ভিনিসিয়ুস রিয়াল মাদ্রিদে আর দেনিলসন বাংলাদেশ পুলিশে

রিয়াল মাদ্রিদ তারকা ভিনিসিয়ুস জুনিয়রের বন্ধু দেনিলসন এখন বাংলাদেশেছবি: প্রথম আলো গ্রাফিক্‌স

‘কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি বিকেলগুলো সেই, আজ আর নেই। নিখিলেশ প্যারিসে, মঈদুল ঢাকাতে...।’

মান্না দের বিখ্যাত গান জানার কথা নয় ব্রাজিলের দেনিলসন রোলদাওয়ের। তবে ঢাকার নিকুঞ্জের ফ্ল্যাটে জীবনের অন্যতম সেরা মুহূর্তের একটি ছবি দেখিয়ে যেভাবে বন্ধুদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন তিনি, তাঁর জীবনের গল্পকেও মেলানো যায় কালজয়ী এই গানের কথাগুলোর সঙ্গে।

মুঠোফোনে সযত্ন রাখা সাত বছর আগের তোলা একটি রঙিন ছবিতে আঙুল ধরে ধরে বলছিলেন, ‘কোথায় হারিয়ে গেল সেই সোনালি দিনগুলো! ভিনিসিয়ুস জুনিয়র এখন রিয়াল মাদ্রিদে, পাউলিনিও লেভারকুসেনে, ডেভিড ওয়েসলি জুভেন্টাসে...।’

ভিনিসিয়ুস জুনিয়রএখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন রিয়াল মাদ্রিদে, ব্রাজিলের জার্সিতে
ছবি: এএফপি

আর তিনি? তিনি, মানে দেনিলসন রোলদাও বাংলাদেশ পুলিশ ফুটবল ক্লাবের হয়ে খেলতে এখন বাংলাদেশে।

২২ বছর বয়সী এই মিডফিল্ডার খেলেছেন ব্রাজিল অনূর্ধ্ব-১৫ ও ১৭ দলের জার্সিতে। বাংলাদেশে এসেছেন ব্রাজিলের বিখ্যাত ক্লাব ফ্লুমিনেন্স থেকে। ২০২০-২১ মৌসুমে ক্লাবটির হয়ে ম্যাচ খেলতে না পারলেও দুটি ম্যাচে ছিলেন মূল স্কোয়াডে।

আপনি যদি বিশ্ব ফুটবলের সামান্যতম খোঁজখবরও রাখেন, তাহলে রিয়াল মাদ্রিদের ফরোয়ার্ড ভিনিসিয়ুস জুনিয়রকে না চেনার কোনো কারণ নেই। ২০১৫ সালে ভিনিসিয়ুস আর দেনিলসন একই সঙ্গে খেলেছেন ব্রাজিল অনূর্ধ্ব-১৫ দলে।

সেই দলেই খেলেছেন রাইটব্যাক ডেভিড ওয়েসলি, বর্তমানে যিনি ইতালির সফলতম ক্লাব জুভেন্টাসের খেলোয়াড়। ব্রাজিলের সেই বয়সভিত্তিক দলের একাদশের ছবিটি দেখিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে এই প্রতিবেদককে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় দেনিলসনের চোখে মুখে গর্ব। পরক্ষণেই ‘ওরা কোথায় আর আমি কোথায়’ ভেবে একটু হতাশাও। চেষ্টা করেও যা হাসিতে আড়াল করতে পারলেন না।

পুলিশ ক্লাবের বিদেশি ফুটবলারদের ঠিকানা নিকুঞ্জে। ফ্ল্যাটের ছোট একটি রুমে দেনিলসনের বসবাস। কয়েক দিন আগে মধ্যদুপুরে সেই রুমের খাটের ওপর বসেই শোনাচ্ছিলেন জীবনের বাঁকবদলের গল্পগুলো—রিও ডি জেনিরোতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা।

ভিনিসিয়ুসের (১১) সঙ্গে বয়সভিত্তিক দলে দেনিলসন (১৭)
ছবি: সংগৃহীত

বাবা নিরাপত্তাকর্মী, মা গণিতের শিক্ষক। দুই ভাইয়ের মধ্যে দেনিলসন ছোট। ব্রাজিলের বাকি আট-দশটা ফুটবলারের মতো রাস্তায় ফুটবল খেলে বেড়ে ওঠা। প্রতিভার জানান দিয়ে ব্রাজিলের বিখ্যাত ক্লাব ফ্লুমিনেন্সের নজরে আসা।

ক্লাবটির বয়সভিত্তিক দলের হয়ে খেলে জাতীয় বয়সভিত্তিক দলে জায়গা করে নেওয়া। ২০১৫ সালে কলম্বিয়ায় অনুষ্ঠিত সুদা আমেরিকা টুর্নামেন্টে ব্রাজিল অনূর্ধ্ব-১৫ দলের হয়ে আলো ছড়ানো।

ব্রাজিলের জার্সিতে ট্রফি হাতে দেনিলসন
ছবি: সংগৃহীত

সেই টুর্নামেন্টে ৬ গোল করে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়ে ব্রাজিলের চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন ভিনিসিয়ুস। দুজনে একই সঙ্গে ডাক পান অনূর্ধ্ব-১৭ দলেও। সে দলের হয়ে কয়েকটি টুর্নামেন্ট খেলার পরই দেনিলসনের জীবন অন্যদিকে বাঁক নিয়ে নেয়।

২০১৭ সালে সুদা আমেরিকা টুর্নামেন্টে খেলতে যাওয়ার আগে ডান পায়ের হাঁটুতে চোট পান দেনিলসন। হাঁটুর ওপর হাত বোলাতে বোলাতে বলছিলেন, ‘এই চোট আমার ফুটবল ক্যারিয়ারে অনেক পিছিয়ে দিয়েছে। অপারেশনও করাতে হয়েছে। না হলে হয়তো তাদের মতো বড় লিগে খেলতে পারতাম।’

দেনিলসনের বাংলাদেশে খেলতে আসাটা নিছকই ঘটনাচক্রে। নিজেকে কিছুটা দুর্ভাগাও ভাবেন এ জন্য। কারণটা শুনুন তাঁর মুখেই, ‘পর্তুগালে যাওয়ার কথা ছিল আমার। করোনার জন্য সেটা হয়নি। সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। পরে বাংলাদেশে খেলার প্রস্তাব পাই। পরিবারের সঙ্গে আলাপ করে নতুন অভিজ্ঞতার জন্য বাংলাদেশে আসি। আমার বিশ্বাস, এখানে ভালো খেলতে পারলে ভাগ্য বদলানো সম্ভব।’

ব্রাজিলিয়ান বন্ধু রবসন দি সিলভার বদৌলতে বাংলাদেশ সম্পর্কে আগেই জানাশোনা ছিল দেনিলসনের। তাঁর সঙ্গে ফ্লুমিনেন্সে অনুশীলন করতেন বসুন্ধরা কিংসের ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড রবসন। বাংলাদেশে খেলতে এসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে বিষয়গুলো প্রকাশ করেছেন রবসন, সেগুলো দেখেই বাংলাদেশের ফুটবল সম্পর্কে জেনেছেন দেনিলসন।

ব্রাজিল যুব দলের অনুশীলনের একদিন
ছবি:সংগৃহীত

রবসনকে বলা হচ্ছে বাংলাদেশে আলো ছড়ানো অন্যতম সেরা বিদেশি খেলোয়াড়। গত লিগে ২২ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছেন। তাঁর ব্রাজিলিয়ান ব্র্যান্ডের ফুটবলে বুঁদ হয়ে আছেন এ দেশের ফুটবল দর্শকেরা। একটা প্রশ্ন এসেই যায়, রবসন যেভাবে আলোটা নিজের দিকে কেড়ে নিয়েছেন, তাঁর চেয়ে ‘হাইপ্রোফাইল’ হওয়া সত্ত্বেও দেনিলসন কেন সেভাবে আলো ছড়াতে পারছেন না?

ব্যাখ্যা দিলেন দেনিলসন নিজেই, ‘বসুন্ধরা দলটা একসঙ্গে অনেক দিন ধরে খেলছে। খেলোয়াড়েরা ভালো করেই জানেন, কাকে কোথায় পাস দিতে হবে। দলে অধিকাংশ জাতীয় দলের খেলোয়াড়। এ জন্য রবসনের ভালো খেলতে সুবিধা হচ্ছে।’

দেনিলসন এখনো তাঁর নামের প্রতি সুবিচার না করতে পারলেও তাঁর ধমনিতে যে ব্রাজিলিয়ান রক্ত, সেই প্রমাণ অবশ্য পাওয়া যায় মাঝেমধ্যেই। বর্তমানে পুলিশের পয়েন্ট টেবিলের ৪ নম্বরে থাকার পেছনে দলটির বিদেশি ফুটবলারদের অনেক অবদান।

স্বাধীনতা কাপ, ফেডারেশন কাপ ও লিগের প্রায় ৪৫ শতাংশ খেলা শেষে বাংলাদেশের ফুটবল সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন, ‘এখানে শরীরনির্ভর খেলা হয় বেশি। মাঠে প্রচুর ফাউল করা হয়। খেলোয়াড়দের নিরাপত্তা কম।’

তবে তাঁর মুখে স্থানীয় ফুটবলারদের প্রশংসা, ‘আমার মনে হয়, তারা হৃদয় দিয়ে ফুটবল খেলে। মাঠে প্রচুর পরিশ্রম করে। মাঠের বাইরে খুব হাসিখুশি জীবন যাপন করে।’

বাংলাদেশ পুলিশ ফুটবল ক্লাবের জার্সিতে দেনিলসন
ছবি: সংগৃহীত

বসুন্ধরা ও জাতীয় দলের মিডফিল্ডার সোহেল রানার জন্য দেনিলসনের বাড়তি প্রশংসা, ‘বসুন্ধরার ১৭ নম্বর জার্সির (সোহেল রানা) খেলা আমার ভালো লাগে। বলের ওপর ভালো দক্ষতা আছে তার।’

দেনিলসনের সবচেয়ে বড় উপলব্ধিটা হয়তো এ দেশের মানুষের ব্রাজিল–প্রেম। পরিচয় পর্বে যখন কেউ জানতে পারেন তিনি ব্রাজিলের ফুটবলার, তখন পাল্টা ‘ব্রাজিল’ বলে চোখটা বড় করে ফেলেন তাঁরা। দেনিলসনের জীবনকাহিনি পড়ে এতক্ষণে আপনার চোখটাও হয়তো বড় হয়ে উঠেছে।