মেসিদের মতো রিয়ালও শিকার হবে ‘অ্যানফিল্ড লজ্জা’র?

ভুলে যাওয়ার মতো এক রাত কেটেছে লিভারপুলের।
ছবি: রয়টার্স

অ্যানফিল্ডের সেই ম্যাচ!

লিভারপুল সমর্থকেরা হয়তো এখন এই শব্দগুলোই জপছেন। মনেপ্রাণে প্রার্থনা করে যাচ্ছেন, ২০১৯ চ্যাম্পিয়নস লিগ সেমিফাইনালের দ্বিতীয় লেগে বার্সেলোনাকে অ্যানফিল্ডে যেভাবে কাঁদিয়েছিল লিভারপুল, ইয়ুর্গেন ক্লপের দলটা এবার রিয়াল মাদ্রিদকেও তেমন কিছুই উপহার দেবে।

গোলের ব্যবধান হিসাব করলে তো এবার লিভারপুল ভালো জায়গাতেই আছে। ২০১৯ চ্যাম্পিয়নস লিগ সেমিফাইনালের প্রথম লেগে লিওনেল মেসির জোড়া গোলে বার্সেলোনার মাঠে ৩-০ গোলে হেরেছিল লিভারপুল। কিন্তু দ্বিতীয় লেগে সালাহ-ফিরমিনোকে ছাড়াই ফিরে আসার চোখধাঁধানো গল্প লিখেছে ক্লপের দল। ৪-০ গোলে দ্বিতীয় লেগ জিতে উঠে যায় ফাইনালে, পরে তো মাদ্রিদের সেই ফাইনালে শিরোপার উৎসবও করেছিল। সে তুলনায় এবার তো রিয়ালের বিপক্ষে প্রথম লেগের ব্যবধান বার্সার চেয়ে কমই।

এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগ কোয়ার্টার ফাইনালের প্রথম লেগে কাল রিয়ালের মাঠে ৩-১ গোলে হেরে এসেছে লিভারপুল। তাদের ভাগ্য ভালো যে আরও গোল খায়নি। তবে সে যা-ই হোক, এবার হারের ব্যবধান দুই গোলের, সোনার দামে বিকোনো প্রতিপক্ষের মাঠের একটা গোলও (অ্যাওয়ে গোল) পেয়ে গেছে লিভারপুল।

এবার তো আর বার্সার মতো চার গোলের দরকার পড়বে না, শুধু রিয়ালকে গোল করতে না দিয়ে দুই গোল করলেই তো সেমিফাইনালে উঠে যাবেন সালাহ-জোতারা।

সে হিসাবে কাজটা সহজ মনে হতে পারে। তবে লিভারপুল কোচ ক্লপ তা ভাবছেন না। আগামী বুধবার দ্বিতীয় লেগে বার্সার বিপক্ষে সেই ম্যাচের মতো আরেকটি ‘অ্যানফিল্ড মহাকাব্য’ দেখবে ফুটবল? দুই বছর আগের সেই ম্যাচের চেয়ে এবারের চ্যালেঞ্জটা কি বেশি আলাদা? এমন প্রশ্নে কাল ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে ক্লপ বললেন, ‘অবশ্যই। পুরোপুরি আলাদা।’

কেন আলাদা? সেবার অ্যানফিল্ড ছিল প্রায় ৫৫ হাজার দর্শকে গমগমে, কিন্তু করোনার কারণে এবার অ্যানফিল্ড থাকবে দর্শকহীন, থমথমে। সব সময়ই নিজেদের সমর্থকদের শক্তিকে অন্য রকম মর্যাদায় দেখা ক্লপ তাই বলছেন, ‘আবেগে মাখা কোনো স্মৃতি তৈরি করতে হলে বার্সেলোনার বিপক্ষে সেই ম্যাচের দিকে ফিরে দেখতেই হবে। কিন্তু সেই ম্যাচে লিভারপুল যা করেছে, তার ৮০ শতাংশই সম্ভব হয়েছে স্টেডিয়ামের আবহের কারণে। সেদিক থেকে ভাবলে হ্যাঁ, এবার সেটি ছাড়াই কাজ চালিয়ে যেতে হবে আমাদের।’

দর্শক থাকলেই যে লিভারপুল প্রত্যাবর্তনের গল্প লিখে ফেলত, ব্যাপারটা তো আর এমন নয়! লিভারপুল এর আগে অনেকবার ফিরে আসার গল্প লিখেছে চ্যাম্পিয়নস লিগে, ইউরোপা লিগে কিংবা ইংল্যান্ডের লিগ–এফএ কাপ-লিগ কাপে। ২০০৫ চ্যাম্পিয়নস লিগের মহাকাব্যিক সেই ফাইনাল, দুবছর আগের বার্সেলোনার বিপক্ষে ম্যাচ, তার আগে ২০১৬ সালে লিভারপুলে ক্লপের প্রথম বছরে ইউরোপা লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের বিপক্ষে।

কিন্তু তাতেই যে ‘কামব্যাক কিংস’ হয়ে গেছে লিভারপুল, আর সেটিই যে এবারও ফিরে আসার নিশ্চয়তা দেয়, তা তো নয়! ক্লপ তা জানেন।

তবে দর্শক নেই বলে এবার কাজটা আরও কঠিন হবে, সেটিই মনে করিয়ে দিলেন ক্লপ, ‘এমন নয় যে আমি এখানে বসে ভাবছি আমরা কামব্যাক কিংস, সব সময়ই এভাবে ফিরে আসব আমরা। অনেকবারই এভাবে ফিরে এসেছি, কিন্তু প্রতিবারই স্টেডিয়ামে আমাদের সমর্থক ছিলেন। এবার আমাদের সে সুবিধা নেই, তাই এবার আমরা সেভাবে ফিরে আসতে পারব কি না, আমি জানি না। তবে এতটুকু প্রতিশ্রুতি দিতে পারি, (ফিরে আসতে) যতটুকু চেষ্টা করা দরকার আমরা তার সবটুকু করব।’

জার্মান কোচের পরের কথাটা লিভারপুলের জন্য হুংকার বলে মনে হতে পারে, ‘আমাদের মাঠে আমাদের সমর্থক থাকুক বা না থাকুক, রিয়াল মাদ্রিদের জন্য (দ্বিতীয় লেগে) ম্যাচটা খুব কঠিন হবে।’

লিভারপুলের উত্থানের চেয়ে পতন বেশি দেখা এই মৌসুমে এত দিন ভাবা হচ্ছিল, চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতাই হয়তো লিভারপুলের আগামী মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলার একমাত্র পথ। গত মৌসুমে ইংলিশ লিগ জেতা লিভারপুল যে এই মুহূর্তে ৩০ ম্যাচে ৪৯ পয়েন্ট নিয়ে আছে পয়েন্ট তালিকার সাত নম্বরে। সেরা চারে থেকে আগামী মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগে জায়গা করে নেওয়ার লড়াইয়ে সামনে কঠিন পরীক্ষা।

চারে থাকা ওয়েস্ট হামের পয়েন্ট ৩০ ম্যাচে ৫২, সমান ম্যাচে পাঁচে থাকা চেলসির পয়েন্ট ৫১, ছয়ে থাকা টটেনহামের ৪৯। আটে থাকা এভারটন ২৯ ম্যাচে ৪৭ পয়েন্ট নিয়ে লিভারপুলের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

লিগের সেরা চারে থাকার জটিলতার কারণে চ্যাম্পিয়নস লিগে শিরোপা জেতাটাই লিভারপুলের জন্য একমাত্র পথ বলে ভাবা হচ্ছিল।

কিন্তু এখন রিয়ালের কাছে এভাবে হারার পর লিভারপুল কি পথ বদলাবে? চ্যাম্পিয়নস লিগের চেয়ে এখন লিগের বাকি ৮ ম্যাচে বেশি মনোযোগ দেবে?

ক্লপ তা মানেন না, ‘আমরা এভাবে একটা টুর্নামেন্টের চেয়ে আরেকটা টুর্নামেন্টকে বেশি গুরুত্ব দিতে পারি না। সবকিছুর জন্যই ঝাঁপাব আমরা। এমন নয় যে এই একটা ম্যাচের পর আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম আমাদের এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগে আর কোনো সুযোগ নেই।’

বাস্তবতা ক্লপ মেনে নিচ্ছেন এভাবে, ‘রিয়াল মাদ্রিদের জন্য (কালকের প্রথম লেগের) ফলটা খুব ভালো ছিল, এখানে আমাদের কোনো সুবিধা নেই। তবে পরের (বুধবারের) ম্যাচের আগপর্যন্ত প্রতিটি দিন, প্রতিটি মিনিট পর্যন্ত এই ৩-১ রিয়ালের জন্য এখন যতটুকু ভালো, তার চেয়ে বেশি ভালো হয়ে যাবে না কিংবা লিভারপুলের জন্য এখন যতটা খারাপ, তার চেয়ে বেশি খারাপ হয়ে যাবে না। কারণ, এখানে যেকোনো কিছু হওয়ারই সম্ভাবনা আছে।’

২০১৯ সালে বার্সাকে অ্যানফিল্ডে চূড়ান্ত হতাশা উপহার দিয়েছিল লিভারপুল।
ছবি: সংগৃহীত

সম্ভাবনার নিক্তিতে বার্সেলোনার মতো করে রিয়াল মাদ্রিদকেও লিভারপুলের দুঃস্বপ্ন উপহার দেওয়ার জোর কতটুকু? সে তো বুধবারই জানা যাবে। ক্লপও আশা ছাড়েন না। তবে বার্সেলোনার বিপক্ষে সেবারের প্রথম লেগে ৩-০ গোলে হারের ম্যাচে লিভারপুলের পারফরম্যান্স আর কাল রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে ৩-১ গোলের হারে লিভারপুলের পারফরম্যান্সের তুলনা টেনে করণীয়ও ঠিক করে রেখেছেন লিভারপুল কোচ।

‘আমাদের আরও ভালো ফুটবল খেলতে হবে। আজ (গতকাল) রাতে যেভাবে খেলেছি এভাবে খেলতে পারি না। উদাহরণ হিসেবে বলি বার্সেলোনার বিপক্ষে হারের (প্রথম লেগে ৩-০) সেই ম্যাচেও আমরা দারুণ খেলেছিলাম। সে তুলনায় এবার বিশাল পার্থক্য আছে। আমরা (রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে পারফরম্যান্সের চেয়ে) আরও অনেক ভালো খেলার যোগ্যতা রাখি, আজকের (কালকের) চেয়ে প্রতিপক্ষের জন্য ম্যাচটাকে আরও অনেক বেশি অস্বস্তিকর বানিয়ে রাখার ক্ষমতাও আছে। আগামী সপ্তাহে সেটাই নিশ্চিত করতে হবে আমাদের’ - বলেছেন ক্লপ।