মনেপ্রাণে ‘বাংলাদেশি’ ইংল্যান্ডের ইয়াসমিন
আগামী ২৫ জুলাই বার্মিংহামে বসবে কমনওয়েলথ গেমসের ২২তম আসর। এ গেমস উপলক্ষে ৬ জুন লন্ডনে কুইন্স ব্যাটন রিলেতে (রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের বার্তাবাহী মশালদৌড়) অংশ নিয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইংল্যান্ডের নাগরিক ইয়াসমিন হুসেন।
৪০ বছর আগে জীবিকার টানে ইয়াসমিনের বাবা সৈয়দ নজরুল হুসেন ও মা কামরুন্নেসা হুসেন সিলেটের বালাগঞ্জ থেকে পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে। সেখানেই জন্ম ইয়াসমিনের। ইংল্যান্ডে জন্ম হলেও ৩৮ বছর বয়সী ইয়াসমিনের হৃদয়ে বাংলাদেশ। লন্ডনের রেডব্রিজ থেকে হোয়াটসঅ্যাপে বলছিলেন, ‘বাংলাদেশকে আমি প্রচণ্ড ভালোবাসি। জন্ম এই দেশে হলেও নিজেকে একজন বাংলাদেশি হিসেবেই মনে করি। আমার বাবা-মায়ের বাড়ি বাংলাদেশে।
নানা-নানি সবাই থাকেন সেখানে। আমার স্বামীর বাড়ি সিলেটের সুবিদবাজার। শ্বশুরের ব্যবসা আছে সিলেটে। আমার স্বামী–সন্তানেরা সবাই মনেপ্রাণে বাংলাদেশি। আমি সিলেটের আঞ্চলিক বাংলায় কথা বলতে পারি। তবে আমার মেয়েরা শুদ্ধ বাংলা শিখছে। ওরা বাংলা কবিতাও বলতে পারে।’ ১৯৯২ সালে প্রথম বাংলাদেশে এসেছিলেন ইয়াসমিন। এ পর্যন্ত এসেছেন সাতবার। আগামী ডিসেম্বরে আবারও বাংলাদেশে আসার আগ্রহ রয়েছে ইয়াসমিনের।
ইংল্যান্ডে কমনওয়েলথ গেমসের ব্যাটন রিলেতে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের প্রাথমিক তালিকায় ছিলেন ২ হাজার জন। সেখান থেকে গেমসের আয়োজকেরা বাছাই করেন ৯ জনকে। সেই সংক্ষিপ্ত তালিকায় জায়গা হয় ইয়াসমিনের। যুক্তরাজ্যের বাঙালি মুসলিম কমিউনিটির মেয়েদের মাঝে ফুটবল ছড়িয়ে দিতে অবদান রেখে তিনি দেশটির অনুপ্রেরণাদায়ী নারী হিসেবে হয়েছেন আলোচিত।
গত বছর কমিউনিটি হিরো ক্যাটাগরিতে পেয়েছেন যুক্তরাজ্যের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার বিটি অ্যাকশন ওমেন অ্যাওয়ার্ড। তাঁকে নিয়ে প্রতিবেদন করেছে গার্ডিয়ান–এর মতো বিশ্বের প্রথম সারির গণমাধ্যম।
ফুটবলার হতে চেয়েছিলেন ইয়াসমিন। শৈশবে ম্যানচেস্টারে থাকতে খেলতেন ছেলেদের সঙ্গে। কিন্তু পরিবারের বাধায় থেমে যায় ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন। তবে ইয়াসমিন একেবারে থেমে যাননি। দেড় যুগ পর ফুটবলে ফেরেন কোচ হিসেবে। শৈশবের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে ইয়াসমিন বলেন, ‘আমার বয়স যখন ১৩ বছর একদিন বাবা ডেকে বলেন, তুমি বড় হয়ে যাচ্ছ। এভাবে ছেলেদের সঙ্গে খেলা ঠিক হবে না। অনেকে এটা ভালো চোখে দেখে না। এখন ফুটবল ছেড়ে দাও।’ ইয়াসমিনের বাবা বলেছিলেন, ‘যেখানে মেয়েরা ফুটবল খেলে সেখানে খেলার চেষ্টা করো।’
বাবার পরামর্শে ইয়াসমিন মেয়েদের ফুটবল দল খুঁজতে শুরু করেন। কিন্তু তাঁর এলাকার আশপাশে কোথাও মেয়েদের কোনো ফুটবল দল ছিল না। এরপর হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেন। অনিচ্ছায় ফুটবলকে বিদায় বললেও ফুটবলের প্রতি টান ছিলই। ২০০২ সালে বিয়ের পর বাবার বাড়ি ম্যানচেস্টার ছেড়ে চলে আসেন লন্ডনে। তখন ফুটবল ছেড়ে সংসারে মন দেন তিনি। কিন্তু একসময় হতাশায় ভুগতে শুরু করেন, ‘তখন নিজের জন্য কিছু একটা করতে চাইতাম। এমন কিছু করতে চাইতাম, যা আমি উপভোগ করি। আর সেটা ভেবেই ২০১৭ সালে ফুটবল কোচিং শুরু করা।’
নিজের পরিকল্পনার কথা স্বামীকে জানালে তিনিও সম্মতি দেন। মূলত মুসলিম কমিউনিটির মেয়েদের খেলার পরিবেশ তৈরি করতেই সিদ্ধান্ত নেন ফুটবলে ফেরার, ‘আমার দুই মেয়েকে কারাতে শিখতে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু তারা এসে বলত, আমরা আর খেলতে চাই না। কারণ, সেখানে শুধু ছেলেরা খেলে। আমি তখন নতুন করে উপলব্ধি করি যে আমাদের কমিউনিটির মেয়েদের জন্য খেলাধুলার পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। এসব কারণ আমাকে কোচ হতে আরও উৎসাহিত করেছে।’
কোচেস কোর্স শেষ করে ইয়াসমিন যোগ দেন স্থানীয় একটি ক্লাবে। সেখানে প্রথমে ছেলেদের কোচিং করালেও পরে মেয়েদের দল গড়ার কাজ শুরু করেন। সেই গল্পটা বলছিলেন তিনি, ‘তখন মনে হতো আমি তো ছেলেদের শেখাতে আসিনি। আমার লক্ষ্য মেয়েদের ফুটবল শেখানো। এরপর সেই ক্লাবে মেয়েদের দল গড়ে তোলার কাজে হাত দিই। এখন আমার ক্লাবে ৮০ জন মেয়ে ফুটবল খেলে।’
ছোটবেলায় ফুটবল খেলতে গেলে চারপাশ থেকে নেতিবাচক কথা শুনতেন। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে বলে মনে হয়েছে ইয়াসমিনের, ‘এখন কমিউনিটিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আমার যে খালা-ফুফুরা এসব পছন্দ করতেন না, তাঁরা এখন আমাকে উৎসাহ দেন। প্রশংসা করেন। তাঁরা এখন বলেন, তুমি আমাদের মেয়েদের খেলার পরিবেশ তৈরি করে দিতে পেরেছ।’
যুক্তরাজ্যে মুসলিম মেয়েদের মধ্যে ফুটবলে আগ্রহ বাড়ছে বলে জানালেন তিনি, ‘তিন বছর আগেও পাঁচজন মুসলিম মেয়েকে ফুটবলে আনা কঠিন ছিল। তাদের অনেক ডাকাডাকি করে আগ্রহী করে তোলা যেত না। এখন আমাদের তিনটি দল আছে।’ মেয়েদের পাশাপাশি মায়েদেরও অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছেন ইয়াসমিন, ‘কেউ যদি ফুটবলকে পেশা হিসেবে নিতে চায়, আমি তাকে সহযোগিতা করব। আমি লন্ডনের বিভিন্ন কমিউনিটিকে উদ্বুদ্ধ করতে চাই। আমি তাদের বলতে চাই, কেউ মা হয়ে গেলে খেলতে পারবে না, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। সে খেলতে পারে। কোচও হতে পারে।’