বসুন্ধরা কিংসের লড়াইটা মাঝমাঠে

মাঝমাঠের লড়াইয়ে রবসনরা পারবেন তো?ছবি : প্রথম আলো

এবার ফেডারেশন কাপের খেলাগুলো যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা নিঃসন্দেহে একটা বিষয়ে একমত হবেন, শক্তিমত্তা-ফর্ম কিংবা কৌশলের দিক দিয়ে যে দুটি দল যোগ্যতর, তারাই উঠেছে ফাইনালে। বসুন্ধরা কিংস ও সাইফ স্পোর্টিং ক্লাবের মধ্যে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ফেডারেশন কাপের ফাইনাল ম্যাচটা তাই দেশীয় ফুটবলভক্তদের জিবে পানি এনে দেওয়ার মতো একটা উপলক্ষ।

কিন্তু এই লড়াইয়ে কে এগিয়ে? ম্যাচ জয়ের চাবিকাঠিটা লুকিয়ে আছে কোন জায়গায়? একটু গভীরভাবে ভেবে দেখলে সবার আগেই চোখে পড়ে দুই দলের মাঝমাঠ। বর্তমান চ্যাম্পিয়ন বসুন্ধরা কিংসের কোচ অস্কার ব্রুজোন নিয়মিতভাবেই দলকে খেলাচ্ছেন ৪-১-৪-১ ছকে। যে ছকে একজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার মাসুক মিয়া জনির ওপরে খেলছেন দুই কুশলী ব্রাজিলিয়ান জোনাথন ফার্নান্দেজ ও রবসন দে সিলভা। দুই উইঙ্গারের ভূমিকায় মাহবুবুর, মতিন, ইব্রাহিম, বিপলুদের মধ্যে যে দুজনই খেলুন না কেন, রবসন-জোনাথন যেন ওপরে থাকা রাউল বেসেরার সঙ্গে নিয়মিত সংযোগ ঘটাতে পারেন, সে কারণে ব্রাজিলিয়ান দুজনের ওপর থাকা রক্ষণ দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিতে হয় দুই দেশি উইঙ্গারকে। কাগজে-কলমে ৪-১-৪-১ ছকে উইঙ্গারদের দায়িত্বটা তেমনই হয়, বসুন্ধরা কিংসও তাঁর ব্যতিক্রম নয়।

এই ৪-১-৪-১ ছক আবার আক্রমণে পরিবর্তিত হয়ে ৪-৩-৩–এ রূপ নেয়। এই ছকটা আবার সাইফ স্পোর্টিংয়ের নিজস্ব। মোটামুটি টুর্নামেন্টজুড়ে বেলজিয়ান কোচ পল পুট দলকে এই ৪-৩-৩ ছকেই খেলাচ্ছেন। এই ছকে সাইফকে খেলানোর জন্য তিনজন মিডফিল্ডার হিসেবে পুট এমন তিনজনকে বেছে নিয়েছেন, মিডফিল্ডার হিসেবে যাদের প্রত্যেকের বৈশিষ্ট্য আলাদা আলাদা এবং একজনের বৈশিষ্ট্য আরেকজনের আপাত দুর্বলতাকে ঢেকে দেয়। ফলে দলটায় যে নিয়মিত অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া নেই, মনেই হচ্ছে না। জামালের জায়গায় সাইফ দলে ভিড়িয়েছিল সিরোজিদ্দিন রাখমাতুল্লেভকে। এই উজবেক এতটাই ভালো খেলছেন, অনেকের মতে, জামালের অভাব তো তিনি পূরণ করেছেনই, জামালকে ছাড়িয়েও গেছেন এর মধ্যে।

বসুন্ধরার সম্ভাব্য ছক।
ছবি : প্রথম আলো

ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হওয়ার কারণে রাখমাতুল্লেভের খেলার ধরনটা স্বভাবতই সাবধানী। রক্ষণে থাকা দুই সেন্টারব্যাক রিয়াদুল-ইমানুয়েল কিংবা পাশে থাকা আরেক মিডফিল্ডার শাহেদকে বাড়তি রক্ষণ নিরাপত্তা দিয়ে তবেই ওপরে ওঠার ব্যাপারে চিন্তা করেন এই উজবেক। পাশে থাকা শাহেদের খেলার ধরনটা অনেকটা ডিপ লায়িং প্লেমেকারের মতো। ইউরোপীয় ফুটবলে এই বিশেষ ভূমিকায় সাধারণত দেখা যায় আন্দ্রেয়া পিরলো, জাভি হার্নান্দেজ, জাবি আলোনসো, লুকা মদরিচ, জর্জিনিও, মাইকেল ক্যারিক কিংবা পল স্কোলসের মতো তারকাদের। শাহেদকে এখনই ওসব মহারথীদের সঙ্গে তুলনা দেওয়াটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে, কিন্তু তাঁদের সঙ্গে খেলার ধরনের দিক দিয়ে মিল আছে বৈকি!

সাইফের সম্ভাব্য ছক
ছবি : প্রথম আলো

শাহেদের তেমন গতি আছে, বলা যাবে না। আদর্শ রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডারের মতো বল কেড়ে নেওয়া, কড়া ট্যাকল করা, প্রতিপক্ষকে ধাওয়া করা, এসবও কোচ চান না তাঁর কাছ থেকে। একদম নিচে থেকে উইংয়ে ফাহিম কিংবা আরিফুর, কিংবা স্ট্রাইকার এনগোকের কাছে পাঠানো নিখুঁত লং বলগুলো নজরে পড়ে অনেক। শাহেদের এই আপাত গতিহীনতা আবার সামলে দেন জন ওকোলি। নাইজেরিয়ার এই মিডফিল্ডার আদর্শ বক্স-টু-বক্স মিডফিল্ডারের মতো ক্রমাগত ওঠানামা করতে থাকেন। মাঝমাঠের একটু বাঁ দিকে অবস্থান করে প্রতিপক্ষের হাফ স্পেসটা (আক্রমণাত্মক মিডফিল্ড ও উইংয়ের মাঝের জায়গাটা) নিয়মিত দখলে রাখেন এই নাইজেরিয়ান।

ওকোলির এই অবস্থানের কারণে শাহেদের পাশাপাশি সুফল পান লেফট উইঙ্গার ফাহিম এবং লেফটব্যাক ইয়াসিন আরাফাত। সাইডলাইনটা নিজের করে খেলতে পারেন, সুযোগমতো কাট-ইন করে ভেতরেও ঢোকেন বেশ। চলমান ফেডারেশন কাপে উইঙ্গার হিসেবে ফাহিম ও আরিফুরের বুদ্ধিমত্তা নজরে পড়েছে বেশ। আর ইয়াসিনকে তো বর্তমান সময়ে দেশসেরা লেফটব্যাক বললেও খুব বেশি ভুল বলা হবে না। বসুন্ধরার ডান দিকে থাকা দুই খেলোয়াড় রাইটব্যাক বিশ্বনাথ ও রাইট মিডফিল্ডার মতিন মিয়া কিংবা বিপলু আহমেদ সাইফের শক্তিশালী বাঁ দিকটা কীভাবে সামাল দেন, তাঁর ওপরেও হয়তো ম্যাচের ফলাফল নির্ভর করবে অনেকাংশে। সাইফের এই বাঁ দিক সামলাতে হয়তো অনেক সময় ব্যস্ত থাকতে হতে পারে বসুন্ধরার ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার মাসুক মিয়া জনির। গত দুই ম্যাচে এই লম্বা চুলের ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার যেমন খেলছেন, যেভাবে জোনাথন-রবসনদের ওপরে ওঠার লাইসেন্স দিচ্ছেন, তাতে উল্টো সাইফের বাঁ দিকের খেলোয়াড়দেরই হয়তো চিন্তার কারণ হয়ে যেতে পারেন মাসুক মিয়া।

ম্যাচের ফলাফল নির্ভর করবে ওকোলি ও বসুন্ধরা কিংসের জোনাথন ফার্নান্দেজের মধ্যকার দ্বৈরথের ওপরও। সাইফে ওকোলি যা করেন, বসুন্ধরায় জোনাথনও সেটাই করছেন। কিংবা হয়তো বলা যায়, ওকোলির চেয়েও ভালো করছেন। আদর্শ ব্রাজিলিয়ান বক্স-টু-বক্স মিডফিল্ডারের সঙ্গে ব্রাজিলিয়ান সাম্বার মিশেল জোনাথনকে করে তোলে ভয়ংকর।

তবে ওকোলির সঙ্গে তাঁর পাশে থাকা উইঙ্গারের রসায়নটা যেমন, বসুন্ধরার মিডফিল্ডারদের সঙ্গে উইঙ্গারদের রসায়নটা আবার তত ভালো নয়। সেমিফাইনালের কথাই ধরুন, ঢাকা আবাহনীর বিপক্ষে ম্যাচটায় ৪-১-৪-১ ছকে দুই উইঙ্গার হিসেবে মাহবুবুর আর বিপলুর ওপর ভরসা রেখেছিলেন কোচ অস্কার ব্রুজোন। মানসম্মত খেলতে না পারার কারণে প্রথমার্ধ শেষেই তাঁদের জায়গায় মতিন মিয়া ও আলমগীর রানাকে নামানো হয়। বসুন্ধরার দুই বিদেশি মিডফিল্ডার রবসন দে সিলভা, জোনাথন এবং স্ট্রাইকার রাউল বেসেরা—প্রত্যেকেই মাঝখান দিয়ে খেলতে পছন্দ করেন। সেটা সুফল বয়ে আনত যদি দুই ফুলব্যাক বিশ্বনাথ (রাইটব্যাক) ও রিমন (লেফটব্যাক) এবং দুই উইঙ্গার সাইডলাইন ঘেঁষে এক পাশ দিয়ে ক্রমাগত ওঠানামা করতে পটু হতেন। বিশ্বনাথের রক্ষণ কাজ নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ না থাকলেও আক্রমণে উঠলে তাঁর সফল ক্রস করার হার কিংবা আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের সঙ্গে তাঁর রসায়ন কেমন, সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। ওদিকে রিমন হোসেন প্রথম ম্যাচে আলো ছড়ালেও পরের ম্যাচগুলোতে বুঝিয়েছেন, আদর্শ লেফটব্যাক হওয়ার জন্য কৌশলগতভাবে যেসব জিনিস মাথায় রাখতে হয়, সেসব দিকে তাঁর উন্নতির আরও অনেক জায়গা আছে। গতিশীল উইঙ্গারের সঙ্গে মাঝে মাঝেই যে রিমন খেই হারিয়ে ফেলেন, সেমিতে ঢাকা আবাহনীর কেরভেন্স বেলফোর্টই সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন।

রাউল কী পারবেন ফাইনালেও গোল করতে?
ছবি : প্রথম আলো

প্রতিপক্ষ উইঙ্গারদের সামলাতে একটু অস্বস্তি হওয়ার কারণেই কি না, রিমন ওপরে উঠছেন কম। ফলে তাঁর দিক থেকে ওভারল্যাপিংয়ের কাজটা অপ্রত্যাশিতভাবে করতে হচ্ছে ইরানি সেন্টারব্যাক খালেদ শাফিকে। বল পায়ে দক্ষ হওয়ার কারণে টুর্নামেন্টে বেশ অনেকবার নিচ থেকে বল পায়ে একদম ওপরে উঠে যেতে দেখা গেছে খালেদকে। কখনো কখনো তো পাকা উইঙ্গারের মতো বক্সে থাকা রাউল-জোনাথনদের ক্রসও দিয়েছেন!

কোচ অস্কার এখনো নিশ্চিত নন, তাঁর মূল একাদশের মূল উইঙ্গার যুগল কে কে। নিশ্চিত না থাকার কারণও এটাই। মাহবুবুর, মতিন, বিপলু, আলমগীর কিংবা ইব্রাহিমদের কেউই এখনো এই টুর্নামেন্টে চোখধাঁধানো কিছু করে দেখাতে পারেননি। ওদিকে সাইফের এই সমস্যা নেই। ফয়সাল আহমেদ ফাহিম আর আরিফুর রহমান মিলে কোচের এই চিন্তা দূর করেছেন এখন পর্যন্ত। দুই দলের উইঙ্গারদের কার্যকারিতার দিকেও নজর থাকবে এই ম্যাচে।

এমন উচ্ছ্বাসে আজকেও মাততে চাইবে সাইফ।
ছবি : প্রথম আলো

লড়াইটা দুই দলের দুই প্রধান স্ট্রাইকার রাউল বেসেরা (বসুন্ধরা) ও ইকেচুকু কেনেথ এনগোকেরও (সাইফ)। সাইফ স্পোর্টিংয়ের জার্সিতে বাংলাদেশে প্রথমবার খেলতে এসেই গোল পাচ্ছেন কেনেথ। ৪ ম্যাচে ৫ গোল করে দলকে নিয়ে এসেছেন ফেডারেশন কাপের ফাইনালে। টুর্নামেন্টে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ গোলদাতা তিনি। শারীরিক শক্তি ও গতির দিক দিয়ে এনগোকের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার তেমন কেউ না থাকলেও বল পায়ে স্বাচ্ছন্দ্য কিংবা ওকোলি, ফাহিম, আরিফুরদের সঙ্গে রসায়নের জায়গাটায় তাঁর একটু খামতি চোখে পড়েই। বসুন্ধরার লক্ষ্য থাকবে এনগোকের সে দুর্বলতাটাকে কাজে লাগানো। ওদিকে এনগোকের সঙ্গে সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার লড়াইয়ে আছেন বসুন্ধরার আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার রাউল বেসেরা। এখন পর্যন্ত চার ম্যাচেই টানা গোল করেছেন আর্জেন্টিনার এই স্ট্রাইকার। ৪ গোল করে টুর্নামেন্টে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা বেসেরা। আজ তাঁর চেষ্টা থাকবে ইকেচুকুকে ছাপিয়ে যাওয়ার। বসুন্ধরার খেলোয়াড়দের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘদেহী তিনিই। ৬ ফুট ২ ইঞ্চি উচ্চতা কাজে লাগিয়ে হেডে গোল করতে বেশ দক্ষ। তাঁর ৪ গোলের ২টি হেডে। তবে পূর্বসূরি দানিয়েল কলিন্দ্রেস যেমন নিচে নেমে এসে খেলা গড়ে দেওয়ার ব্যাপারে ভূমিকা রাখতেন, বল পায়ে কুশলী ছিলেন, রাউল ঠিক অমন নন। এই আর্জেন্টাইন পুরোদস্তুর পেনাল্টি বক্সের গোলশিকারি। গোলের সুযোগ নষ্টও যেমন করেন, প্রতি ম্যাচে ধারাবাহিকভাবে গোলও করেন।

সব মিলিয়ে উত্তেজনাপূর্ণ এক ফাইনালের অপেক্ষায় বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম!

বসুন্ধরা কিংসের সম্ভাব্য একাদশ: আনিসুর রহমান জিকো, বিশ্বনাথ ঘোষ, খালেদ শাফি, তপু বর্মণ, রিমন হোসেন, মাসুক মিয়া জনি, জোনাথন ফার্নান্দেজ, রবসন দে সিলভা, মাহবুবুর রহমান সুফিল, মতিন মিয়া, রাউল বেসেরা

সাইফ স্পোর্টিংয়ের সম্ভাব্য একাদশ: পাপ্পু হোসেন, রহমত মিয়া, ইমানুয়েল আরিওয়াচুকু, রিয়াদুল হাসান রাফি, ইয়াসিন আরাফাত, শাহেদুল আলম, জন ওকোলি, সিরোজিদ্দিন রাখমাতুল্লেভ, ফয়সাল আহমেদ ফাহিম, আরিফুর রহমান, কেনেথ এনগোকে।