বার্নাব্যুতে গোলবন্যায় শিরোপা উৎসব রিয়াল মাদ্রিদের

অধিনায়ক মার্সেলোর বিদায়টা দুর্দান্ত হলোছবি: রিয়াল মাদ্রিদ

গ্যালারির দিকে দুই হাত তুলে অভিবাদন জানাচ্ছিলেন মার্সেলো। এ মৌসুমেই শেষবারের মতো খেলছেন রিয়াল মাদ্রিদের জার্সিতে। কাগজে-কলমে অধিনায়ক, কিন্তু ফর্ম হারিয়ে ফেলায় কালো আর্মব্যান্ডটা হাতে পরার সুযোগ হয় না তাঁর। কিন্তু যেদিন রিয়াল তাদের ৩৫তম লা লিগা জিতল, সেদিন ঠিকই তাঁর হাতে আর্মব্যান্ড। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে সবচেয়ে বেশি শিরোপা জেতার রেকর্ড গড়েই বিদায় নেবেন মার্সেলো। এমন এক ম্যাচে আরেকবার প্রিয় মার্সেলোর দেখা পেল বার্নাব্যু।

আক্রমণটা হয়েছে রিয়াল মাদ্রিদের চেনা ছন্দে। বাঁ প্রান্তে লুকা মদরিচের পাস খুঁজে পেয়েছে রদ্রিগো গোয়েসকে। রদ্রিগো বলটা বুঝিয়ে দিলেন মার্সেলোকে। অতীতের সেই দুর্দান্ত দক্ষতা না থাকুক, আক্রমণে এখনো অন্য অনেকের চেয়ে সাবলীল ব্রাজিলিয়ান ফুলব্যাক। তাঁর কাটব্যাক দুজন এসপানিওল ডিফেন্ডারকে অকেজো করে দিল। বল আবার রদ্রিগোর পায়ে। পাশে থেকে এক প্রতিপক্ষ খেলোয়াড় চাপে রেখেছিলেন। কিন্তু পাত্তা না দিয়ে বল নিয়ন্ত্রণে নিয়ে শট নিলেন। গোল!

প্রথমার্ধেই বাঁ প্রান্ত দিয়ে এমন আরেক শট থেকে রিয়ালকে দুই গোলে এগিয়ে দিয়েছেন রদ্রিগো। দ্বিতীয়ার্ধে আরও দুই গোল পেয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ। এসপানিওলকে ৪-০ গোলে উড়িয়ে চার ম্যাচ আগেই লা লিগার চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেল রিয়াল মাদ্রিদ। ৩৫তম বারের মতো লা লিগা চ্যাম্পিয়ন লস ব্লাঙ্কোস। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনার সঙ্গে ব্যবধান ৯ করে ফেলল রিয়াল।

দারুণ দুটি গোল করেছেন রদ্রিগো
ছবি: রয়টার্স

ড্র করলেই লা লিগা চ্যাম্পিয়ন। এমন এক দলের বিপক্ষে যারা মৌসুমে প্রতিপক্ষের মাঠে ১৫ ম্যাচের মাত্র একটিতে জয় পেয়েছে। ঘরের মাঠে নিজেদের দর্শকের সামনে ট্রফি উঁচিয়ে ধরার এর চেয়ে বড় সুযোগ আর হয় না। তবু শঙ্কা ছিল। দুর্বল প্রতিপক্ষের বিপক্ষে পয়েন্ট খোয়ানোর অভ্যাস এই মৌসুমেও ধরে রেখেছে রিয়াল, সেটি একটি কারণ। দ্বিতীয় কারণ, ম্যাচের দুই ঘণ্টা আগেই প্রকাশ করা রিয়াল মাদ্রিদের মূল একাদশের চেহারা।

সপ্তাহের মাঝপথে চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালের দ্বিতীয় লেগ। প্রথম লেগে ৪-৩ গোলে পিছিয়ে থাকায় সে ম্যাচে জয় ছাড়া আর কোনো ফল কাম্য নয়। আজ তাই একাদশে কয়েকজনের বিশ্রাম মিলবে জানা ছিল। তাই বলে এমন একাদশ কেউ চিন্তাও করেননি।

আক্রমণে করিম বেনজেমাকে বিশ্রাম দিয়েছেন কোচ কার্লো আনচেলত্তি। তাঁর প্রিয় সঙ্গী ভিনিসিয়ুস জুনিয়রও পেয়েছেন বিশ্রাম। মাঠে নেমেছেন মারিয়ানো দিয়াজ, যাঁর রিয়ালের জার্সিতে সর্বশেষ গোল ২০২০ সালের ২১ নভেম্বর! এই মৌসুমে ২২৮ মিনিট খেলে কোনো গোল পাননি। ভিনিসিয়ুস জুনিয়রকে দিয়ে একটি গোল করাতে পেরেছেন, সেটিও গত ৩০ অক্টোবরের কথা! আক্রমণে তাঁর সঙ্গী রদ্রিগো, যার চ্যাম্পিয়নস লিগেই গোল করতে ভালো লাগে । আজকের আগে লিগে এই মৌসুমে গোল মাত্র একটি। ডান প্রান্তে মার্কো আসেনসিও। লিগে ৯ গোল করলেও মূল একাদশে থাকলে ঠিক ভালো খেলতে দেখা যায় না।

সুযোগ পেয়েই জোড়া গোল রদ্রিগোর
ছবি: রয়টার্স

টনি ক্রুস ও ফেদে ভালভার্দেও বিশ্রাম পেয়েছেন। তবে মদরিচকে বসিয়ে রাখার সাহস করেননি আনচেলত্তি। তাঁর সঙ্গী এদুয়ার্দো কামাভিঙ্গা ও দানি সেবায়োস। কাসেমিরো মাঠে ছিলেন, তবে নেমেছিলেন সেন্টারব্যাক হিসেবে! মূল সেন্টারব্যাকদের একজন ডেভিড আলাবা চোটে আছেন, মিলিতাও হলুদ কার্ড জটিলতায় নিষিদ্ধ। চ্যাম্পিয়নস লিগের আগে নাচোকে নিয়েও ঝুঁকি নিতে রাজি নন। পুরো লিগে এর আগে মাত্র ৭ মিনিট খেলা ভায়েহোর সঙ্গী মিডফিল্ডার কাসেমিরো। মূল দুই ফুলব্যাক কারভাহাল ও ফারলাঁ মেন্দিও বিশ্রামে। তাঁদের জায়গায় লুকাস ভাসকেজ ও মার্সেলো।

এমন এক একাদশ নিয়ে নামা রিয়ালের তাই পা কাটার সম্ভাবনা ছিল। লিগে করা ৬৯ গোলের ৫৬ ভাগই এনে দেওয়া বেনজেমা-ভিনিসিয়ুসের অভাব বোধ করবে রিয়াল, এমনটাই মনে হচ্ছিল। ম্যাচের মাত্র তিন মিনিটে সেটা প্রকট হয়ে উঠল। প্রতিপক্ষের ভুলে বক্সের সামনে বল পেয়েছিলেন মদরিচ। তার পাশে বক্সের ভেতর দারুণ সুযোগ পেয়েছিলেন মারিয়ানো। কিন্তু অনেক সময় নিয়েও শট নিতে পারেননি। বেনজেমা থাকলে হয়তো তখনই এগিয়ে যেত রিয়াল।

অনেক দিন নিয়মিত একাদশে না খেলার জড়তা কাটিয়ে উঠেছেন মারিয়ানো। ১৩ মিনিটে গোলও পেয়ে যেতেন। কিন্তু তাঁর হেড গিয়ে লেগেছে পোস্টে। সেবায়োসের ক্রস দূরের পোস্টে গিয়েছিল। সেখান থেকে হেড করে বল অন্য পোস্টে পাঠিয়েছিলেন কাসেমিরো। মারিয়ানোর হেড কাসেমিরোর কাছ থেকে বল পেয়েই।

রিয়ালের হয়ে সবচেয়ে বেশি শিরোপা জয়ের রেকর্ড মার্সেলোর
ছবি: রয়টার্স

এরপর কিছুক্ষণ ঝিমুনি জাগানো খেলা হয়েছে। বার্নাব্যু জেগে উঠল ৩৩ মিনিটে। ভিনিসিয়ুসের কারণে রিয়ালে যোগ দেওয়ার পর থেকেই পছন্দের বাঁ প্রান্তে খেলতে পারছেন না রদ্রিগো। বিরল সুযোগ পেয়েই নিজের পায়ের দক্ষতা দেখালেন, ডান প্রান্তে যা স্বাভাবিকভাবে দেখাতে পারেন না। ১০ মিনিটের মধ্যে প্রায় একই জায়গা থেকে গোল পোস্টের দুই প্রান্তে বল পাঠানোর দক্ষতাই বলে দিয়েছে, স্বাভাবিক পজিশনে খেলতে পারলে কী ভয়ংকর হতে পারেন রদ্রিগো। প্রথম গোলটি করেছেন দূরের পোস্টে।

পরের গোলটিতে শরীরের ঝটকায় দূরের পোস্টে বল পাঠানোর ভান করে মেরেছেন কাছের পোস্টে। সে গোলে অবশ্য মারিয়ানোর অবদান ছিল। তাঁর চাপেই বক্সের সামনে বল হারিয়েছিল এসপানিওল। ৪৩ মিনিটের মধ্যে দুই গোল করা রদ্রিগো প্রথমার্ধেই হ্যাটট্রিক পেতে পারতেন। কিন্তু সতীর্থদের গোল করানোর উদারতা দেখাতে গিয়ে দুটি সুযোগ হাতছাড়া করেছেন।

লিগে দশম গোল আসেনসিওর
ছবি: রয়টার্স

দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই শিরোপা নিশ্চিত হয়ে গেছে রিয়ালের। ৫৫ মিনিটে প্রতি–আক্রমণে উঠেছিল রিয়াল। নিজের অর্ধে মদরিচের কাছ থেকে বল পেয়ে বল টেনে নিয়েছেন কামাভিঙ্গা। একদম শেষ মুহূর্তে বল দিয়েছেন ছুটে এগোনো আসেনসিওকে। বক্সে ঢুকে দুর্বল ডান পা দিয়েই লিগে নিজের দশম গোল পেয়েছেন আসেনসিও।

৬০ মিনিটে সবাইকে আবার অবাক করে দিয়েছেন আনচেলত্তি। বেনজেমা, ক্রুসকে মাঠে নামিয়েছেন। নেমেছেন ইসকোও। উঠে গেছেন, মদরিচ, মারিয়ানো। সে সঙ্গে কাসেমিরো উঠে যাওয়ায় কামাভিঙ্গাকে ডিফেন্ডার বনে যেতে হয়েছে।

রিয়ালের ৩৫তম লা লিগা শিরোপা তো বেনজেমা-ভিনিসিয়ুস জুটিই এনে দিয়েছে
ছবি: রয়টার্স

৭১ মিনিটে দুর্দান্ত আরেকটি প্রতি–আক্রমণ থেকে ৪-০ গোল করেছিল রিয়াল। আসেনসিওর পাস থেকে বল পেয়েছিলেন ইসকো। তাঁর পা থেকে বল পেয়েছেন বেনজেমা। বক্সে ঢুকে ইসকোকে বল ফেরত পাঠিয়েছিলেন বেনজেমা। দারুণ শটে গোল করেছিলেন ইসকো। কিন্তু গোলের মুহূর্তে রদ্রিগোর কারণে এসপানিওলের গোলকিপার বল দেখতে পাননি এই যুক্তিতে গোল বাতিল হয়।

একটু পর রদ্রিগোর বদলি হিসেবে নেমেছেন ভিনিসিয়ুস। কামাভিঙ্গাকে ডিফেন্ডার হিসেবে খেলানো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে দেখে একাডেমির ডিফেন্ডার মারিও গিয়াকে নামিয়েছেন কোচ। রিয়াল জার্সিতে আজই অভিষেক হলো এসপানিওল ও বার্সেলোনার বয়সভিত্তিক দলে খেলা ২১ বছর বয়সী ডিফেন্ডারের।

মাঠে ভিনিসিয়ুসকে পেয়েই বেনজেমার আবার গোলক্ষুধা জেগেছে। ৮০ মিনিটে দেখা মিলল এই মৌসুমের অতিপরিচিত সেই মুহূর্তের। বাঁ প্রান্তে ঢুকে যাওয়া ভিনিসিয়ুসের পাস, আর সেখান থেকে ডিফেন্ডারদের বোকা বানানো দৌড়ে বেনজেমার গোল। লিগে বেনজেমার এটি ২৬ গোল, আর ভিনিসিয়ুসের ১২তম গোলে সহায়তা।