বসুন্ধরার বিপক্ষে ‘হ্যাটট্রিক’ কোচ হতে পারলেন না মারুফুল

টানা তৃতীয়বার নিজের দল চট্টগ্রাম আবাহনীকে বসুন্ধরার বিপক্ষে জেতাতে পারলেন না মারুফুল হকছবি: প্রথম আলো

লড়াইটা ছিল দুই ক্ষুরধার কোচের মস্তিষ্কের। দুই দলই নিজেদের প্রথম ম্যাচ জিতেছে রহমতগঞ্জের বিপক্ষে, ফলে দুই দলই উঠে গিয়েছিল কোয়ার্টার ফাইনালে। অপেক্ষা ছিল দেখার, কে কোয়ার্টারে যায় গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে। সঙ্গে অস্কার-মারুফুলের প্রজ্ঞার লড়াইয়ের বিষয়টা তো ছিলই।

তারকায় ঠাসা স্কোয়াড নিয়েও দেশীয় কোচ মারুফুলের কৌশলের কাছে এর আগে দুবারই পরাস্ত হয়েছেন অস্কার ব্রুজোন। এবারও ব্রুজোনকে হারিয়ে জয়ের হ্যাটট্রিক করতে পারেন কি না, দেশীয় ফুটবলভক্তদের আগ্রহ ছিল এই ব্যাপারটাতেও। সে হ্যাটট্রিক হতে দেননি অস্কার। দলে নতুন আসা আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার রাউল বেসেরাই সেটা হতে দেননি বরং। মারুফুলের চট্টগ্রাম আবাহনীকে ১-০ গোলে হারিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েই কোয়ার্টারে নাম লিখিয়েছে বসুন্ধরা কিংস।

হারলেও চট্টগ্রাম আবাহনী বসুন্ধরার দুর্বলতাগুলোকে ফুটিয়ে তুলেছে।
ছবি: প্রথম আলো

ম্যাচ জিতলেও বসুন্ধরার খেলায় কিছু কিছু দুর্বলতা চোখে পড়েছে। আগের ম্যাচে দলটার দুই ফুলব্যাক বিশ্বনাথ ঘোষ ও আর রিমন হোসেন খেলেছিলেন দুর্দান্ত। ক্রমাগত ওপরে উঠে ক্রস করছিলেন, প্রয়োজনমতো নিচে নেমে রক্ষণে সাহায্য করছিলেন। দুই দেশীয় ফুলব্যাকের দুরন্ত ফর্ম আশা জোগাচ্ছিল জাতীয় দলের সমর্থকদের। কিন্তু এটাও মাথায় রাখা উচিত, প্রথম ম্যাচে রহমতগঞ্জ সে রকম প্রস্তুতি ছাড়াই নেমেছিল। দলে বিদেশি ছিল মোটে একজন। এমন দুর্বল এক দলের বিরুদ্ধেই ছড়ি ঘুরিয়েছিলেন রিমন-বিশ্বনাথরা।

স্বাভাবিকভাবেই শক্তিমত্তার দিক দিয়ে দিয়ে চট্টগ্রাম আবাহনী ও মারফুল হক রহমতগঞ্জ ও তার কোচ গোলম জিলানীর চেয়ে এগিয়ে বেশ। মারুফুল ম্যাচের আগে বসুন্ধরার দুই ফুলব্যাকের মুভমেন্ট নিয়েও গবেষণা করেছিলেন নিশ্চিত। ফলাফল, আগের ম্যাচে উড়তে থাকা রিমন-বিশ্বনাথ মাটিতে নেমে এসেছিলেন কাল। অস্কারের অধীনে রিমন লেফটব্যাকে খেললেও তিনি আসলে লেফট উইঙ্গার একজন। দলে কার্যকর লেফটব্যাক না থাকা ও চোট-সমস্যার কারণে রিমনকেই দিয়েই কাজ চালাচ্ছেন বসুন্ধরার স্প্যানিশ কোচ। একজন লেফটব্যাক হিসেবে রিমনের পাসিং ও ট্যাকলিংয়ের উন্নতির যে আরও জায়গা আছে, সেটা বোঝা গেছে। ওদিকে বিশ্বনাথও ছিলেন নিষ্প্রভ। রক্ষণে দুর্দান্ত হলেও এলোপাতাড়ি কিছু ক্রস করে দলের গোছালো কিছু আক্রমণ নষ্ট করেছেন।

আর্জেন্টাইন বেসেরা জেতালেন বসুন্ধরাকে।
ছবি: প্রথম আলো

বসুন্ধরা কিংস মূলত নেমেছিল ৪-৩-৩ ছকে। আগের ম্যাচে খেলা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার মাসুক মিয়া, মিডফিল্ডার মোহাম্মদ ইব্রাহিমের জায়গায় এই ম্যাচে খেলেছেন ইমন মাহমুদ ও মাহবুবুর রহমান। ৪-৩-৩ ছকটা সময়-সময় ৪-১-৪-১ হচ্ছিল, সেটা ওপরের ছয়জনের ক্রমাগত মুভমেন্টের কারণেই। ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে ইমন, তাঁর একটু ওপরে দুই ব্রাজিলিয়ান রবসন দা সিলভা ও জোনাথান ফার্নান্দেসের জুটি, বাঁ উইংয়ে মাহবুবুর, ডানে বিপলু। একক স্ট্রাইকার হিসেবে সবার ওপরে রাউল বেসেরা। ইমন প্রায় সময়ই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ড ছেড়ে ডান উইংয়ে চলে যাচ্ছিলেন, তখন জোনাথান নিচ্ছিলেন ইমনের জায়গা। জোনাথানের ফেলে আসা জায়গার দখল আবার নিচ্ছিলেন বিপলু। ওদিকে সময়-সুযোগমতো বেসেরাও নেমে যাচ্ছিলেন মাঝেমধ্যে। এভাবেই ক্রমাগত মুভমেন্টের মাধ্যমে চট্টগ্রাম আবাহনীকে ধন্দে রাখার একটা কৌশল নিয়েছিল বসুন্ধরা।

কিন্তু চট্টগ্রাম আবাহনীর খেলোয়াড়েরাও তাতে বিশেষ সমস্যায় পড়েননি। রবসন-বেসেরাদের ম্যান মার্ক না করে যথারীতি নিজেদের মতো জোনাল মার্কিং করে গেছেন দলটার খেলোয়াড়েরা। ফলে, নিজেরা মাঝমাঠে বসুন্ধরা কিংসকে তেমন জায়গা দেননি, হুট করে ভুলে সরে এসে বসুন্ধরাকে তেমন গোল করার সুযোগ দেননি। কাগজে-কলমে চট্টগ্রাম আবাহনীও নেমেছিল ৪-৩-৩ ছকে। কিন্তু বসুন্ধরার ৪-৩-৩ যেখানে পরিবর্তিত হয়ে ৪-১-৪-১–এ রূপ নিচ্ছিল, চট্টগ্রাম আবাহনীরটা রূপ নিচ্ছিল ৪-২-১-৩–এ। তিন মিডফিল্ডারের দুজন—মানিক মোল্লা আর মোনায়েম রাজুর কাজ ছিল মূলত চার ডিফেন্ডারের মাঝখানে কোনো ফাঁকা জায়গা থাকলে সেগুলোকে আঁটসাঁট রাখা। ফলে, ওই যে বসুন্ধরা মাঝমাঠে পাসের খেলায় এগিয়ে থাকলেও ডিফেন্সচেরা কিছু দিতে পারছিলেন না জোনাথান ফার্নান্দেসরা। সঙ্গে রিমন-বিশ্বনাথের ফর্মহীনতা ফুলব্যাক পজিশন থেকেও তেমন সাহায্য করছিল না বসুন্ধরাকে। বিশেষ করে বাঁ দিকে রিমনকে সাহায্য করার জন্য প্রায়ই নেমে যাচ্ছিলেন মাহবুবুর, যা বসুন্ধরার আক্রমণের ওপর প্রভাব ফেলেছে।

দুই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার মোনায়েম আর মানিকের ওপর একক আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার হিসেবে খেলেছেন আইভোরি কোস্টের মিডফিল্ডার ও দলের অধিনায়ক দিদিয়ের ব্রোসো। করোনার কারণে নাইজেরিয়ান ফরোয়ার্ড চিনেদু ম্যাথিউর না থাকাটাও ভুগিয়েছে মারুফুলের দলকে। ওই জায়গায় খেলেছেন মান্নাফ রাব্বী। ওপরে ব্রাজিলিয়ান তারকা নিক্সন গিলের্মে খেললেও তেমন আলো ছড়াতে পারেননি। পরে চোটের কারণে উঠেই যেতে হয় তাঁকে। তাই বলা যেতে পারে, খেলোয়াড়দের চোট মূলত চট্টগ্রাম আবাহনীকে পরিকল্পনামাফিক আক্রমণ করতে দেয়নি তেমন। করতে দিলে হয়তো ম্যাচের ফলাফল অন্য রকমও হতে পারত!

চট্টগ্রাম গোলটাও খেয়েছে হতাশাজনকভাবে। ৪৯ মিনিটে রবসন দা সিলভার কর্নার কিক থেকে দূরের পোস্টে হেডে বল জালে জড়ান আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার রাউল বেসেরা। বেশ দৃষ্টিকটুভাবে বলের ফ্লাইট মিস করেন চট্টগ্রাম গোলরক্ষক মোহাম্মদ নাঈম। আর বেসেরার মতো স্ট্রাইকারদের গোল করার জন্য অতটুকু হাফ চান্সই যথেষ্ট! বলা যেতেই পারে, কৌশলের খেলায় এই ম্যাচেও দেশীয় মারুফুল বিদেশি অস্কারকে টেক্কা দিলেও শেষমেশ তাঁকে পূর্ণ ৩ পয়েন্ট পেতে দেয়নি খেলোয়াড়দের ছোটখাটো ব্যর্থতা ও চোটসমস্যা।

তবে বসুন্ধরাকেও যে চোটসমস্যা ভোগায়নি, তা কিন্তু না। যে চারজন মূল দলে ডিফেন্ডার হিসেবে খেলছেন—রিমন, বিশ্বনাথ, ইরানের সেন্টারব্যাক খালেদ শাফি ও তাঁর রক্ষণসঙ্গী ইয়াসিন খান; কেউই কিন্তু বসুন্ধরার প্রথম পছন্দের ডিফেন্ডার নন। চোটের কারণে খেলতে পারছেন না ফিনল্যান্ড থেকে দেশে আসা তারিক কাজী, খেলতে পারছেন না তপু বর্মণ ও সুশান্ত ত্রিপুরার মতো ডিফেন্ডাররাও। একই কারণে অনুপস্থিত নূরুল নাঈম ফয়সাল।

তবে রক্ষণভাগে ফাটল থাকলেও বসুন্ধরার মাঝমাঠ ও আক্রমণভাগ যে যেকোনো পরিস্থিতি থেকে দলকে বের করে আনার সামর্থ্য রাখে, সেটাই দেখা গেল চট্টগ্রাম আবাহনীর বিপক্ষে। আর তাতে শেষ হাসিটা হেসেছেন অস্কারই।