মালদ্বীপের শিশুরা বড় হচ্ছে ফুটবল একাডেমিতে

শিশুদের ফুটবলেই বেড়ে তুলতে চায় মালদ্বীপ সরকার

মাত্র সাত বর্গকিলোমিটারের চেয়েও ছোট্ট একটি শহর মালে। কিন্তু খেলাধুলার সব সুযোগ–সুবিধা আছে সেখানে। সীমিত জায়গার মধ্যে যতটা সম্ভব খেলাধুলার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে গড়ে তোলার ব্যবস্থা নিয়েছে মালদ্বীপ সরকার। এ কাজে সরকারকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিচ্ছে ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন অব মালদ্বীপ। শহরের ভিন্ন স্থানে ফুটবল সংস্থার পক্ষ থেকে স্থাপন করা হয়েছে ছোট ছোট টার্ফ। শিশু–কিশোররা সেখানে ফুটবল অনুশীলন করে।

শহরের এক প্রান্তে একটি টার্ফে চোখ আটকে গেল। চারপাশ ঘেরা সুরক্ষিত ওই মিনি টার্ফে একদল শিশু ফুটবল খেলা অনুশীলন করছে ভরদুপুরে। যেনতেন টার্ফ নয়, একেবারে সবুজ এবং মসৃণ। কাছে গিয়ে কোচের কাছে জানতে চাইলে তিনি সানন্দেই কথা বললেন।

কোচ মোহাম্মদ শরিফ বলেন, তাঁর একাডেমির অধীনে এই শিশুরা অনুশীলন করছে। মালদ্বীপে বেসরকারি উদ্যোগে এমন একাডেমি অনেক রয়েছে। মনে হলো, বাংলাদেশেও বেসরকারি উদ্যোগে কিছু একাডেমি রয়েছে; কিন্তু সেসবের সঙ্গে মালদ্বীপের একাডেমিগুলোতে রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। মালদ্বীপের একাডেমি মানে ছয়–সাত বছর বয়স থেকে সেখানে শেখানো হয় শিশুদের। বাংলাদেশে সাধারণত ১৩–১৪ বছর বয়সে ছেলেরা আনুষ্ঠানিকভাবে ফুটবলের পাঠ নিতে আসে। এখানেই মূল পার্থক্য। খুব ছোটবেলা থেকেই ফুটবল খেলা শেখানোর প্রতিষ্ঠানিক পদ্ধতিই মালদ্বীপের ফুটবলকে আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছে।

গতকাল সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশকে যেভাবে ২-০ গোলে হারিয়েছে মালদ্বীপ, তাতে বোঝা যায় মালদ্বীপের ফুটবল বাংলাদেশের তুলনায় কতটা অগ্রসর। মানের দিক থেকে তারা অনেকটা এগিয়ে। এই মান এক দিনে অর্জিত হয়নি। এটি ছোটবেলা থেকে শিশুদের গড়ে তোলার ফল।

মালে শহরের একটি ফুটবল একাডেমিতে শিশুরা
ছবি: প্রথম আলো

এখানকার শিশুরা ভালো মাঠে ফুটবল শিখছে। টার্ফের সঙ্গে অভ্যস্ত হচ্ছে জীবনের শুরুতেই। অথচ বাংলাদেশের ছেলেরা ফুটবল শেখে এবড়োখেবড়ো মাঠে। মাঠ যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তা বোঝা গেল শহরের ফুটবলের অবকাঠামো দেখে। এ দেশের ফুটবলে সবকিছুই চলে একটি নিয়ম মেনে, পরিকল্পনা সাজিয়ে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পরিকল্পনায় ঘাটতি রয়েছে।

নিজ দেশের নানা পরিকল্পনার ফিরিস্তি দিয়ে মোহাম্মদ শরিফ বলেন, মালদ্বীপের নতুন প্রজন্মের খেলোয়াড়রা দেশটির ফুটবলের সবচেয়ে বড় তারকা আলী আশফাকের মতো হতে চায়। গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের বিপক্ষে পেনাল্টিতে দ্বিতীয় গোল করা আশফাক মালদ্বীপের ইতিহাসে সেরা ফুটবলার। ৩৬ বছর বয়সেও তিনি দলের প্রাণ। আলী আশফাকে মুগ্ধ মোহাম্মদ শরিফ বলেন, আলী আশরাফ আজকের ছেলেদের কাছে অনেক বড় আদর্শ। তাঁর আচার–ব্যবহার অন্যরকম। সবাই তাঁকে পছন্দ করে। অভিভাবকেরাও তাঁদের ছেলেকে আলী আশফাকের মতো তৈরি করতে চান। এ কারণে তাঁরা ছোটবেলা থেকে ছেলেদের একাডেমিতে নিয়ে আসেন।

কিছু একাডেমি শিশুদের কাছ থেকে মাসে এক হাজার রুফিয়াহ (মালদ্বীপের মুদ্রা) নেয়, যার মূল৵মান বাংলাদেশে পাঁচ হাজার টাকা। কিছু একাডেমিতে বাংলাদেশের এক-দেড় হাজার টাকায়ও শেখা যায়। তবে টাকা কোনো বিষয় নয়। মালদ্বীপের আজকের নবীনেরা ফুটবল খেলা শিখতে চায়। মালদ্বীপ ফুটবলের তৃণমূলে কাজ করা কোচ মোহাম্মদ শরিফ বলেন, শুধু আশফাক নয়, মুসাসহ অনেকেই আজ জাতীয় তারকা। আলী ফাসির ও বর্তমান অধিনায়ক আবদুল্লাহ গনি যাঁর যাঁর অবস্থানে আজ প্রতিষ্ঠিত। একসময়ে খুদা মুসাও দারুণ খেলেছেন মালদ্বীপের জার্সিতে। তিনি সাফ গেমসে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তাঁদের সামনে রেখেই আসলে মালদ্বীপের ফুটবলের ভিত্তি তৈরি হচ্ছে দৃঢ়ভাবে।

ছোট্ট রাষ্ট্র মালদ্বীপে এমন মাঠে আছে যথেষ্টই
ছবি: টুইটার

শুধু তা–ই নয়, শহর ঘুরে দেখা গেল, কয়েকটি স্থানে ২০০৮ ও ২০১৮ সালে সাফ গেমসে চ্যাম্পিয়ন হওয়া মালদ্বীপ জাতীয় ফুটবল দলের বিশাল ব্যানার টানিয়ে রাখা হয়েছে। ফুটবলারদের যোগ্য সম্মান দিয়েছে মালদ্বীপ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন। অথচ বাংলাদেশের ফুটবলের সাফল্যের কোনো ছবি কোথাও দেখা যায় না। ১৯৯৫ সালে মিয়ানমারে চার জাতি ট্রফি জয়, ১৯৯৯ বা ২০০৩ সালে অনুষ্ঠিত সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে কোনো দলেরই কোনো ছবি চোখে পড়বে না রাস্তা কিংবা অন্য কোথাও। কিন্তু মালদ্বীপের আলী আশফাকদের ছবি দেখা যায় শহরের দেয়ালে, ফুটবল মাঠের পাশে।

ভাবলে অবিশ্বাস্য লাগে যে ১৯৮৫ সালে ঢাকা সাফ গেমসে এই মালদ্বীপকে বাংলাদেশ ৮-০ গোলে উড়িয়ে দিয়েছিল। সেই অপমান বাংলাদেশকে ফিরিয়ে দিয়েছে মালদ্বীপ। ২০১৬ মালে মালেতে লাল-সবুজের বাংলাদেশ দলের বিপক্ষে মালদ্বীপের জয় হয় ৫-০ গোলে। মালদ্বীপের ফুটবলে বদল আসে তারও অনেক আগে, ১৯৯৭ সালে সাফ টুর্নামেন্টে রানার্সআপ হওয়ার পর। ২০০৩ সালে ঢাকা সাফ গেমসে বাংলাদেশের কাছে হেরে রানার্সআপ হন লাল জার্সিধারীরা। ২০০৮ ও ২০১৮ সালে হন চ্যাম্পিয়ন।

এক সময়ের দুর্বল মালদ্বীপ এখন তৈরি করছে দারুণ সব ফুটবলার
ছবি: বাফুফে

মোহাম্মদ শরিফ এসব প্রসঙ্গে টেনে বলেন, ১৯৯৭ সালে সাফল্যের পর মালদ্বীপ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন ও সরকার নবীনদের গড়ে তোলার ওপর জোর দেয়। ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের চাপে ক্লাবগুলো তরুণদের গড়ে তুলতে একাডেমি প্রতিষ্ঠার দিকে পা বাড়ায়। তারই ফল আজকের মালদ্বীপের ফুটবল।

মাত্র ৩০০ বর্গকিলোমিটারের ছোট্ট দেশ মালদ্বীপে ফুটবল ১ নম্বর খেলা। এ দেশে ফুটবলার তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখছে মিনি টার্ফ। শহরে বেশ কিছু মিনি টার্ফ চোখে পড়ল। বিভিন্ন আইল্যান্ডেও মিনি টার্ফ আছে। এসব টার্ফের বেশির ভাগই সরকারের উদ্যোগে বসানো। কিছু ফিফার অনুদান। ফিফা–সরকার–ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সম্মিলিত চেষ্টায় মালদ্বীপের ফুটবল এগোচ্ছে।

এদিকে বাংলাদেশে একটি মিনি টার্ফ বসানো নিয়ে কত নাটক! ফিফার দেওয়া মিনি টার্ফ বসানো হয়েছে ফেনী ও নীলফামারীতে। নীলফামারীর স্টেডিয়ামের ভেতরে টার্ফ বসিয়ে কী লাভ কে জানে! স্টেডিয়ামে এমনিতেই ছেলেরা ঘাসের মাঠে খেলতে পারে। স্টেডিয়ামের ভেতরে না বসিয়ে বাইরে বসালে টার্ফটি অনেক বেশি কার্যকর হতো। সেটা হয়নি, জায়গা দেবে কে? এসব প্রশ্ন ওঠায়।

মালদ্বীপ এখন ফুটবল নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখে
ছবি: বাফুফে

বাফুফে আর কোনো মিনি টার্ফ আনতে পারেনি ফিফা থেকে। বাফুফের চোখ বড় বড় টুর্নামেন্টে, বড় অঙ্কের কোচিং স্টাফে। ফুটবলের অবকাঠামো তৈরিতে মনোযোগ নেই, আগ্রহে রয়েছে তীব্র ঘাটতি। অথচ জায়গার অভাব থাকা সত্ত্বেও মালদ্বীপ ৮ থেকে ১০টি মিনি টার্ফ বসিয়েছে মালে শহরে। অথচ ঢাকা শহরে একটিও মিনি টার্ফ নেই।

এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনের নিয়ম অনুযায়ী, ক্লাবগুলোর একাডেমি থাকা বাধ্যতামূলক। মালদ্বীপের ক্লাবগুলো সেটা মানছে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্লাবগুলোর এসব কাজে আগ্রহ নেই। যে কারণে বাংলাদেশের ফুটবলে নবীনদের গড়ে তোলার কোনো প্রক্রিয়া আজও শুরু হলো না। আর সেটা হয়নি বলেই মাঠের খেলায় মালদ্বীপের সঙ্গে পার্থক্য বোঝা যায় সহজেই।