বোকারা কাঁদাল ম্যারাডোনার মেয়েকে

বাবার প্রতি বোকার ভালোবাসা দেখে কাঁদছেন দালমা ম্যারাডোনা।ছবি: রয়টার্স

কে বলে ডিয়েগো ম্যারাডোনা নেই?

সশরীর না থাকতে পারেন, আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি অন্যলোকে চলে গেছেন পাঁচ দিন হলো। তবে বিশ্বজুড়ে ফুটবলপ্রেমীদের মনে, ফুটবলারদের ভালোবাসামেশানো শ্রদ্ধায় ম্যারাডোনা ঠিকই আছেন। পরশু বিশ্বের নানা প্রান্তে যেটির প্রমাণ মিলল আরেকবার।

বার্সেলোনায় লিওনেল মেসি আবেগমেশানো অর্ঘ্য দিয়েছেন তাঁর ‘আইডল’কে। ওসাসুনার বিপক্ষে পরশু বার্সার ৪-০ গোলের জয়ে দলের চতুর্থ ও নিজের প্রথম গোলের পর বার্সার জার্সি খুলে নিজের শৈশবের ক্লাব নিওয়েলস ওল্ড বয়েজ ক্লাবে ম্যারাডোনার পরা ১০ নম্বর জার্সি পরে দুহাত তুলেছেন আকাশপানে। হয়তো সেখান থেকেই ম্যারাডোনা অনুভব করেছেন প্রিয় লিওর ভালোবাসা। ম্যারাডোনার সাবেক ক্লাব নাপোলি পরশু রোমাকে ৪-০ গোলে হারানোর পথে আর্জেন্টিনার আকাশি-সাদার মতো নকশায় বানানো জার্সি পরে খেলেছে, গোলের পর ম্যারাডোনার ছবির সামনে তাঁরই জার্সি রেখে জানিয়েছে বিশেষ সম্মান।

আর ম্যারাডোনার হৃদয়ের ক্লাব বোকা জুনিয়র্স তাদের ম্যারাডোনা-উত্তর পৃথিবীতে প্রথম ম্যাচে বিশেষ সম্মান জানিয়েছে কিংবদন্তিকে। যে সম্মান দেখে চোখের জল আর ধরে রাখতে পারেননি স্টেডিয়ামে উপস্থিত ম্যারাডোনার মেয়ে দালমা ম্যারাডোনা।

গত বুধবারই দক্ষিণ আমেরিকার ক্লাব শ্রেষ্ঠত্বসূচক টুর্নামেন্ট কোপা লিবার্তোদোরেসে ব্রাজিলের ক্লাব ইন্তারনাসিওনালের বিপক্ষে ম্যাচ ছিল বোকা জুনিয়র্সের। ম্যারাডোনার মৃত্যুতে সে ম্যাচ পিছিয়ে দেওয়া হয়। কিংবদন্তির মৃত্যুর শোককে শক্তিতে পরিণত করে কালই প্রথম মাঠে নামে বোকা, যে ক্লাবে দুই দফায় অনেক স্মৃতি ম্যারাডোনার। বোকার লা বোমবোনেরা স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে ম্যারাডোনার জন্য আলাদা ভিআইপি বক্সও আছে। বেঁচে থাকলে, সুস্থ থাকলে হয়তো কালও সেখানে বসেই খেলা দেখতেন ম্যারাডোনা!

তিনি নেই, তাঁর মৃত্যুর পর বোকার প্রথম ম্যাচে কাল ম্যারাডোনার বক্সে ছিলেন তাঁর মেয়ে দালমা। ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে এই বক্সে বসে বোকার কতশত ম্যাচ দেখেছেন। ভিআইপি বক্সটা একই ছিল, হয়তো সেখানে ম্যারাডোনার অনেক স্মৃতিচিহ্নও আছে, শুধু ম্যারাডোনা নেই। বাবাকে ছাড়া সেখানে বসে খেলা দেখতে দালমার কেমন লেগেছে, তা হয়তো শুধু তিনিই জানেন।

এভাবেই সবাই গিয়ে জড়ো হয়েছিলেন ম্যারাডোনা বক্সের সামনে।
ছবি: রয়টার্স

তবে বোকার খেলোয়াড়-কোচ-কর্মকর্তারা প্রতিটি মুহূর্তে বুঝিয়ে দিয়েছেন, ম্যারাডোনা তাদের স্টেডিয়ামের বক্সে আর না আসতে পারেন, তাঁদের হৃদয়ে ম্যারাডোনার চিরন্তন উপস্থিতি।

ম্যাচটাও বিশেষই ছিল। আর্জেন্টিনার ঘরোয়া কাপ টুর্নামেন্ট কোপা দে লা লিগা প্রফেসিওনালে বোকা নিজেদের মাঠে খেলেছে ম্যারাডোনারই সাবেক আরেক ক্লাব ও মেসির শৈশবের ক্লাব নিওয়েলস ওল্ড বয়েজ ক্লাবের বিপক্ষে। ম্যারাডোনার স্মৃতিতেই টুর্নামেন্টটার নাম এবার হবে কোপা ডিয়েগো ম্যারাডোনা—সে ঘোষণা ম্যারাডোনার মৃত্যুর দিনেই এসেছে।

তা কাল বোকার ২-০ গোলে জয়ের ম্যাচের ১২তম মিনিটে কলম্বিয়ান স্ট্রাইকার এদউইন কারদোনার দারুণ ফ্রি-কিকে যখন প্রথমবার এগিয়ে যায় দল, খেলোয়াড়েরা গোলের পর সবাই জড়ো হন ম্যারাডোনার বিশেষ বক্সের সামনে। ম্যারাডোনার সম্মানে কাল সবার জার্সির পেছনেই নাম লেখা ছিল—ম্যারাডোনা। শুধু জার্সি নম্বর নিজেদেরটা ঠিক রেখেছেন। ম্যারাডোনার একটা জার্সি বের করে মাঠে বিছিয়ে দেন কারদোনা, তারপর সবাই দালমার দিকে তাকিয়ে একসঙ্গে হাততালি দিতে থাকেন। কিংবদন্তি বাবার জন্য তাঁরই প্রিয় ক্লাবের খেলোয়াড়দের এমন সম্মান দেখে আর চোখের জল ধরে রাখা সম্ভব হয়নি দালমার।

ভালোবাসা বুঝে নিচ্ছেন দালমা।
ছবি: রয়টার্স

ম্যাচ শেষে আবারও সেই বক্সের সামনে গিয়ে হাততালিতে জয়টা ম্যারাডোনাকে উৎসর্গ করেন খেলোয়াড়েরা। আরেকবার কান্নায় ভেঙে পড়েন দালমা। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে পরে বুকে হাত রেখে খেলোয়াড়দের উদ্দেশে বললেন, ‘গ্রাসিয়াস’, এরপর ‘মুচাস গ্রাসিয়াস’। বাংলায়? ধন্যবাদ, অনেক ধন্যবাদ।

বোকার কোচ ও আর্জেন্টিনা জাতীয় দলে ম্যারাডোনার সাবেক সতীর্থ মিগেল আনহেল রুসো ম্যাচের পর জানালেন কীভাবে এই শোক সয়ে খেলোয়াড়দের খেলতে উজ্জীবিত করেছেন, ‘জানতাম ওদের খেলতে নামতে বলা খুব কঠিন হবে। আমি শুধু বলেছিলাম, বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়কে সম্মান জানাতে হলে তোমাদের সেরার মতোই খেলতে হবে, বোকাকে জেতাতে হবে।’