বন্ধু হতে চেয়ে চেলসির শত্রু বলে গণ্য হচ্ছেন লুকাকু

ফর্মে নেই লুকাকুছবি : রয়টার্স

মৌসুমের শুরুতে বলা হচ্ছিল, চ্যাম্পিয়নস লিগজয়ী চেলসিকে পরের ধাপে নিয়ে যেতে পারে একজন পাকা গোলশিকারি। যিনি ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে ম্যানচেস্টার সিটি আর লিভারপুলের সঙ্গে চেলসির ব্যবধান ঘোচাতে পারবেন, ২০১৭ সালের পর চেলসিকে আবারও দিতে পারবেন লিগ শিরোপার স্বাদ। আগের মৌসুমেই টিমো ভেরনারকে দলে এনে তেমন সুফল না পাওয়া চেলসির মূল পছন্দ ছিলেন বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের আর্লিং হরলান্ড। কিন্তু হরলান্ডকে বিক্রি করার ইচ্ছে ডর্টমুন্ডের ছিল না।

চেলসির নজর ঘোরায় নিজেদেরই সাবেক খেলোয়াড় রোমেলু লুকাকুর ওপর। মৌসুমে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৩০ গোল করে ইন্টার মিলানকে তত দিনে লিগ জিতিয়েছেন এই বেলজিয়ান তারকা, খর্ব করেছেন জুভেন্টাসের আধিপত্য। মাত্র দুই বছর আগে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে লুকাকু যে কতটা বাজে খেলেছিলেন, ইন্টারের হয়ে বেলজিয়ান তারকার ঝলক দেখে সেটা মনে থাকল না চেলসির। এক লহমায় ৯ কোটি ৭৫ লাখ পাউন্ড খরচ করে লুকাকুর হাতে ধরিয়ে দেওয়া হলো চেলসির জার্সি।

ছবি : রয়টার্স

লুকাকুর জন্য এত টাকা খরচ করার ব্যাপারটা পছন্দ হয়নি চেলসির সাবেক কিংবদন্তি জিয়ানফ্রাঙ্কো জোলার। বিইনস্পোর্তকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জোলা তখন বলেছিলেন, লুকাকুকে দলে আনলে চেলসির আক্রমণভাগের পরিশ্রম করার সম্মিলিত হার কমে যাবে। জোলার কথায় বিশ্বাস করার মতো মানুষ তখন সেভাবে পাওয়া না গেলেও চার মাস পর লুকাকুর খেলা জোলার কথাকেই সত্যি প্রমাণ করছে যেন।


গত রাতে ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে লুকাকুর পারফরম্যান্সের দিকে নজর দেওয়া যাক। ৩-৪-৩ ছকে চেলসির একক স্ট্রাইকার হিসেবে খেলেছেন লুকাকু। পেছনে ছিলেন দুই ফরোয়ার্ড হাকিম জিয়াশ ও ক্রিস্টিয়ান পুলিসিক। প্রথাগত উইঙ্গারের মতো সাইডলাইন বরাবর দৌড়ানো, ক্রস করা কিংবা গোলে সহায়তা নয়, যাদের ভূমিকা ছিল লুকাকুর পেছনে অনেকটা ‘নাম্বার টেন’ হিসেবে খেলা। লুকাকু যাতে প্রথাগত স্ট্রাইকারের মতো ডি-বক্সে থাকতে পারেন, গোল করার দিকে মনোযোগ দিতে পারেন।

জোলার সেই সাক্ষাৎকার
ছবি : টুইটার

এমনিতেই চোটের কারণে চেলসির কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ দুই ফুলব্যাক রিস জেমস আর বেন চিলওয়েল ছিলেন না, একাদশে মেসন মাউন্ট, কাই হাভার্টজ, ক্যালাম হাডসন-অদয় কিংবা টিমো ভেরনারকেও রাখা হয়নি। যারা লুকাকুর মতো অত বেশি গোল না করতে পারলেও আক্রমণভাগে থেকে প্রতিপক্ষকে প্রেস করার কাজটা ভালোভাবে করতে পারেন। এখানে বলে রাখা ভালো, গত চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে সিটির বিপক্ষে লড়তে মূল একাদশে মাউন্ট, ভেরনার আর হাভার্টজকে রাখা হয়েছিল আক্রমণভাগে খেলার জন্য। জয়সূচক গোলটাও এসেছিল হাভার্টজের পা থেকে।

পুরো ম্যাচে রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডারবিহীন সিটিকে সফলভাবে প্রেস করেছিলেন এই তিনজন। কয়েক মাস পর ফিট থাকা সত্ত্বেও মূল একাদশ ঘোষণার সময় এই তিনজনের কথা বেমালুম ভুলে গেলেন চেলসির কোচ টমাস টুখেল। শুধু তাই নয়, কয়েক দিন আগেই লেস্টার সিটিকে চেলসির যে দলটা ৩-০ গোলে হারিয়েছিল, সে ম্যাচে অল ব্লুজদের আক্রমণভাগে খেলেছিলেন মাউন্ট, হাভার্টজ আর হাডসন-অদয়। লুকাকুকে নিয়মিত খেলানোর লোভে সে ম্যাচের পর এই তিনজনকে একসঙ্গে মূল একাদশে নামাননি টুখেল।

মেসন মাইন্টকে খেলানো হয়নি কাল
ছবি : রয়টার্স

একাদশ ঘোষণার সময় টুখেল জানালেন, মাউন্টের চেয়ে পুলিসিক আর জিয়াশ বেশি ফিট, এই ম্যাচের জন্য বেশি দৌড়াদৌড়ি/প্রেস করতে পারবেন। এক দিক দিয়ে চিন্তা করলে টুখেলের কথা সত্যি, কারণ মাত্র দুই দিন আগে টটেনহামের বিপক্ষে লিগ কাপের ম্যাচে ভেরনার, মাউন্ট, হাডসন-অদয়ের প্রত্যেকেই মূল একাদশে ছিলেন। মাউন্ট আর পুলিসিক ছিলেন না।

তা সত্ত্বেও এমন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে লুকাকুর পেছনে এ দুজনকে খেলানোর সিদ্ধান্তটা যে কতটা ভুল ছিল, সেটা বোঝা গেল ৬৯ মিনিটের মাথায় টুখেল যখন দুজনের জায়গায় ভেরনার আর হাডসন-অদয়কে নামালেন। হয়তো অনুচ্চারে চেলসি কোচ এ বদলের মাধ্যমে নিজের ভুলই স্বীকার করে নিলেন।

আলো ছড়াতে পারেননি পুলিসিক
ছবি : রয়টার্স

আগেই বলা হয়েছে, এ ম্যাচে পুলিসিক আর জিয়াশকে অনেকটা ‘নাম্বার টেন’ হিসেবে খেলাতে চেয়েছিলেন টুখেল। যেখানে দুজনই প্রয়োজন অনুযায়ী কখনো নাম্বার টেন, বা কখনো উইংব্যাক হিসেবে খেলতে পারেন। কিন্তু দুজনের কেউই ঠিকভাবে প্রেসও করতে পারেন না, যে কারণে সিটির ফুলব্যাক জোয়াও কানসেলো মাঝমাঠে অনেক জায়গা পেয়ে যাচ্ছিলেন। সিটির একমাত্র গোলটাও এসেছে কানসেলোর সহায়তা থেকেই। শুধু তাই নয়, মাঝমাঠ থেকে দুই সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার মাতেও কোভাচিচ আর এনগোলো কান্তে প্রতিপক্ষের কাছ থেকে বল কেড়ে নিয়ে দ্রুত আক্রমণ শুরু করতে চাইলেও জিয়াশ আর পুলিসিকের কারণে সেটা হচ্ছিল না।


আবারও আসা যাক লুকাকু প্রসঙ্গে। কিছুদিন আগে স্কাই স্পোর্তস ইতালিয়াকে দেওয়া মহা বিতর্কিত সেই সাক্ষাৎকারে টুখেলের পছন্দের ৩-৪-৩ ছকে একক স্ট্রাইকার হিসেবে খেলতে তাঁর অসুবিধার কথা জানিয়েছিলেন লুকাকু। গত রাতের ম্যাচ সে অসুবিধাকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল আরেকবার। দীর্ঘদেহী ও শক্তিশালী গড়নের হওয়ার কারণে একক স্ট্রাইকার হিসেবে লুকাকু সফল হবেন, বক্সে দাঁড়িয়ে লম্বা পাস বা উড়ন্ত বলগুলো দখলে এনে গোল করবেন, শক্তির খেলায় ডিফেন্ডারদের হারাবেন, এমন একটা গৎবাঁধা ধারণা সব সময়ই ছিল। কিন্তু সে কাজে লুকাকু বরাবরই ব্যর্থ হয়েছেন।

জিয়াশ আর পুলিসিক দুজনকে নাম্বার টেন হিসেবে খেলানোর কারণে লুকাকুকে প্রথাগত স্ট্রাইকার হিসেবে খেলতে হচ্ছিল। এই ভূমিকায় লুকাকু যে কখনই ভালো ছিলেন না, আবারও বোঝা গেছে। প্রমাণ হয়েছে জোলার সেই কথাটা। ন্যূনতম প্রেসও করেননি, বল পায়ে নিয়ে প্রথমবার নিয়ন্ত্রণের (ফার্স্ট টাচ) ক্ষেত্রেও কখনোই ভালো করতে পারেননি। একটু নিচে নেমে বল ধরে রেখে বক্সে ঢুকে যাওয়া আগুয়ান মিডফিল্ডার বা উইঙ্গারের দিকেও যে বল পাঠাবেন, সে কাজটাও কখনো ভালো করতে পারতেন না।

মাঠে লুকাকুর অবস্থান, প্রেসের নমুনা
ছবি : সংগৃহীত

কালও পারেননি। কার্যকরী প্রেসের মুখে ভেঙে পড়েছেন। দুজনের জায়গায় লুকাকুর সঙ্গে যদি একজন থাকতেন, ছকটা যদি ৩-৪-৩ না হয়ে ৩-৪-১-২ বা ৩-৫-২ হতো, তাহলে সহকারী স্ট্রাইকারের সঙ্গে জুটি বেঁধে ভালো খেলতে পারতেন, ইন্টারে থাকার সময়ে যে কাজটা সফলভাবে করতেন লাওতারো মার্তিনেজের সঙ্গে। প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের পেছনে জায়গা বের করে দৌড়ে সেখানে গিয়ে পেছনে থাকা ফুলব্যাক বা মিডফিল্ডারদের মাটিঘেঁষা পাস আয়ত্তে এনে গোল করাই লুকাকুর সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা। লুকাকুকে সেখানেই সহায়তা করতে ব্যর্থ হয়েছেন জিয়াশ আর পুলিসিক। দুই ফরোয়ার্ডের সঙ্গে লুকাকুর রসায়ন একদমই জমছিল না। সফল পাস দিয়েছেন ৫৮ শতাংশ সময়ে, মাত্র সাতটা সফল পাস দিয়েছেন।

বিটি স্পোর্টসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে টুখেল নিজেই লুকাকুর সমালোচনা করেছেন ম্যাচ শেষে। বলেছেন, ‘মাঝে মাঝে লুকাকুর নিজেকেই নিজেকে সাহায্য করতে হবে (গোল করার জন্য)। গোল করার জন্য ভালো সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এমন অনেক সময়ে সে বলের দখল হারিয়েছে। অনেক গোলের সুযোগ নষ্ট করেছে। অবশ্যই আমরা চাই গোল করার ক্ষেত্রে ওকে সাহায্য করতে। কিন্তু সেও দলের অংশ। ওকেও ভালো খেলতে হবে। তাহলেই দল হিসেবে আমরা ভালো করতে পারব।’


লুকাকু যেন চ্যাম্পিয়নস লিগজয়ী চেলসিকে পরের ধাপে নিয়ে যেতে এসে আরও দুই ধাপ পিছিয়ে দিচ্ছেন!