছে সেই তরুণ একজনকে, যার অভিনব চিন্তাধারায় এগিয়ে যাবে দলটা।

ফনসেকার কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নেবেন মরিনিও।
ছবি : রোমা টুইটার

১০ বছর পর এনরিকে, গার্সিয়া, দি ফ্রান্সেসকো কিংবা ফনসেকাদের ব্যর্থ হতে দেখে অবশেষে রোমার মনে হয়েছে, তারুণ্যে ভরসা রেখে লাভ নেই। ভরসা রাখতে হবে অভিজ্ঞতাতেই। ভরসা রাখতে হবে এমন একজনের ওপর, যিনি জিততে জানেন, জেতাতে শেখান।

আন্তোনিও কন্তের পর সিরি ‘আ’–এর ইতিহাসে যে ম্যানেজার ম্যাচপ্রতি সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট জোগাড় করেছেন, যিনি একমাত্র ম্যানেজার হিসেবে ইতালিতে ট্রেবল জিতেছেন—রোমার পরিবর্তিত সেই লক্ষ্যের জন্য উপযুক্ত ম্যানেজার মরিনিও হবেন না তো কে হবেন?