শেষ হওয়ার পথে আরেকটি বছর—২০২১। ক্রীড়াঙ্গনে কেমন গেল বিদায়ী বছরটা? পেছন ফিরে তাকালে উঠে আসে হাসি-কান্না, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কত উপাখ্যান! সেসব নিয়েই আজ শুরু ধারাবাহিক এই বর্ষপরিক্রমা। প্রথম পর্বে আন্তর্জাতিক ফুটবল।
হয়তো শুধু লিওনেল মেসি ছিলেন বলেই এত মাতামাতি! নাহলে নিজেদের মহাদেশের শিরোপা তো ইতালিও জিতেছে।
আর্জেন্টিনার মতো ২৮ বছরের না হোক, তবে একটা আন্তর্জাতিক শিরোপার জন্য অপেক্ষা তাদেরও তো কম ছিল না। ১৫ বছর আগে বিশ্বকাপ জেতা ইতালির গত কয়েক বছরে ধাক্কা খাওয়া আত্মগর্ব উদ্ধারে এমন কিছু দরকারও ছিল অনেক। ২০১৮ বিশ্বকাপে যে জায়গাই করে নিতে পারেনি আজ্জুরিরা! সেখান থেকে ফিরে এসে তাদের এবারের ইউরো জয় মুগ্ধতা ছড়িয়েছে ঠিকই। কিন্তু মেসির আর্জেন্টিনার কোপা আমেরিকা জয়ের মতো করে আলোচিত আর হতে পারল কই!
পার্থক্য? একজন মেসির থাকা না থাকা।
এভাবেই ভাবুন না, মেসি যদি আর্জেন্টাইন না হতেন, সে ক্ষেত্রেও আর্জেন্টিনার ২৮ বছরের শিরোপার আক্ষেপ ঘোচানো সাড়া ফেলত ঠিকই, কিন্তু কতটা? আর্জেন্টিনার ২৮ বছরের আক্ষেপের চেয়েও আকাশি-নীল জার্সিটাতে মেসির প্রথম শিরোপার অপেক্ষা ঘোচাই যে বেশি মন টেনেছে। তার ওপর আক্ষেপটা যেখানে ঘুচেছে, ব্রাজিলের ফুটবল-তীর্থ মারাকানায় নেইমারেরই ব্রাজিলকে ফাইনালে হারিয়ে!
বছরের শেষে এসে তাই পেছনে ফিরে ওই একটা দৃশ্যেই চোখ আটকে যায়। কোপা আমেরিকার ফাইনালের শেষে রেফারির বাঁশি বাজতেই সাইডলাইনের পাশে থাকা মেসির হাঁটু গেড়ে বসে মুখ ঢেকে কান্না, সতীর্থদের তাঁর দিকেই ছুটে আসা। আর্জেন্টিনার ২০২১ সালে আন্তর্জাতিক ফুটবলে এর চেয়ে বড় হাইলাইট আর কী হতে পারে!
লাইমলাইটে অবশ্য মেসি বছরজুড়েই ছিলেন। জুলাইয়ে আর্জেন্টিনাকে কোপা আমেরিকা জিতিয়ে আনন্দে কাঁদলেন, আগস্টে কাঁদলেন ঘর ছাড়তে হওয়ার বেদনায়। বার্সেলোনা তো তাঁর ‘ঘর’ই, তাঁর অস্তিত্বের অংশ। কিন্তু গত কয়েক বছরে মাঠের বাইরে কপর্দকহীন হয়ে পড়া বার্সাকে মাঠে বলতে গেলে একাই টেনে যাওয়া মেসিই হলেন বার্সার আর্থিক দুর্গতির বলি।
গত জানুয়ারিতেও লিগ শিরোপার আশা হারিয়ে ফেলা বার্সেলোনা নতুন বছরে মেসির চোখধাঁধানো ফুটবলেই অবিশ্বাস্যভাবে ফিরে আসে লিগের লড়াইয়ে। শেষ পর্যন্ত শিরোপা জেতা হয়নি, শেষ বেলায় পথ হারিয়ে তৃতীয়ই হয়েছে বার্সা। তবে কোপা দেল রে জিতিয়ে মেসি বার্সাকে অন্তত শিরোপাশূন্য থাকতে দেননি। কে জানত, সেটিই বার্সেলোনায় মেসির শেষ শিরোপা!
বেতনকাঠামো নিয়ে আর্থিক জটিলতায় মেসির চুক্তি নবায়ন করতে পারল না বার্সা, ভেজা চোখে তাঁকে বলতে হলো—বিদায়। ৩৪ বছর বয়সে এসে ক্যারিয়ারে প্রথমবার ক্লাব বদলে আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড গেলেন বন্ধু নেইমারেরই ক্লাব পিএসজিতে। এত দিনের ‘ঘর’ রিয়াল মাদ্রিদ ছেড়ে পিএসজিতে গেছেন সের্হিও রামোসও।
মেসি-রামোস ঘর ছেড়ে প্যারিসে মন বাঁধার চেষ্টায় এখনো সাফল্যের খোঁজে ব্যস্ত, আরেকজনের হয়েছে ঘরে ফেরা। মেসির নাম নিতে হলে যাঁর নাম অবধারিতভাবে আসবেই—ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো! আগস্টে ক্লাব বদলেছেন তিনিও।
মেসির বার্সার মতো অত জটিল পরিস্থিতিতে না পড়লেও রোনালদোর জুভেন্টাসের কাছেও ৩৬ বছর বয়সী পর্তুগিজ ফরোয়ার্ড হয়ে গিয়েছিলেন ‘শ্বেত হস্তী’। ফল? রোনালদোরও ক্লাববদল।
মেসির জন্য ক্লাব বদলানোর অভিজ্ঞতা নতুন হলেও রোনালদোর জন্য তো সেটা নয়। ক্লাবের বদলটা রোনালদোর জন্য আশীর্বাদ হয়েও এল। মেসি যেখানে ঘর ছেড়েছেন, রোনালদো ফিরেছেন ঘরে, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে!
বদলে যাওয়া ঠিকানায় কেমন কাটছে দুজনের, সে নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। রোনালদো ইউনাইটেডে গোল ফিরিয়েছেন, কিন্তু গোলমাল বাধে দলের খেলায় তাঁর অবদান নিয়ে প্রশ্নে।
মেসিও কি সুখে আছেন? নতুন ক্লাবে যে এখনো মানিয়ে নিতে পারেননি, এখনো মেসি-ঝলক সেভাবে দেখানো হয়নি। আর্জেন্টিনা অধিনায়কের ফুটবলেও লেগেছে বয়স আর বদলের ধাক্কা। যে কারণে মেসির এবারের ব্যালন ডি’অর জয়ও অনেকের কাছেই ধাক্কা হয়ে এসেছে।
বায়ার্ন মিউনিখের জার্সিতে বছরজুড়ে গোলের বান ছুটিয়ে চলা রবার্ট লেভানডফস্কিকে হারিয়ে ব্যালন ডি’অরের মঞ্চে যখন সপ্তমবার সোনার বলটাই উঠল মেসির হাতে, পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তির ঝড়ও উঠেছে। তবে মেসির তাতে কী যায়–আসে! সবচেয়ে বেশি ব্যালন ডি’অর জয়ের রেকর্ড তো দুই বছর আগেই গড়া হয়ে গেছে, এবার হলো তাঁর সপ্তম স্বর্গে চড়া।
কষ্ট বাড়িয়ে দেওয়া বুকে ব্যথা
কত স্বপ্ন নিয়ে বার্সেলোনায় গিয়েছিলেন, কিন্তু সের্হিও আগুয়েরোকে ফুটবল থেকেই বিদায় নিতে হলো কী অসহায়ভাবে! অক্টোবরে আলাভেসের বিপক্ষে ম্যাচে বুকে ব্যথা নিয়ে মাঠ ছাড়লেন, এরপরই পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ধরা পড়ে, আগুয়েরোর হৃৎস্পন্দন অনিয়মিত। শঙ্কা সত্যি করে কদিন আগে ৩৩ বছর বয়সেই ফুটবলকে বিদায় বলে দেন আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার।
আগুয়েরোর বুকে ব্যথায় মাঠ ছাড়ার দিনে ফুটবলপ্রেমীদের মনে মেঘ ডেকেছিল জুনের ঘটনাটাও। ইউরোর দ্বিতীয় দিনে ফিনল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে যেদিন মাঠে হঠাৎ লুটিয়ে পড়েন ডেনমার্কের ক্রিস্টিয়ান এরিকসেন। হার্ট অ্যাটাকই হয়েছিল তাঁর, মাঠে দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসা না পেলে হয়তো সেদিন আর চোখ মেলাই হতো না এরিকসেনের।
মাঠেই প্রায় ১৫ মিনিট যমে-চিকিৎসকে লড়াইয়ে জিতে ফেরেন এরিকসেন। এখনো অবশ্য মাঠে ফেরা হয়নি তাঁর, তবে ফেরার লক্ষ্যে প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে।