বাস আটকানো, রাস্তা অবরোধ, সমর্থকদের ‘বিদ্রোহ’ ফেরাল চেলসিকে

চেলসির মাঠের বাইরে সুপার লিগের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছিল আসল বিক্ষোভ।ছবি : রয়টার্স

‘সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আলোচনা করতে দিন। এটা কোনো পন্থা হতে পারে না। আমি জানি, আমি জানি আপনাদের মতামত। আমাদের সময় দিন। বাসকে ঢুকতে দিন।’

পিওতর চেকের চেহারা থমথমে। সমর্থকদের এমন রণমূর্তি দেখবেন, হয়তো বুঝেই উঠতে পারেননি। স্টামফোর্ড ব্রিজের বাইরে সমর্থকদের বিক্ষোভ থামাতে, ভক্তদের ঠান্ডা করতে চেলসির সাবেক এই গোলরক্ষক নেমে এসেছিলেন ভক্তদের মাঝে। তখনই বুঝে গিয়েছিলেন, সমর্থকদের অসন্তুষ্ট করে ইউরোপিয়ান সুপার লিগে খেলতে যাওয়ার চেষ্টা করা বৃথা।

দুদিন আগেই চেলসিসহ ১২ ক্লাব ঘোষণা দিয়েছিল ইউরোপিয়ান সুপার লিগের। এমন একটা লিগ, যা উয়েফা আয়োজিত চ্যাম্পিয়নস লিগ বা ইউরোপা লিগের মতো প্রতিযোগিতার কপালে সর্বনাশের চিহ্ন এঁকে দেবে। ৪৮ ঘণ্টা যেতে না যেতেই চেলসিসহ ছয় ইংলিশ ক্লাব নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছে এই ‘বিদ্রোহী’ লিগ থেকে। কারণ, ওই একটাই, সমর্থকদের অসন্তুষ্টি।

ব্যানারই সব বলে দেয়।
ছবি : রয়টার্স

গতকাল ব্রাইটনের বিপক্ষে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচ ছিল চেলসির। ম্যাচ নিয়ে চিন্তা করবেন কী, গোটা চেলসির কর্তাব্যক্তিদের মাথায় ঘুরছিল কীভাবে সমর্থকদের রাগ কমানো যায়। বাইরে রাস্তা অবরোধ করে রেখেছিলেন অসংখ্য সমর্থক। গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এমনকি দলের বাসকেও মাঠের মধ্যে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছিল না। আগের দিন লিভারপুল, সিটি, ইউনাইটেড, আর্সেনাল, টটেনহামের সমর্থকেরা মাঠের বাইরে প্রতিবাদ জানাতে এলেও ইউরোপিয়ান সুপার লিগ প্রসঙ্গে এত বড় পরিসরে ক্লাবের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানানোর সাহস চেলসির সমর্থকেরাই দেখিয়েছেন।

স্টামফোর্ড ব্রিজের বাইরে রাস্তা অবরোধ করে রেখেছিলেন অসংখ্য সমর্থক।
ছবি : রয়টার্স

স্কাই স্পোর্টসের রিপোর্টার রন ওয়াকার জানিয়েছেন, ‘এলান্ড রোডে (লিডস ইউনাইটেডের মাঠ) অল্প কিছু সমর্থক গতকাল প্রতিবাদ জানালেও আজ চেলসির মাঠের বাইরে সুপার লিগের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে আসল বিক্ষোভ। মাঠের মূল ফটকের সামনে হাজার হাজার সমর্থক বিদ্রোহ শুরু করেছে। ক্লাবের মালিক হিসেবে রোমান আব্রামোভিচ আসার পর সমর্থকদের সঙ্গে বোর্ডকর্তাদের যেমন সুসম্পর্ক ছিল, এই এক সিদ্ধান্তের কারণে সে সম্পর্কে ফাটল ধরেছে। “আমরা আমাদের চেলসি ফেরত চাই”, “তোমরা আমাদের ক্লাব চালানোর যোগ্য নও” এমন হাজারো স্লোগানে মুখর চারপাশ। বিক্ষোভটা শান্তিপূর্ণই হচ্ছে, কিন্তু মালিকপক্ষের কাছে বার্তাটা বেশ ভালোভাবেই পৌঁছেছে।’

ফলাফল, সুপার লিগ থেকে নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছে চেলসি।

তবে শুধু সমর্থকদের এই বিক্ষোভই যে চেলসির কর্তাব্যক্তিদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছে, তা নয়। স্কাই স্পোর্টস নিউজের রিপোর্টার কাভে সলহাকেলের মতে, ছয় ইংলিশ ক্লাবের মধ্যে চেলসিই সবার শেষে সুপার লিগের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিল। সুপার লিগে যোগ দেওয়ার জন্য তাঁরা যে খুব বেশি আগ্রহী ছিল, তা নয়। লিগের অন্যান্য প্রতিপক্ষরা সুপার লিগে নাম লিখিয়েছে দেখে তাঁদের দেখাদেখি চেলসিও নাম লেখায়, সিটি-লিভারপুল বা আর্সেনাল-ইউনাইটেডের চেয়ে পিছিয়ে থাকতে চায়নি তাঁরা। কিন্তু সুপার লিগের ঘোষণা আসার পর থেকে বিশ্বব্যাপি এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সমর্থকেরা যেভাবে এককাট্টা হয়েছিলেন, সেটাই ভাবিয়ে তোলে চেলসিকে।

পিওতর চেক থামাতে এসেছিলেন সমর্থকদের।
ছবি : রয়টার্স

চেলসি যে এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে শুরু থেকে ছিল না, সেটা ফুটে উঠেছে তাঁদের আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতেও, ‘ইউরোপিয়ান সুপার লিগ থেকে প্রত্যাহারের সব আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে চেলসি। সুপার লিগে শেষের দিকে যোগ দিয়েছিল চেলসি, গত সপ্তাহে। এখন পুরো ব্যাপারটা নিয়ে আমরা ভালোভাবে চিন্তা করার সময়-সুযোগ পেয়েছি। এরপরে আমাদের মনে হয়েছে এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকাটা আমাদের ক্লাবের জন্য, সমর্থকদের জন্য বা বিশ্বব্যাপী ফুটবলভক্তদের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না।’

আরও পড়ুন

একই অবস্থা ম্যানচেস্টার সিটিরও। গতকাল দলের কোচ পেপ গার্দিওলার কথা থেকেই স্পষ্ট ছিল, এ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তিনি বা তাঁর শিষ্যদের কেউই কিছু জানতেন না। রোববারই জানানো হয়েছে সিটিকে। ওদিকে চেলসির মতো না হলেও মাঠের বাইরে ব্যানার টানিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন সিটি সমর্থকেরাও। টুর্নামেন্টের ফরম্যাট নিয়েও সমর্থকদের মনের কথাটা বলেছিলেন গার্দিওলা, প্রশ্ন তুলেছিলেন যৌক্তিকতা নিয়ে, ‘এটা কোনো খেলা নয়। কারণ, চেষ্টা ও সফলতার মধ্যে সম্পর্কটা (সুপার লিগে) এখানে নেই। যেখানে সফলতা আগে থেকেই ঠিক করা এবং কিছু সময়ে হারে কোনো কিছু যায় আসে না, সেটা কোনো খেলা হতে পারে না। কিন্তু এ মুহূর্তে এটা শুধুই একটা বিবৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়।’

কোচের এ কথা আবার রি-টুইট করে সমর্থন জানিয়েছিলেন সিটির একাধিক খেলোয়াড়। ব্যাপারটা স্পষ্ট ছিল, সিটির কেউই এ টুর্নামেন্টের ব্যাপারটা মানতে পারছেন না।

ওদিকে গোটা বিশ্বের সমর্থকদের কাছ থেকে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখে পিছু হটেছে আর্সেনালও। যে ক্লাবটার মালিক স্ট্যান ক্রোয়েঙ্কে মূলত এই ইউরোপিয়ান সুপার লিগের অন্যতম প্রধান কুশীলব। ব্যাপারটা এমন বাজেভাবে মোড় নেবে, সেটা হয়তো বোঝেনি তাঁরা। শেষমেশ এই টুর্নামেন্ট থেকে সরে আসার সঙ্গে সঙ্গে সমর্থকদের কাছে ক্ষমাই চেয়েছে উত্তর লন্ডনের এই ক্লাব, ‘বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আমাদের সমর্থক ও ফুটবলসমাজের মতামত শুনে আমরা এই লিগ থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা একটা ভুল করেছি, আর সেটার জন্য ক্ষমা চাইছি।’

সমর্থকেরা চাইলে কী না হয়, সেটাই যেন আরেকবার দেখিয়ে দিল ক্লাবগুলো!