বিদেশি বন্ধ করলে বাংলাদেশের ফুটবলের ক্ষতি

আবাহনীর নাইজেরিয়ান ফুটবলার সানডে সিজোবা।ছবি: প্রথম আলো

বাফুফের লিগ কমিটির সঙ্গে ক্লাবগুলোর গত মঙ্গলবারের সভাটি দেশের ফুটবলের জন্য নতুন ইঙ্গিতবাহী। সভায় প্রিমিয়ারের ১৩ ক্লাবের মধ্যে উপস্থিত ১০ ক্লাবের ৭টিই আগামী মৌসুমে বিদেশি কোটা বাতিলের দাবি তোলে। করোনায় আর্থিক সংকটের কারণ দেখিয়ে ক্লাবগুলো ঘরোয়া ফুটবল বিদেশিশূন্য করতে চায়।

কিন্তু এই যুগে বিদেশি ফুটবলার বাদ দেওয়া কোনো কাজের কথা কি? ফুটবল বিশ্লেষক গোলাম সারোয়ার টিপু সরাসরিই বললেন, ‘অবশ্যই না।’ তাঁর ব্যাখ্যা, ফিফা-এএফসিই বিদেশি ফুটবলার খেলানোকে উৎসাহিত করে। খেলার আকর্ষণ, দর্শকের আগ্রহ ইত্যাদি বিবেচনায় বিদেশি থাকা দরকার। কোনো ক্লাব আর্থিক সংকটে থাকলে বিদেশি আনবে না, ব্যস। কিন্তু বিদেশি কোটা বাদ দেওয়ার দাবি তোলার অধিকার নেই ক্লাবের।
বাংলাদেশে ক্লাব যা চায়, সেটিই হয়। বাফুফে অনেকটা সাক্ষীগোপালের মতো। উপরন্তু আগামী ৩ অক্টোবর বাফুফের নির্বাচন সামনে রেখে ক্লাবকে খুশি করার ব্যাপার আছে। বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে আগামী মৌসুমটা বিদেশিবিহীন কাটলে তাই অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। শেষ পর্যন্ত সেটি যদি না-ও হয়, বিদেশি কোটা ৪ জন থেকে কমে যাওয়াটা মোটামুটি নিশ্চিত।

এমন সিদ্ধান্ত দেশের ফুটবলে ভালো ফল বয়ে আনবে না বলে মনে করেন আবাহনীর নাইজেরিয়ান ফুটবলার সানডে সিজোবা। বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে টানা ১০ বছর খেলার অভিজ্ঞতা থেকে এই স্ট্রাইকার বলছেন, ‘বিদেশি বন্ধ করলে বাংলাদেশের ফুটবলেরই ক্ষতি। স্থানীয় ফুটবলারদের সামনে একটা চ্যালেঞ্জ প্রয়োজন। ভালো বিদেশি খেলোয়াড়ের কাছ থেকে নবীনেরা অনেক কিছু শিখতে পারেন।’

২০১১ সালে মোহামেডানের জার্সিতে ঢাকায় খেলা শুরু করা সানডের কাছ থেকেও শিখেছেন অনেকে। মুক্তিযোদ্ধা-শেখ জামাল, আবার মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ২০১৬ সাল থেকে আবাহনীর অনেক সাফল্যের নায়ক তিনি। করোনার কারণে সাড়ে ৫ মাস আবাহনী ক্লাবে ‘বন্দী’ থেকে সানডে অবশেষে আজ বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন মুক্তির আনন্দ নিয়ে। কিন্তু এটিই কি তাঁর শেষ যাওয়া?

বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে টানা ১০ বছর খেলেছেন সানডে সিজোবা।
ছবি: প্রথম আলো

প্রশ্নটা করলে গত শুক্রবার আবাহনী ক্লাব ভবনে দ্বিধান্বিতই লাগল ৩০ বছর বয়সী সানডেকে, ‘আবাহনী ডাকলে আমি আবার ফিরব। অন্য ক্লাবের হয়েও খেলতে পারি। তবে জানি না সামনে কী ঘটতে চলেছে।’ আবাহনীর ম্যানেজার সত্যজিৎ দাশ রুপুও ধোঁয়াশায় আছেন, ‘আগামী মৌসুমে বিদেশি কোটা থাকবে কি না জানি না। থাকলে কয়জন, তা-ও অজানা। দেখি কী হয়।’


বিদেশির আধিক্যের কারণে দেশি স্ট্রাইকার তৈরি হচ্ছে না—এমন একটা বিতর্ক চায়ের কাপে প্রায়ই ঝড় তোলে। তবে ২০১৬ সালে আবাহনীর জার্সিতে প্রিমিয়ার লিগে সর্বোচ্চ গোলদাতা (১৯ গোল) সানডের চোখে এটি নিছকই একটি অজুহাত, ‘আবাহনীতে আমি, জীবন (নাবিব নেওয়াজ), বেলফোর্ট খেলি আক্রমণে। বাকিরা দেশি। সব দলেই দেশি খেলোয়াড়ের আধিক্য। ওরা তাহলে কী করছে? যোগ্যতা থাকলে আপনাকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারবে না।’ যেমন পারেনি নাবিব নেওয়াজ-মতিনদের। ২০১৮-১৯ মৌসুমের লিগে আবাহনীর নাবিবের গোল ১৭টি, বসুন্ধরা কিংসের মতিনের ১১টি। উদাহরণ দুটি টেনে সানডের কথা, জীবন-মতিনরা নিজেদের তৈরি করেছেন। এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

সেই পরিশ্রমের গুণেই গত ৭টি বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে ৮০টির বেশি গোল করেছেন সানডে। নিজেই বলেন, কাজটা সহজ ছিল না, ‌‘শুরুতে এসে ভেবেছিলাম, এ দেশে ফুটবল খেলা সহজ। মাঠে নামব আর দুজন-তিনজন ডিফেন্ডারকে ডজ দিয়ে গোল করব। কিন্তু দ্রুতই বুঝে গেলাম, ব্যাপারটা তা নয়। লিগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা অনেক।’ গত ১০ বছরে সানডে বাংলাদেশের ফুটবলারদের পারিশ্রমিকে ঊর্ধ্বগতি দেখছেন। তবে তাঁর চোখে মাঠ বাড়েনি, মাঠের উন্নয়নও সেভাবে হয়নি। বাজে বেফারিংও হয়। তারপরও সানডের সামগ্রিক মূল্যায়ন, বাংলাদেশের ফুটবল এগোচ্ছে।


কিন্তু তাহলে গত চারটি সাফ ফুটবলে গ্রুপ থেকেই কেন বিদায় নিল বাংলাদেশ দল? ২০১৬ সালে ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে কেন বাংলাদেশ তার ইতিহাসের সর্বনিম্ন অবস্থানে (১৯৭) ঠেকেছে (বর্তমানে ১৮৭)? এ জন্য জাতীয় দলে ভালো ফিনিশারের অভাবকে দায়ী করেন সানডে। তাঁর মতে, বাংলাদেশের ফুটবলারদের অনেকে পরিশ্রমী নন, কঠিন লড়াইয়ের প্রতিশ্রুতিতে ঘাটতি আছে তাঁদের মধ্যে। তবে গত বছর বিশ্বকাপ বাছাইয়ে কাতার, ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের খেলার প্রশংসা ঝরেছে সানডের কণ্ঠে।

টেকনিক, পরিশ্রম, স্কিল, পাসিং—সব মিলিয়ে আবাহনীর নাবিব নেওয়াজ সানডের চোখে বাংলাদেশের সেরা ফুটবলার। জন্মসূত্রে ড্যানিশ জামাল ভূঁইয়ার ফুটবলটাকে তিনি বলেন ‘আলাদা’। আর এ দেশে সবচেয়ে কঠিন ডিফেন্ডার কাকে মনে হয়েছে? সানডে কিছুক্ষণ ভেবে বলেন, ‘তপু বর্মণ ভালো ডিফেন্ডার। সাইফের একটা ছেলের (ইয়াছিন আরাফাত) কথাও বলব...।’ বিদায়বেলায় সমর্থকদের কাছে সানডের অনুরোধ, ‘খেলা শুরু হলে মাঠে যান। ফুটবলারদের সমর্থন দিন।’


১০ বছরে সানডেও হয়তো বুঝেছেন, বাংলাদেশের ফুটবলের সবচেয়ে বড় শক্তি হতে পারে দর্শকেরাই।