মুন্নার সেই জার্সিগুলো...

• ১২ ফেব্রুয়ারি মোনেম মুন্নার মৃত্যুদিন।
• ২০০৫ সালের এই দিনে চিরবিদায় নেন তিনি।
• দেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা তারকা মুন্না।
• মুন্নার ব্যবহৃত ৬ জার্সি নিয়ে এই ফিচার।

১২ ফেব্রুয়ারি তারিখটা এলেই কেমন যেন এক শূন্যতার অনুভূতি হয়। বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীদের কাছে এ যেন দুঃসহ এক বেদনার দিন। ২০০৫ সালের এই দিনেই পৃথিবীকে বিদায় জানিয়েছিলেন মোনেম মুন্না—এ দেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা তারকা। এক যুগেরও বেশি সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর মুন্নার অভাবটা অনুভূত হয় বাংলাদেশের ফুটবলের তারকাশূন্যতাকে কেন্দ্র করে নয়, বরং অনেক বেশি করেই তাঁর ফুটবলকীর্তির কারণেই।

এ প্রজন্মের স্মৃতিতে মুন্না নেই। থাকবেন কী করে? ইন্টারনেট যুগের আগের এই ফুটবলারকে যে খুঁজে নিতে হয় পুরোনো পত্রিকার ধূলি-ধূসরতায় কিংবা কারও ঝাপসা স্মৃতির নির্ভরশীলতায়। এই প্রজন্ম যদি হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসে, কেমন ছিল মোনেম মুন্নার খেলা, কিংবা কতটা গতি ছিল তাঁর শটে? উত্তর দেওয়াটা কঠিনই হয়ে যাবে। ভাবতে অবাক লাগে, মুন্না যখন খেলছেন, ঢাকার ফুটবল দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, তখন যুগটা তথাকথিত ডিজিটাল না হলেও ছিল ভিডিও প্রযুক্তির। অথচ মুন্নার খেলার এতটুকু ভিডিও ফুটেজের খোঁজ মিলবে না কারোর কাছে। দেশের ফুটবলের হর্তাকর্তা বিধাতা ফুটবল ফেডারেশনের কথা বাদ দিন, কিন্তু যে ক্লাবে তিনি নিজের যৌবনের পুরো সময়টা ব্যয় করেছেন, যে ক্লাবকে তিনি সাফল্য উপহার দিয়েছেন, সেই আবাহনীর কাছে কি তাঁর খেলার কোনো ভিডিও ফুটেজ সংরক্ষিত আছে? যদি থাকে, তাহলে অবাক হতেই হবে। মুন্নার স্মৃতি এখন রায়েরবাজারের ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটের চৌহদ্দিতেই সীমাবদ্ধ। যেখানে এখন বাস করেন তাঁর প্রিয়তমা স্মৃতি সুরভী মোনেম তাঁর দুই ছেলেমেয়ে ইউশরা মোনেম দানিয়া ও আজমান সালিদকে নিয়ে। তাঁরাই বয়ে বেড়াচ্ছেন মুন্নার স্মৃতি। রায়েরবাজারের সেই ফ্ল্যাটের আনাচকানাচে মুন্না যেন বর্তমান হয়েই আছেন। এক দশকের ফুটবল ক্যারিয়ারকে ধারণ করে রাখা ছবির অ্যালবাম কিংবা দেয়ালে বড় করে বাঁধিয়ে রাখা ছবিগুলো যেন চিৎকার করে জানান দিতে চাইছে এ দেশের ক্রীড়াঙ্গনে মুন্নার অবস্থানটা।

ছেলে আজমান খুব যত্ন করেই রেখে দিয়েছে বাবার স্মৃতিময় কিছু জার্সি। যে জার্সিগুলো পরে মুন্না মাঠ মাতিয়েছেন, দেশে-বিদেশে। যে জার্সিগুলোতেই দেশের ফুটবলপ্রেমীদের একটা প্রজন্মের কাছে তারকা হয়ে উঠেছেন। আজ এত বছর পরেও সেই জার্সিগুলোতেই বেঁচে আছেন মুন্না। সেই জার্সিগুলোই যেন এই প্রজন্মের কাছে তুলে ধরছে তাঁকে।

প্রিয় পাঠক, মুন্নার কোনো খেলার ভিডিও ফুটেজ আমরা আপনাদের সামনে তুলে ধরতে পারব না। অনেক চেষ্টা করেও তেমন কিছুর খোঁজ আমরা পাইনি। মুহূর্তকে থামিয়ে রাখা আলোকচিত্রে মুন্নাকে তুলে ধরা হয়েছে অনেকবারই। এবার না হয় খেলোয়াড়ি জীবনে ব্যবহৃত জার্সিতেই এই ক্ষণজন্মা তারকাকে তুলে ধরা যাক। এটা নিশ্চিত, জার্সিগুলো আপনাদের অনেককেই নস্টালজিক করে তুলবে। নিয়ে যাবে সেই অতীত দিনগুলোয়; যখন মুন্না ঝড় তুলতেন লাখো-কোটি ফুটবলপ্রেমীর মনে।

মুন্নার খেলোয়াড়ি জীবনে ব্যবহৃত ছয়টি জার্সি নিয়ে আমাদের এই ফটোফিচার। এই ছয় জার্সিতেই পাঠকেরা পেয়ে যাবেন মোনেম মুন্নার গোটা ক্যারিয়ার...

১৯৮৬ সালে এই জার্সিতেই ব্রাদার্সে খেলেছিলেন মুন্না
১৯৮৬ সালে এই জার্সিতেই ব্রাদার্সে খেলেছিলেন মুন্না

ব্রাদার্সের জার্সিতে মুন্না হয়ে ওঠা
কমলা রঙের জার্সিটা মুন্না খুব যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন তাঁর আলমারিতে। তিনি আবাহনীর মুন্না হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন এই ক্লাবেই ক্যারিয়ারের প্রায় পুরো সময় কাটিয়ে দেওয়ায়। কিন্তু মুন্না আবাহনীর হওয়ার আগে ব্রাদার্সে থেকে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন দারুণভাবে। ১৯৮৬ সালে ব্রাদার্সের হয়ে খেলেছিলেন মুন্না। সেখানেই তাঁকে চিনেছিল বাংলাদেশের ফুটবল। ব্রাদার্সের প্রতি অদ্ভুত এক কৃতজ্ঞতাবোধ কাজ করত বলেই হয়তো জার্সিটা আলাদাভাবেই তুলে রেখেছিলেন তিনি।

১৯৮৬ সালে পাকিস্তানের কায়েদে আজম ট্রফিতে মুন্নার ব্যবহৃত জার্সি
১৯৮৬ সালে পাকিস্তানের কায়েদে আজম ট্রফিতে মুন্নার ব্যবহৃত জার্সি

দেশের রঙে প্রথম 
১৯৮৬ সালে পাকিস্তানের করাচিতে কায়েদে আজম ট্রফিতে দেশের জার্সিতে প্রথম খেলেছিলেন মুন্না। তবে সেটি পুরোপুরি জাতীয় দল ছিল না। বেশির ভাগ তরুণ, উদীয়মান ফুটবলারদের নিয়ে গড়া একটি দলই পাকিস্তানে খেলতে গিয়েছিল। গোটা মৌসুমে ব্রাদার্সের হয়ে দারুণ খেলা মুন্নাও ছিলেন সেই দলের অংশ। কী আশ্চর্য, সেই দলই কিনা সেবার ইরানের অনূর্ধ্ব-২৩ দলকে ১-০ গোলে হারিয়ে এসেছিল! মুন্না তো সেই স্মৃতি রাখবেনই।

১৯৮৬ সালে এই জার্সি পরেই সিউল এশিয়ান গেমসে প্রথমবারের মতো মূল জাতীয় দলে খেলেছিলেন মুন্না
১৯৮৬ সালে এই জার্সি পরেই সিউল এশিয়ান গেমসে প্রথমবারের মতো মূল জাতীয় দলে খেলেছিলেন মুন্না



পূর্ণাঙ্গ জাতীয় দলে প্রথম 
কায়েদে আজম ট্রফিতে দুর্দান্ত খেলার পর মুন্নাকে আর কখনোই পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৮৬ সালের সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে নবম এশিয়ান গেমসে প্রথমবারের মতো জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চাপালেন মুন্না। ইরান, জাপান, কুয়েত ও নেপাল সেবার ছিল বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ। জাতীয় দলের জার্সিতে নিজের প্রথম বড় অ্যাসাইনমেন্টে প্রতিটি ম্যাচেই খেলেছিলেন মুন্না। সিউলেই বাংলাদেশ পায় এশিয়াড ফুটবলে প্রথম জয়, নেপালকে হারিয়ে। মুন্না সিউল এশিয়াডের একটি জার্সি খুব যত্ন করেই রেখেছিলেন।

১৯৮৭ সালে আবাহনীর হয়ে মুন্নার প্রথম জার্সিটি
১৯৮৭ সালে আবাহনীর হয়ে মুন্নার প্রথম জার্সিটি

প্রথমবারের মতো নীল-হলুদের প্রতিনিধি
১৯৮৭ সালে মুন্নাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি আবাহনী-মোহামেডানের। দলে ভেড়াতেই হবে এই উদীয়মান তারকাকে। শেষ পর্যন্ত জয় হলো আবাহনীরই। মুন্নাও যেন চিরবসতি গড়লেন এই ক্লাবে। ক্যারিয়ারের শেষ দিন পর্যন্ত আবাহনীর নীল-হলুদ জার্সিকেই আপন ভেবেছেন। এই আবাহনীর হয়ে নিজেকে গড়েছেন দেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা তারকা হিসেবে। ১৯৯১ সালে আবাহনীই তাঁকে ২০ লাখ টাকায় রেকর্ড গড়ে নতুন করে চুক্তিবদ্ধ করেছিল। আবাহনীর হয়ে লিগ জিতেছেন ১৯৯০, ১৯৯২, ১৯৯৪ ও ১৯৯৫ সালে। অধিনায়ক হিসেবে ১৯৯৪ ও ১৯৯৫ সালে। ১৯৮৭ সালে আবাহনীর হয়ে পাওয়া প্রথম জার্সিটি মুন্নার কাছে ছিল অসম্ভব প্রিয়।

১৯৮৯ সালে প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দলের হয়ে মুন্নার জার্সি
১৯৮৯ সালে প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দলের হয়ে মুন্নার জার্সি



দেশের জার্সিতে প্রথম গৌরব
১৯৮৯ সালে দেশের জার্সিতে প্রথম সুযোগ পেলেন গৌরবের প্রতিনিধিত্ব করার। সেবার প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে দক্ষিণ কোরিয়ার একটি দলকে হারিয়ে বাংলাদেশ লাল দল (মূল জাতীয় দল) জিতে নেয় শিরোপা। আন্তর্জাতিক ফুটবল প্রতিযোগিতায় সেটিই ছিল বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের প্রথম কোনো সাফল্য। সাদার মধ্যে লাল মিশ্রিত জাতীয় দলের সেই জার্সি নাকি বাকি জীবনে মুন্নার অত্যন্ত প্রিয় হয়েই ছিল।

১৯৯০ সালে বেইজিং এশিয়ান গেমসে প্রথমবারের মতো অধিনায়কত্ব করেছিলেন এই জার্সি পরেই
১৯৯০ সালে বেইজিং এশিয়ান গেমসে প্রথমবারের মতো অধিনায়কত্ব করেছিলেন এই জার্সি পরেই



জাতীয় দলের প্রথম নেতৃত্ব
১৯৮৯ সালে ইসলামাবাদ সাফ গেমসের ফাইনাল হঠাৎ করেই নেতৃত্ব চলে আসে মুন্নার কাঁধে; জাতীয় দলের মূল অধিনায়ক ইলিয়াস হোসেনের নিষেধাজ্ঞার কারণে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় দলের নেতৃত্ব পেতে খুব বেশি দেরি হয়নি তাঁর। ১৯৯০ সালে চীনের বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসে জাতীয় দলের অধিনায়কত্বের আর্মব্যান্ড ওঠে তাঁর হাতে। সৌদি আরব ও জাপানের বিপক্ষে গ্রুপ পর্যায়ের দুটি ম্যাচেই বাংলাদেশ হেরে যায় যথাক্রমে ৪-০ ও ৩-০ গোলে। ফল ভালো না হলেও নিজের প্রথম অধিনায়কত্বের স্মৃতি মুন্না কিন্তু সংরক্ষণ করেছেন যত্ন করেই।