মেসিদের হারাতে কী করতে হবে সুয়ারেজদের

লিওনেল মেসি ও লুইস সুয়ারেজ—যখন বার্সেলোনায় ছিলেন দুজন।এএফপি ফাইল ছবি

সেই ৩৭ বছর আগে ১৯৮৩-৮৪ মৌসুমে লা লিগা দেখেছিল এমন লড়াই। সাধারণত দুই বাঘের লড়াই বলে পরিচিত এই লিগে (গত এক দশকে যা মোটামুটি তিন বাঘের লড়াইয়ে রূপ নিয়েছে) কোনো মৌসুমের শেষ পর্যায়ে এসে চারটা দল শিরোপার জন্য লড়াই করছে, এমনটা ৩৭ বছর ধরে দেখা যায়নি। চেনা তিন কুশীলব বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদ, আতলেতিকোর সঙ্গে সেভিয়া এবার সে স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে। কাকতালীয়ভাবে এই চার দলই একে অন্যের সঙ্গে লড়বে এই সপ্তাহে। আজ বার্সেলোনা খেলবে আতলেতিকোর বিপক্ষে, কাল রিয়াল সেভিয়ার বিপক্ষে।

নিজেদের মাঠ ক্যাম্প ন্যুতে লিওনেল মেসিরা স্বাগত জানাবেন দিয়েগো সিমিওনের আতলেতিকোকে। লুইস সুয়ারেজ ফিরবেন তাঁর আগের ঘরে। দুজনেরই প্রমাণ করার আছে অনেক কিছু। আতলেতিকোর কোচ হওয়ার পর বার্সার মাঠে গিয়ে একটা ম্যাচও জিততে পারেননি সিমিওনে। পাঁচ ম্যাচে হেরেছেন, বাকি তিনটায় ড্র। যদিও ওই তিন ড্রয়ের একটিই সাত বছর আগে লিগে বার্সা-রিয়ালের দ্বৈত শাসনব্যবস্থার ইতি টেনেছিল। কিন্তু তাতে কী? নব্বই মিনিটের লড়াইয়ে সিমিওনের হাতে এখনো ক্যাম্প ন্যু দুর্গের পতন ঘটেনি। সব মিলিয়ে লিগে আতলেতিকোর বিপক্ষে নিজেদের মাঠে সেই ২০০৬ সাল থেকে অপরাজিত বার্সা।

ম্যাচটা যে জিতবে, সেই শিরোপা জয়ের পথে বেশ এগিয়ে যাবে। আর হার মানে শিরোপার লড়াই থেকে মোটামুটি ছিটকে যাওয়া। পয়েন্ট তালিকার তৃতীয় স্থানে আছে বার্সা, হারলে তাদের ক্ষতিটাই বেশি হবে, শীর্ষে থাকা আতলেতিকোর চেয়ে পিছিয়ে যাবে পাঁচ পয়েন্টে। তিন ম্যাচে সে ব্যবধান কমানো আক্ষরিক অর্থেই অসম্ভব হয়ে পড়বে।

আজ ডাগআউটে থাকবেন না কোমান।
ছবি: রয়টার্স

জেতার জন্য বার্সা যা করতে চাইবে

সাম্প্রতিককালে ৩-৫-২ ছকে দলকে খেলিয়ে ভালো সাফল্য পেয়েছেন কোমান। কিন্তু বড় ম্যাচগুলোতে এই ফরমেশন থেকে বারবার সরে এসেছেন কোমান এবং ম্যাচের ফল তাঁর বিপক্ষে গেছে। বার্সেলোনাভিত্তিক স্প্যানিশ পত্রিকা স্পোর্ত বলছে, ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছেন কোমান, এই ম্যাচে ৩-৫-২ ফরমেশন নামানো হবে। লিগে শেষ ২৪ ম্যাচের ১৯টাতেই জেতা কোমানের মনে হয়তো একটা আক্ষেপ থেকেই যাবে, রোনালদোবিহীন জুভেন্টাসের বিপক্ষে এক ম্যাচ ছাড়া বড় কোনো দলের বিপক্ষে তাঁর অধীনে বার্সা দাপট দেখিয়ে জিততে পারেনি।

তিন সেন্টার ব্যাকের মধ্যে কোমান বাঁ পায়ের খেলোয়াড় একজনকে অবশ্যই রাখতে চান। যে কারণে ভুলের পর ভুল করা সত্ত্বেও সুযোগ পেয়ে যান ক্লেমঁ লংলে। এ ম্যাচেও তাঁকে নামানো হতে পারে এই কারণেই। ভ্যালেন্সিয়ার বিপক্ষে বিশ্রাম পাওয়া অস্কার মিঙ্গেসা এই ম্যাচে নামছেন মোটামুটি নিশ্চিত। ওদিকে রোনালদ আরাউহোর তারুণ্যের চেয়ে জেরার্ড পিকের অভিজ্ঞতাকেই হয়তো বেশি গুরুত্ব দেবেন কোমান।

দুই উইংব্যাক হিসেবে সের্হিনিও দেস্ত ও জর্দি আলবার জায়গা পাকা। মাঝমাঠেও নিয়মিত তিনজন—সের্হিও বুসকেতস, পেদ্রি ও ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ংকেই খেলাবেন কোমান। এর মধ্যে পেদ্রি ও ডি ইয়ংয়ের ভূমিকার ওপর ম্যাচের ফলাফল অনেকাংশে নির্ভর করবে। পেছনে বুসকেতসকে রেখে এই দুজনকে সামনে উঠে আতলেতিকোতে ক্রমাগত প্রেস করতে হবে। যাতে নিচ থেকে আতলেতিকোর ডিফেন্ডাররা খেলা গড়তে না পারেন। ঐতিহ্যগতভাবে বার্সেলোনা বল দখলে রেখে খেলতে চায়। বল দখলে রাখা সমস্যা না, কিন্তু এখন বল দখলে রাখার পাশাপাশি প্রেসিংটাও গুরুত্বপূর্ণ, যে কাজটা করার জন্য বার্সেলোনা মাঝমাঠে ডি ইয়ং ও পেদ্রির ওপর নির্ভর করবে। সঙ্গে ওপরে গ্রিজমান তো আছেনই।

বার্সার মূল দুই গোল-ভরসা।
ছবি: রয়টার্স

আতলেতিকোর সাবেক এই তারকা আস্তে আস্তে নিজের দাম বোঝাচ্ছেন কোমানকে। দেম্বেলেকে বাদ দিয়ে মেসির আক্রমণসঙ্গী হিসেবে কোমান গ্রিজমানকে এখন নিয়মিতই খেলাচ্ছেন। মেসি এখনো দলের মূল গোলদাতা, তবে গ্রিজমানও প্রায় সময়ই গুরুত্বপূর্ণ গোল করে দলকে বাঁচিয়ে দিচ্ছেন। এই ম্যাচেও মেসি-গ্রিজমানের রসায়নের পাশাপাশি গ্রিজমানের ‘প্রেসিং’ চাইবে বার্সা। সঙ্গে এটাও চাইবে, যেহেতু দলে কোনো প্রথাগত স্ট্রাইকার নেই, গ্রিজমান যেন ডিবক্স ফাঁকা রেখে বেশি নিচে নেমে না চলে আসেন। সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আতলেতিকোর কৌশল বদলালেও, একটা জিনিস এখনো অপরিবর্তিত, সেটা হলো রক্ষণকাজে তাঁদের মনোযোগ।

আতলেতিকোর অটুট রক্ষণ ভাঙতে তাই বার্সার স্ট্রাইকার-মিডফিল্ডারদের প্রেস করার বিকল্প নেই।

দলের সবচেয়ে বড় অস্ত্র যথারীতি মৌসুমে এই পর্যন্ত ২৮ গোল করা মেসি। আজকের প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ক্যারিয়ারে ৪২ ম্যাচ খেলে ৩২ গোল করেছেন, তালিকাটা যেন আরও লম্বা হয়, সেটাই প্রার্থনা থাকবে বার্সাভক্তদের।

সম্ভাব্য একাদশ (৩-৫-২) : টের স্টেগেন ; মিঙ্গেসা, পিকে, লংলে ; দেস্ত, দি ইয়ং, বুসকেতস, পেদ্রি, আলবা ; মেসি, গ্রিজমান

সুয়ারেজের অনেক কিছু প্রমাণের ম্যাচ এটি।
ছবি: রয়টার্স

জেতার জন্য আতলেতিকো যা করতে চাইবে

গত এক-দেড় বছরে অন্যান্য ক্লাবের মতো আতলেতিকোর ছকেও বেশ পরিবর্তন এসেছে। আগে যে কোচ ৪-৪-২ ছকের বাইরে বেরোতে চাইতেন না, সে কোচই এখন মাঝেমধ্যে দলকে ৩-৫-২ ছকে খেলান। বাঁ পায়ের সেন্টার ব্যাক মারিও হার্মোসোকে তিনজনের মধ্যে সবার বাঁয়ে রেখে হোসে হিমিনেজ আর স্তেফান সাভিচকে নিয়ে গড়ে উঠবে হয়তো আতলেতিকোর রক্ষণভাগ। পেছনে যথারীতি ইয়ান ওবলাক।

এবার আতলেতিকোর হয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় সুয়ারেজ, ওবলাক কিংবা কোকে নন; মার্কোস ইয়োরেন্তে। রিয়াল মাদ্রিদ থেকে এই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারকে কিনে গত মৌসুমেই তাঁকে স্ট্রাইকার বানানোর কাজ শুরু করেছিলেন সিমিওনে। নিজের সাবেক শিষ্য, আতলেতিকোর সাবেক অধিনায়ক রাউল গার্সিয়ার মতো ইয়োরেন্তেকে গড়ে তোলার জন্য সিমিওনের যে চেষ্টা, সে চেষ্টাতেই এই মৌসুমে ১২ গোল আর ১০ গোলে সহায়তা হয়ে গেছে ইয়োরেন্তের। সুয়ারেজ না থাকলে প্রায় সময় স্ট্রাইকার হিসেবে খেলছেন, আর ওপরে স্ট্রাইকার থাকলে খেলছেন সহকারী স্ট্রাইকার হিসেবে।

ইয়োরেন্তের হুটহাট বক্সে ঢুকে পড়া, ফাঁকা জায়গা দেখলেই সেখানে ঢুকে গিয়ে আক্রমণ করা, ফুলব্যাকের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে প্রতিপক্ষের ওপর চাপ বাড়ানো—এসব কাজই বার্সেলোনার মাথায় চিন্তার ভাঁজ বাড়াবে।

আতলেতিকোর প্রধান অস্ত্র হয়ে উঠেছেন ইয়োরন্তে।
ছবি: রয়টার্স

আরেকজন খেলোয়াড়ের অবস্থান ম্যাচের ফলাফলে প্রভাব ফেলতে পারে, তিনি কোকে। ২৯ বছর বয়সী এই মিডফিল্ডার সাধারণত স্ট্রাইকারের পেছনে খেলতে পছন্দ করলেও এই মৌসুমের অনেক সময়ে তাঁকে পেছনেই খেলিয়েছেন সিমিওনে। কিন্তু ফরাসি মিডফিল্ডার জফ্রি কনদগবিয়ার ভালো ফর্ম সিমিওনেকে দ্বিতীয়বার ভাবাতে পারে। ফলে কনদগবিয়াকে পেছনে রেখে কোকে সামনে চলে আসতে পারেন।

জেতার জন্য আতলেতিকোর আরেকটা ধাঁধার সমাধান করতে হবে, সেটা হলো সুয়ারেজের আদর্শ স্ট্রাইকসঙ্গী খুঁজে বের করা। যে ভূমিকায় ইয়োরেন্তে, জোয়াও ফেলিক্স, আনহেল কোরেয়া—প্রত্যেকেই খেলতে পারেন। মৌসুমে ১৯ গোল করা সুয়ারেজ এই ম্যাচে অবশ্যই চাইবেন আরও কয়েকটা গোল করতে, আর সে কাজে পাশে একজন কার্যকরী সঙ্গী অবশ্যই দরকার হবে তাঁর। ফেলিক্স ও লেমারের হালকা চোট–সমস্যার কারণে হয়তো কোরেয়া কিংবা ইয়োরেন্তেকেই সেই ভূমিকা পালন করতে হবে। বেশ খেটে খেলতে পছন্দ করেন কোরেয়া, তাই এই আর্জেন্টাইন উইঙ্গারের প্রতি সিমিওনের আলাদা একটা দরদ কাজ করে।

সম্ভাব্য একাদশ (৩-৪-৩): ওবলাক ; সাভিচ, হিমেনেজ, হার্মোসো ; ট্রিপিয়ের, ইয়োরেন্তে, কনদগবিয়া, কোকে, কারাসকো ; সুয়ারেজ, কোরেয়া