বিতর্কটা আর বেশিদিন রাখবেন না রোনালদো
পেশাদার ফুটবলে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ডটি কার? খুবই সহজ একটি প্রশ্ন। একদম সরল অঙ্কের মতো! হ্যাঁ, এ প্রশ্নটিকে সরল অঙ্কের মতোই বলতে পারেন। অন্তত, ফুটবল নিয়ে যাঁরা খোঁজখবর রাখেন, তাঁদের কাছে তো বটেই। কারণ, সরল অঙ্ক ভালোয় ভালোয় মিলে গেলে তো সেটি ‘জলবত তরলং’ সহজ! আর সরল অঙ্ক মেলাতে গিয়ে একবার যদি কোথাও প্যাঁচ লেগে যায়, সেটা হয়ে ওঠে খুবই কঠিন।
‘পেশাদার ফুটবলে সর্বোচ্চ গোলের মালিক কে’—সহজ প্রশ্নটি সত্যিকার অর্থেই ফুটবল–বিশ্বে জটিল রূপে ধরা দিয়েছে! ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো কাল ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে টটেনহামের বিপক্ষে দুর্দান্ত এক হ্যাটট্রিক করে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে ৩-২ গোলের জয় এনে দেন। ফ্রেদের পাস থেকে প্রায় ২৫ গজ দূর থেকে বুলেট গতির শটে করা প্রথম গোলটি ছিল পেশাদার ফুটবলে রোনালদোর ৮০৫তম গোল। গোলটির পর আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম খবর দেয়, পেশাদার ফুটবলে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ডে অস্ট্রিয়ান বংশোদ্ভূত কিংবদন্তি চেক স্ট্রাইকার জোসেফ বাইকানকে ছুঁয়ে ফেলেছেন তিনি। পরের দুটি গোলে চেক প্রজাতন্ত্রের সাবেক তারকাকে ছাড়িয়ে রেকর্ডটিতে একক অধিকার স্থাপন করেন রোনালদো।
তবে রোনালদোর এ রেকর্ড মেনে নেওয়ার কথা নয় চেক প্রজাতন্ত্রের ফুটবল ফেডারেশনের। এ নিয়ে অনেক দিন ধরেই বিতর্ক চলছে। এর আগেও একবার খবর এসেছিল—পেশাদার ফুটবলে সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ড গড়েছেন রোনালদো। কিন্তু সেটি প্রত্যাখ্যান করেছিল চেক ফুটবল ফেডারেশন। বিষয়টি নিয়ে বিবৃতিও দিয়েছিল তারা। ঘটনাটা গত বছরের জানুয়ারির। সেই সময়ে জুভেন্টাসে খেলা রোনালদো ২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি ইতালিয়ান সুপার কাপে নাপোলির বিপক্ষে করেছিলেন ক্যারিয়ারের ৭৬০তম গোল।
ফুটবলের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে—এমন কিছু প্রতিষ্ঠানের হিসাব অনুযায়ী, অফিশিয়াল ম্যাচে বাইকানের গোল ৭৫৯টি। সেই পরিসংখ্যানের ভিত্তিতেই সেই সময় বিভিন্ন দেশের সংবাদমাধ্যম রোনালদোকে পেশাদার ফুটবলের সর্বোচ্চ গোলদাতা ঘোষণা করেছিল। কিন্তু চেক ফুটবল ফেডারেশন সেই দাবি উড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, বাইকানের গোল ৭৫৯টি নয়, ৮২১টি। মানসম্পন্ন আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানের ওয়েবসাইটে অবশ্য বাইকানের গোল দেখানো হচ্ছে ৮০৫টি। চেক ফুটবল কর্তৃপক্ষ এটাও মানতে রাজি নয়।
চেক ফুটবল ফেডারেশনের দাবি, বাইকান ১৯৫২ সালে দেশটির ফুটবলে দ্বিতীয় বিভাগে হার্দেক ক্রালাভের হয়ে খেলার সময়কার গোলগুলোর হিসাব করা হয়নি। নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে সেই সময়ে বাইকানের করা গোলের হিসাব তারা খুঁজে পেয়েছে, গত বছরের জানুয়ারিতে এমনটাই দাবি করেছিল চেক ফুটবল কর্তৃপক্ষ। হার্দেক ক্রালাভের হয়ে বাইকান নাকি ২৬ ম্যাচে ৫৩ গোল করেছিলেন। সেই গোল মিলিয়ে চেক কর্তৃপক্ষ বাইকানের গোল হিসাব করেছে। তাদের সেই হিসাব অনুযায়ী, বাইকানের লিগ, কাপ ও আন্তর্জাতিক ম্যাচের গোলসংখ্যা ৮২১।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে গতকাল রোনালদোর গোলের রেকর্ড গড়ার খবর আসার পর তাৎক্ষণিকভাবে চেক ফুটবল কর্তৃপক্ষ কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে সেটা আসতে কতক্ষণ! কিন্তু আন্তর্জাতিক ফুটবলে তো গোলের হিসাব নিয়ে এমন সমস্যা নেই! এই যেমন রোনালদোই যে ইরানের আলী দাইয়িকে ছাড়িয়ে জাতীয় দলের সবচেয়ে বেশি গোল করার মালিক হলেন, তা নিয়ে কোনো বিতর্ক হয়নি। তাহলে পেশাদার ফুটবলে গোলের হিসাবে এমন ‘প্যাঁচ’ লাগল কেন? এর জন্য আসলে ফিফাই দায়ী! আন্তর্জাতিক ফুটবলে খেলোয়াড়দের গোলের হিসাব রাখলেও পেশাদার ফুটবলে গোলের হিসাব সেভাবে ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি রাখে না। আনুষ্ঠানিক কোনো হিসাব না থাকলে যে যার মতো পরিসংখ্যান উপস্থাপন করতেই পারে!
এই যেমন কিছু হিসাব বলে, পেলে তাঁর ক্যারিয়ারে এক হাজারের বেশি গোল করেছেন। তাঁকেই ধরা হতো ফুটবলে সবচেয়ে বেশি গোলের মালিক। কিন্তু পেলেকে সর্বোচ্চ গোলদাতা মানতেন না খোদ ব্রাজিলেরই সাবেক স্ট্রাইকার রোমারিও। তিনিও এক হাজারের বেশি গোল করেছেন বলে দাবি করেন। তবে পেলে ও রোমারিওর গোলগুলোর মধ্যে আছে শৌখিন, অনানুষ্ঠানিক ও প্রীতি ম্যাচের গোলও।
বাইকানের ক্ষেত্রে চেক প্রজাতন্ত্রের ফুটবল ফেডারেশনের ৮২১ গোল করার দাবিটাও তো কেউ উড়িয়ে দেননি এখনো! তাহলে রোনালদোর রেকর্ড কি সত্যিই হলো, নাকি হলো না! এই প্রশ্নের সমাধান কে দেবেন? ওই যে লেখার শুরুতেই বলা হলো, প্রশ্নটি সহজ, কিন্তু উত্তরটা বেশ জটিল! তবে সেই জটিলতা আর বেশিদিন থাকবে বলে মনে হয় না। গত বছরের জানুয়ারিতে যখন এ হিসাব নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছিল, রোনালদোর গোল ছিল ৭৬০টি। এখন তাঁর গোলসংখ্যা ৮০৭। চেক প্রজাতন্ত্রের ফুটবল কর্তৃপক্ষের হিসাবকেই যদি সবাই ঠিক ধরে নেন, তাহলেও সেটি ছুঁয়ে ফেলতে রোনালদোর আর মাত্র ১৪ গোল দরকার। এই ৩৭ বছর বয়সেও তিনি যেভাবে গোল করে চলেছেন, ১৪ বা ১৫টি গোল করতে আর কদিনই বা লাগবে তাঁর!