বাংলাদেশের নায়ক ছাড়ছেন বাংলাদেশ

যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী হচ্ছেন সাফ গেমস ফুটবলে সোনাজয়ী অধিনায়ক জুয়েল রানা। ছবি: প্রথম আলো
যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী হচ্ছেন সাফ গেমস ফুটবলে সোনাজয়ী অধিনায়ক জুয়েল রানা। ছবি: প্রথম আলো
>
  • দেশের মায়া কাটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী হচ্ছেন জুয়েল রানা
  • ১৯৯৯ সালে সাফ গেমস ফুটবলে অনেক প্রতীক্ষার পর প্রথম সোনা এসেছিল তাঁর অধিনায়কত্বেই
  • জাতীয় ফুটবল দলের অন্যতম সফল অধিনায়ক জুয়েল রানা
  • দেশ ছাড়বেন ২১ এপ্রিল
  • যেখানেই যান, ফুটবলকে কখনোই ভুলবেন না দেশের ফুটবলের অন্যতম সেরা এই তারকা

মোটরসাইকেলের ওপর আলফাজ আহমেদ অপেক্ষা করছেন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন ভবনের নিচে। পেছনে জুয়েল রানা চেপে বসলেই দুজন বেরিয়ে পড়বেন ভবন থেকে। দুজনের বাসা মিরপুরে হওয়ায় একসঙ্গে যাওয়ার সুবিধা, সেটাও আবার মোটরসাইকেলে। সম্প্রতি, বাংলাদেশের ফুটবলের অন্যতম দুই সেরা তারকা ফুটবলারকে এভাবেই মতিঝিল ফুটবল ভবন চত্বরে আবিষ্কার করা গেল।
এই দুই ফুটবলারই অমর হয়ে আছেন দেশের ফুটবল ইতিহাসে। ১৯৯৯ সালে কাঠমান্ডু সাফ গেমসে ফুটবলের অনেক প্রতীক্ষার সোনার পদকটা এসেছিল জুয়েল রানার অধিনায়কত্বেই। সেবার ফাইনালে নেপালের বিপক্ষে জয়সূচক গোলটা এসেছিল আলফাজের পা থেকে। গোটা আসরেই চীনের প্রাচীর হয়ে বাংলাদেশের রক্ষণ সামলেছিলেন জুয়েল। এরপর কেটে গেছে ১৯টি বছর। তাই বাফুফে ভবনে জুয়েল রানা আর আলফাজকে দেখে কিছুটা স্মৃতিকাতর হয়ে ওঠাই স্বাভাবিক। আড্ডার মতো জমতেই জুয়েলের কথায় খেতে হলো ধাক্কা—‘আমার তো ভিসা হয়ে গেছে।’
-‘তার মানে?’
-‘তার মানে আমি চলে যাচ্ছি।’
-‘কোথায়?’
-‘আমেরিকায়!’
-‘বেড়াতে?’
-নাহ্! ইমিগ্রান্ট ভিসায়! স্ত্রী আর দুই সন্তানকে নিয়ে। সবাই ভিসা পেয়ে গেছে।’

১৯৯৯ সালের কাঠমান্ডু সাফ গেমসে ভারতের বিপক্ষে সেমিফাইনালে জুয়েল রানা (অধিনায়কত্বের আর্মব্যান্ড পড়া)। ছবি: এএফপি, ফাইল ছবি।
১৯৯৯ সালের কাঠমান্ডু সাফ গেমসে ভারতের বিপক্ষে সেমিফাইনালে জুয়েল রানা (অধিনায়কত্বের আর্মব্যান্ড পড়া)। ছবি: এএফপি, ফাইল ছবি।

সাফ সোনাজয়ী অধিনায়ক তাহলে দেশান্তরি হচ্ছেন! ‘হ্যাঁ, হচ্ছি।’ ঝটপট বলে দেন জুয়েল রানা। তবে এটা যে হঠাৎ কোনো ঘটেনি, বলতে ভোলেননি সে কথাও, ‘আসলে আবেদন করেছি ২০০৪ সালে। অবশেষে ১৪ বছর পর সব প্রক্রিয়া শেষে যেতে পারছি।’ যাওয়ার তারিখও চূড়ান্ত। ২১ এপ্রিল চড়ে বসবেন নিউইয়র্কগামী বিমানে। আস্তে আস্তে হয়ে যাবেন প্রবাসী। ফুটবলার জুয়েল রানা পরিচয়টা হয়তো মুছে যাবে না কখনো, তবে জুয়েল রানাকে আর ফুটবল নিয়ে সেভাবে কথা বলতে দেখা যাবে না। অনিয়ম নিয়ে বলবেন না ঠোঁটকাটা জুয়েল রানা! ফুটবল থেকে থাকবেন দূরে, বহুদূরে। তাঁর সুবিধা হলো যুক্তরাস্ট্রে আত্মীয়স্বজন থাকেন অনেক। স্ত্রীর পরিবারের দিক থেকে অনেকেই আছে, ভায়রার স্পনসরেই যুক্তরাষ্ট্রে বসত গড়তে চলেছেন দেশের ফুটবলের অন্যতম সেরা এই ডিফেন্ডার।
মাঝেমধ্যে দেশে আসবেন, ফুটবলারদের সঙ্গে আড্ডা হবে; যা তিনি সব সময়ই মিস করবেন। এ কারণেই জুয়েল রানাকে বলতে শোনা যায়, ‘যত দিন বেঁচে থাকব, তত দিন ফুটবল আমার রক্তে থাকবে। সব সময়ই মিস করব...সেই ঢাকা মাঠ...আহা...কত স্মৃতি আছে জড়িয়ে!’ তবে বলতে ভোলেননি, ‘১২ বছরের ছেলে জাবির আরহাম আর নয় বছরের মেয়ে আরফা ওয়াজিহার ভবিষ্যতের কথা ভেবেই যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাওয়ার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিছু করার নেই। ওদের কথা তো আমাকে ভাবতে হবে।’
তবে কারও জন্য কিছু থেমে থাকে না। এ কথা বলেও নিজের মনকে সান্ত্বনা দেন। জুয়েল বলেন, ‘আমাকে কে ফিল করবে! কত মানুষ জীবনের তাগিদে কত দিকে ছড়িয়ে যায়, কে হিসাব রাখে!’ কথাটা হয়তো ঠিক। কিন্তু জুয়েল রানা অন্য দশজনের মতো নন। বাংলাদেশর ফুটবলে তাঁর অবদান অনেক।

১৯৯৭ সালে কুয়ালালামপুরে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে সৌদি আরবের বিপক্ষে ম্যাচে জুয়েল রানা। ছবি: এএফপি, ফাইল ছবি
১৯৯৭ সালে কুয়ালালামপুরে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে সৌদি আরবের বিপক্ষে ম্যাচে জুয়েল রানা। ছবি: এএফপি, ফাইল ছবি

আলফাজের সঙ্গে এএফসি ‘এ’ লাইসেন্স কোচিং কোর্স শেষ করেছেন সেদিনই। আগে থেকেই ইচ্ছা ছিল খেলা ছেড়ে কোচ হবেন। যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে হয়ত ‘এ’ লাইসেন্স কাজে লাগাবেন। তবে ঢাকায় এর আগে ক্লাব কোচিং করিয়েছেন কিছুদিন। তবে মোহামেডান, শেখ রাসেল বা শেখ জামালে সহকারী কোচ হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা ভালো হয়নি তাঁর, ‘ঢাকায় কিছু ক্লাবে কোচের স্বাধীনতা নেই। কিছু ক্লাবে অর্থনৈতিক সমস্যা। ঠিকমতো বেতন দেয় না। আমি আসলে এসব মানিয়ে নিতে পারিনি। এটা আসলে আমার জন্য নয়।’
এসব বলার সময় বেদনা ঝরে জুয়েলের কণ্ঠে। ক্লাবের অপেশাদার মনোভাব আর বেতন ঠিকমতো না দেওয়ায় ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে’ রাজি হননি। চলে গেছেন আপন ভুবনে। আজ দুপুরে বাফুফে ভবনে আবার এসেছিলেন জুয়েল। বাফুফের কাছ থেকে কী একটা চিঠি নেবেন। বললেন, ‘আবার এভাবে কবে ফুটবল ভবনে আসা হয় জানি না।’
এখন হয়তো ব্যক্তিগত কারণেই দেশ ছাড়ছেন। তবে জুয়েলদের মতো রত্নকে আমরা ধরে রাখতে পারিনি আমাদের ফুটবলে! এই সত্যটাও তো সামনে এনে দাঁড় করায়!