‘মনে হয়েছে ক্লাব ফিক্সিং করেছে, তাই পদত্যাগ করেছি’

সাইফুর রহমানফাইল ছবি

ঢাকার ফুটবলে নিজ দলের বিরুদ্ধে পাতানো খেলার অভিযোগ তুলে কোনো কোচের পদত্যাগ নজিরবিহীন। তেমনই এক ঘটনার জন্ম দিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক স্ট্রাইকার সাইফুর রহমান (মনি)। ১৯৯৮ সালে জাতীয় দলে অভিষেক হয়েছিল তাঁর। ২০০৮ সালে খেলা ছাড়ার পর কোচিং কোর্স করে এবারই দায়িত্ব নিয়েছিলেন পেশাদার লিগের দ্বিতীয় স্তর চ্যাম্পিয়নশিপ লিগের দল আজমপুর ফুটবল ক্লাব উত্তরার।

দলের বিরুদ্ধে পাতানো খেলার অভিযোগ তুলে সাইফুর গত ২৭ মার্চ পদত্যাগ করেছেন আজমপুরের কোচের পদ থেকে। কমলাপুর স্টেডিয়ামে গত ২০ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে খেলার নামে আসলে কী ঘটছে? প্রথম আলোর মুখোমুখি হয়ে সাইফুর ভয়াবহ এক চিত্র তুলে ধরলেন—

প্রশ্ন:

চ্যাম্পিয়নশিপ লিগের পাতানো খেলার ব্যাপারটা কীভাবে আপনার নজরে এল?

সাইফুর রহমান: গত ২০ মার্চ আমাদের দলের ৭ নম্বর ম্যাচটা দেখে আমার প্রথম সন্দেহ হয়। উত্তরারই আরেক ক্লাব উত্তরা ফুটবল ক্লাবের সঙ্গে খেলে আমরা হারলাম ২–১ গোলে। ম্যাচটাতে আমার টিমের হারার কথা নয়। দলের ওপর এতটুকু আত্মবিশ্বাস আমার ছিল। কিন্তু যে দুটি গোল আমরা খেয়েছি, তা দেখে আমার সন্দেহ জাগে। কারণ, এই গোল আমার দলের খাওয়ার কথা নয়।

প্রশ্ন:

আপনার সন্দেহটা ঠিক কোন জায়গায়?

সাইফুর: আমি যেহেতু এই ম্যাচটা দেখে দ্বিধান্বিত ছিলাম, তাই ওই দিন এ নিয়ে আর কিছু বলিনি। পরদিন আমি ম্যাচের ভিডিও সংগ্রহ করি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন থেকে। সেটা নিয়ে ক্লাবের অফিস রুমে খেলোয়াড়দের নিয়ে বসে রিভিউ করি। পরে আমি তাদের দেখাই...এই যে তোমরা গোল দুটি খাইলা...। আমি তখন খেলোয়াড়দের সরাসরি কিছু বলিনি। এটুকু বলেছি, ‘মনে হয়েছে গোল দুটি ছেড়ে দিছ তোমরা।’ আমি তাদের বলেছি, ‘আমি আমার খেলোয়াড়দের বিশ্বাস করি যে তারা এমন কিছু করবে না। আমার ওই বিশ্বাস তোমাদের ওপর আছে।’

ফরাশগঞ্জ–আজমপুর ক্লাবের ম্যাচটি নিয়ে সাইফুরের মনে বড় প্রশ্ন
সৌজন্য ছবি
প্রশ্ন:

খেলোয়াড়দের ওপর বিশ্বাস আছে...এভাবে বলার কারণ কী?

সাইফুর: বলেছি, কারণ, আমার তো লিগটা এগিয়ে নিতে হবে। আমার একটা টার্গেট ছিল, টিমটাকে চ্যাম্পিয়ন করাব। আমি আমার খেলোয়াড়দের ওভাবেই উজ্জীবিত করি। আমার প্লেয়ারগুলোও খুব ভালো ছিল।

প্রশ্ন:

তারপর কী হলো?

সাইফুর: ২৪ মার্চ ফরাশগঞ্জে বিপক্ষে অষ্টম ম্যাচের ম্যাচের দিন আমি খেলোয়াড়দের ব্রিফিং দিই। আমি আবার প্রতি ম্যাচে ভিন্ন ভিন্ন খেলোয়াড়কে ক্যাপ্টেনসি দিই। এটা কোচিং স্টাফ, ক্লাব অফিশিয়ালসহ সবাই জানে। ক্লাব অফিশিয়াল বলতে আসলে শুধু সভাপতি সাইদুর রহমান মানিক ও রুবেল নামের একটা ছেলে। এই দুজনই ক্লাবটা দেখে। আমি ওদের সঙ্গে কথা বলে সব সময় সিদ্ধান্তগুলো নিই।

প্রশ্ন:

বেশ...তারপর?

সাইফুর: ফরাশগঞ্জের বিপক্ষে আমি সিদ্ধান্ত নিই, ফয়জুল্লাহকে অধিনায়কত্ব দেব। সে ফরাশগঞ্জ ক্লাব থেকে এসেছে। সাবেক ক্লাবের বিরুদ্ধে ক্যাপ্টেনসি পেলে সে মানসিকভাবে উজ্জীবিত থাকবে। এমন চিন্তা করেই ওকে দেওয়া। মাঠে গিয়ে খেলোয়াড় তালিকা জমা দিয়ে দিই। সেদিন ক্লাবের সভাপতি মানিক মাঠে আসে দেরিতে। দল তখন ওয়ার্মআপ করছে। একটু পরেই ম্যাচ। এই সময় ক্লাব সভাপতি এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ক্যাপ্টেনসি কাকে দিয়েছি? আমি বলি, ফয়জুল্লাহকে।

প্রশ্ন:

শুনে ক্লাব সভাপতি কী বললেন?

সাইফুর: ফয়জুল্লাহর নাম শোনার সঙ্গে সঙ্গে সে বলে, ‘না, না, না... ক্যাপ্টেনসি বদল করতে হবে।’ অস্থির সে। তখন আমি বললাম, ‘ক্যাপ্টেন বদল করতে হবে মানে?’ তখন সে নিজে অধিনায়ক বদল করে খেলোয়াড় তালিকা জমা দেয়। ক্যাপ্টেনসি দেয় সাদ্দামকে। তখন আমি চিন্তা করলাম, কোনো দিন তো এমন করে না। ফুটবলে ক্যাপ্টেনসি গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। কিন্তু আজ হঠাৎ বদল করল কেন? আমি চিন্তা করলাম, কারণটা কী?

প্রশ্ন:

এরপর মাঠে কী হলো?

সাইফুর: মাঠে নামার পর দেখলাম, আমি ক্লাবে খেলোয়াড়দের ব্রিফিং করেছি ফরাশগঞ্জের সেসব খেলোয়াড়কে নিয়ে, সেই খেলোয়াড়েরা কেউ নেই। আমি একটু অবাক হলাম। আমি ব্রিফিং করে এলাম কী, আর ফরাশগঞ্জ নামাল কী? এমন তো হওয়ার কথা নয়। তারপরও চিন্তা করলাম, আচ্ছা দেখি, কী হয়?

আজমপুর ক্লাবের অনুশীলনে সাইফুর রহমান
সৌজন্য ছবি
প্রশ্ন:

তা কী দেখলেন?

সাইফুর: আমি কোচ...ডাগআউটে তো আমি থাকব। অথচ ডাগআউটে দাঁড়িয়ে ক্লাব সভাপতিই আগ বাড়িয়ে চিৎকার করে খালি আমাদের খেলোয়াড়দের কয়, গোল করো...গোল করো। আমি এ বিষয়টায় অবাকই হচ্ছিলাম। আজ সভাপতি নিজেই কেন নির্দেশনা দিচ্ছে খেলোয়াড়দের? ওই ম্যাচে আমরা ৩–১ গোলে জিতেছি। কিন্তু ম্যাচের দিন আমার ক্লাব সভাপতির আচরণ আর মাঠের চিত্র দেখে আমার কোচিং স্টাফও সবাই বিরক্ত হয়ে গেছে। তাতে বোঝার বাকি রইল না যে এটা ম্যাচ ফিক্সিং।

প্রশ্ন:

ম্যাচ ফিক্সিং মানে কী দুদল সমঝোতা করে এসেছে?

সাইফুর: দেখুন, পাতানো ম্যাচ যে বাংলাদেশের ফুটবলে হয় না, তা কিন্তু নয়। সব সময়ই হয়ে আসছে। কেউ বলতে পারবে না পাতানো খেলেনি। কিন্তু বিগত দিনে পাতানো হয়েছে কখন, চ্যাম্পিয়নশিপ নির্ধারণ বা অবনমন প্রশ্নে। কিন্তু এখন যা হচ্ছে, মূলত তা স্পট ফিক্সিং। কোনো দলের ওঠা-নামার প্রশ্ন নেই। স্পট ফিক্সিং হলো আজ এত মিনিটে গোল হবে...অমুক দল এত গোলে হারবে বা জিতবে বা অমুক খেলোয়াড় এটা করবে, ওটা করবে। বাইরের কোনো জুয়াড়ি গ্রুপ হয়তো এসব নিয়ন্ত্রণ করে।

প্রশ্ন:

গত বছর প্রথমবারের মতো আরামবাগের সৌজন্যে ঢাকার ফুটবলে প্রথম স্পট ফিক্সিং সামনে এসেছে। কদিন আগেই চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে চারটি দলের (ওয়ারী, অগ্রণী ব্যাংক, ইয়ংমেন্স ফকিরেরপুল ও কারওয়ান বাজার প্রগতি সংঘ) বিরুদ্ধে পাতানো খেলার অভিযোগ পেয়েছে বাফুফে। ওয়ারীর গোলকিপার তাঁর দলের বিরুদ্ধে পাতানো খেলার সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। ব্যাপরটা দেখা যাচ্ছে অনেক গভীরে চলে গেছে...

সাইফুর: এখন অনেক সময় অফিশিয়াল জানে না, কিন্তু খেলোয়াড় ফিক্সিং করে ফেলছে। আসলেই বিষয়টি অনেক গভীরে চলে গেছে। এখন তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

প্রশ্ন:

স্পট ফিক্সিংয়ের কোনো নির্দিষ্ট উদাহরণ কী দিতে পারেন?

সাইফুর: ভিডিও দেখে বুঝেছি। মাঠে দাঁড়িয়ে দেখে ওটা না বোঝার কথা নয়। যে বলে গোল হওয়ার কথা নয়, সেই বল গোল হচ্ছে। এত দিন ফুটবল খেলার পর এতটুকু তো বুঝি। ডিফেন্ডার হয়তো বলবে, সে মিসটেক করেছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত, ম্যাচগুলো পাতানো। আমি আমার দলের সাত নম্বর ম্যাচ দেখার পর পদত্যাগ করতাম। কিন্তু যেহেতু একটু দ্বিধায় ছিলাম, তাই ৮ নম্বর ম্যাচ দেখে যখন সব পরিষ্কার হয়ে যাই, তখন আমি পদত্যাগ করি। আমার দলের ম্যানেজারও একই কারণে পদত্যাগ করেছেন।

প্রশ্ন:

আপনি কীভাবে এই ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হলেন?

সাইফুর: এটাই আমার প্রথম কোচিং। ঠিক করেছিলাম কঠিন পরিশ্রম করব। খেলোয়াড়দের নিয়ে রেজাল্ট নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারব—এমন বিশ্বাস ছিল। তাই আমি ভোর সাড়ে ছয়টায় ধানমন্ডি থেকে উত্তরা যেতাম। সারা দিন পরিশ্রম করেছি এই দলের পেছনে। এমন না যে কোচিং করে টাকা পেয়েছি। উল্টো আমি টাকা খরচ করেছি দলটির পেছনে। ক্লাব যেখানে খেলোয়াড়দের খাওয়া দিতে পারে না ঠিকমতো। ১১ দিন পরও একটা কলা দিতে পারে না...।

চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে খেলছে আজমপুর ক্লাব, যে দলের কোচের দায়িত্ব ছেড়েছেন সাইফুর
সৌজন্য ছবি
প্রশ্ন:

এত অভাব হলে তাহলে ওরা ক্লাব করল কেন?

সাইফুর: কেন করল, সেটা শুধু আল্লাহ জানেন। আমি জানি না। ওরা তো সরাসরি চলে এসেছে বিসিএলে। ক্লাবটাকে বাফুফে সরাসরি এই লিগে জায়গা দিয়েছে। কিন্তু এই ক্লাব আমার মতো বড়জোর দ্বিতীয় বিভাগে খেলার যোগ্য। বিসিএলে খেলার যোগ্যতা রাখে না।

প্রশ্ন:

ক্লাবটা কোথায়? অবকাঠামো কিছু কি আছে?

সাইফুর: কিছুই নেই। ক্লাবটা উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরের ১৯ নম্বর রোডের শেষ মাথায়। সেখানে রেলের জায়গায় খেলোয়াড়দের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে দিনরাত রেলের হর্ন বাজে। অনেক মশা, যে কারণে ২৪ ঘণ্টাই মশারি টাঙিয়ে রাখতে হয় খেলোয়াড়দের। বুঝতেই পারছেন পরিবেশটা কী রকম, যাচ্ছে তাই অবস্থা। এরপরও ক্লাবের খেলোয়াড়দের উজ্জীবিত করে আমি চেষ্টা করেছি যদি চ্যাম্পিয়নশিপটা নিতে পারি...আমারও ক্যারিয়ারে একটা অর্জন হবে। আমি কোচিং ক্যারিয়ার এই ক্লাব দিয়েই শুরু করেছি, ক্লাবের কী আছে কী নেই, তা চিন্তা করিনি।

প্রশ্ন:

বাফুফেকে তো আপনি জানিয়েছেন ঘটনাটা। বাফুফের প্রতিক্রিয়া কী?

সাইফুর: আমি আমার দিক থেকে ব্যাপারটা বাফুফেকে জানিয়েছি। আরামবাগকে যেমন শাস্তি দিয়েছে বাফুফে, এখনো তেমন কিছু করা দরকার। আমি যেন কোনো সমস্যায় না পড়ি, তাই সরে দাঁড়িয়েছি। তবে ফুটবলের যে ক্ষতি হচ্ছে, এটা থেকে যেন আমরা বেরিয়ে আসতে পারি, সেই চেষ্টা থাকা উচিত। আমার কাছে মনে হয়েছে ক্লাব ফিক্সিং করেছে, তাই দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছি।

প্রশ্ন:

তাহলে এই চ্যাম্পিয়নশিপ লিগ (বিসিএল) খেলে কী লাভ হচ্ছে?

সাইফুর: কোনো লাভ নেই। ওয়ারীসহ আরও একটি ক্লাবের কয়েকজন খেলোয়াড়কে নাকি ক্লাব থেকে বের করে দিয়েছে। তলানিতে যেতে যেতে আমাদের তো আর জায়গা নেই পেছানোর। তা ছাড়া পর্যালোচনা করতে হবে, যে পরিমাণ খেলোয়াড় বিসিএল থেকে শীর্ষ লিগ বিপিএলে যাওয়া দরকার, তা কি যাচ্ছে? আমার তো মনে হয় না। তাহলে আমরা এই টুর্নামেন্ট থেকে কী পাচ্ছি?

প্রশ্ন:

কী পাচ্ছি—আপনার কী মত?

সাইফুর: আমার তো মনে হয়, বাংলাদেশের ফুটবল ধ্বংস করছে বিসিএল।