মেসির চুক্তি নবায়নে ১৮০ ডিগ্রি বদল: যত প্রশ্ন ও উত্তর

বার্সেলোনা ছাড়ছেন লিওনেল মেসিছবি: এএফপি

মাত্র ৯৯ শব্দ! এতে কাটা পড়ল ২১ বছরের সম্পর্ক। ৮১০ পেশাদার ম্যাচ, ৬৮৩ গোল, ১০টি লা লিগা ট্রফি, ৭টি কোপা দেল রে, ৪টি চ্যাম্পিয়নস লিগ ও ৩টি ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ—বার্সায় লিওনেল মেসির নামের পাশে এ সংখ্যাগুলো আর বাড়বে না।

কাল এক বিবৃতিতে বার্সেলোনা জানিয়ে দেয়, ক্যাম্প ন্যু-তে আর থাকছেন না মেসি।এক ক্লাবে মেসির চেয়ে ভালো ক্যারিয়ার তর্কযোগ্যভাবে আর নেই। গত বছর ২৫ আগস্ট বুরোফ্যাক্স করে তিনি ক্লাব ছাড়ার ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন।

পরে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরেও আসেন। এ বছরের জুনে তাঁর সঙ্গে বার্সার চুক্তির মেয়াদ ফুরায়।

তবে এরপর থেকে মেসির সঙ্গে চুক্তি নবায়ন নিয়ে বরাবরই আশার কথা জানিয়েছে বার্সা। বেতন প্রায় ৫০ শতাংশ কমিয়ে পাঁচ বছরের চুক্তিতে নাকি সম্মতও হয়েছিল দুই পক্ষ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বন্ধন ছিন্ন হলো। কীভাবে এবং সামনে কী হতে পারে, তা জানিয়েছে ইএসপিএন—

প্রশ্ন: কিছুদিন আগে সংবাদমাধ্যম জানিয়েছিল, নতুন চুক্তিতে সম্মত হয়েছেন মেসি ও বার্সা। কাল সেই চুক্তির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হওয়ার কথা ছিল। এ কারণে দিনটিকে স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম ‘মেসি ডে’ হিসেবে ঘোষণাও করে। কী ঘটল?

মেসির বার্সা ছাড়ার খবর নিশ্চিত করেছেন ক্লাব সভাপতি লাপোর্তা
ছবি: এএফপি

উত্তর: বার্সেলোনার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, খেলোয়াড় নিবন্ধন নিয়ে স্প্যানিশ লিগের নিয়মের কারণে চুক্তিটা নিবন্ধিত করতে পারেনি বার্সা। ক্লাবের সঙ্গে পাঁচ বছরের চুক্তিতে সম্মত হয়েছিলেন মেসি। বার্সা খোলাসা করে কিছু বলেনি, তবে এ কথা বলা নিরাপদ, লা লিগার ‘বেতনকাঠামোয়’ ইঙ্গিত করছে তারা—এই নিয়মে ক্লাবের আয় ও ব্যয়ের সঙ্গে ভারসাম্য রেখে খেলোয়াড়দের বেতনে সীমারেখা টানা হয়েছে। এদিকে বার্সার আর্থিক অবস্থাও খুব সঙিন। বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ। এর মধ্যে প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ডলার সংক্ষিপ্ত মেয়াদের ঋণ। এ কারণে মেসির নতুন চুক্তিতে সবুজসংকেত দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ তাঁকে ক্লাব ছাড়তে হবে।

প্রশ্ন: কিন্তু এটা ঘটল কীভাবে? বেতন কাঠামোর সীমারেখা তো বার্সা জানত...?

উত্তর: রহস্যটা এখানেই। বার্সা এবার ৯.৬ মিলিয়ন ইউরো খরচ করে এমারসনকে কিনেছে রিয়াল বেতিস থেকে। এ ছাড়া মেম্ফিস ডিপাই, এরিক গার্সিয়া ও সের্হিও আগুয়েরোকে কিনেছে ফ্রিতে। প্রশ্ন হলো, মেসির সঙ্গে চুক্তি নবায়নই তো বার্সার অগ্রাধিকার? সেটাই যদি হবে, তাহলে নতুন করে প্রায় ৫০ মিলিয়ন পারিশ্রমিক, এমারসনকে কেনার ফি এবং আরও কিছু খেলোয়াড় কেনার বোঝা কেন নিতে গেল বার্সা? এসব কারণে লা লিগার বেঁধে দেওয়া বেতনকাঠামোতে নিয়মের ভেতরে থাকা যাবে না, সেটা তো বার্সা বুঝতে পেরেছিল! এ কারণে অনেকের সন্দেহ, মূল ঘটনা এটাই নয়। এর ভেতরে হয়তো অন্য কিছু আছে।

বার্সার জার্সিতে আর দেখা যাবে না মেসিকে
ছবি: এএফপি

প্রশ্ন: অন্য কিছু আছে...?

উত্তর: কিছু প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, মেসির সঙ্গে চুক্তির একেবারে শেষ মুহূর্তে ধাক্কাটা লেগেছে। এই চুক্তিতে কত কমিশন (এজেন্ট কমিশন পেয়ে থাকেন) দেওয়া হবে এবং দলবদলের বাজারে বার্সার কিছু কর্মকাণ্ডেও তিনি খুশি হতে পারেননি। এদিকে বার্সাও মেসিকে দোষারোপ করতে পারছে না, তাই দোষটা চাপাচ্ছে লা লিগার কাঁধে। এর মধ্যে কিছু সত্যতাও থাকতে পারে। কিন্তু গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হতে পারে এটা, লা লিগার সঙ্গে বার্সার অমসৃণ সম্পর্ক। বার্সা সভাপতি হোয়ান লাপোর্তা ও লা লিগা সভাপতি হাভিয়ের তেবাস হয়তো শক্তির লড়াইয়ে নেমেছেন, কে জানে!

প্রশ্ন: শক্তির লড়াই?

উত্তর: এক শব্দে—নিয়ন্ত্রণ। রিয়াল মাদ্রিদ, জুভেন্টাসের সঙ্গে বার্সাও ইউরোপিয়ান সুপার লিগের ভাবনা থেকে সরে আসেনি। বিষয়টি তারা আদালতেও তুলেছে। তেবাস সুপার লিগের বিরুদ্ধে। কারণ, এতে লা লিগায় প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভারসাম্য নষ্ট হবে বলে মনে করেন তিনি। এদিকে সিভিসি ফার্ম নামের এক প্রাইভেট ইকুয়িটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিও করেছেন তেবাস। এখান থেকে ৩.২ বিলিয়ন ডলার পাবে লা লিগা। রিয়াল ও বার্সা এই সিভিসি চুক্তির বিরুদ্ধে।

প্রশ্ন: রিয়াল-বার্সা কেন চুক্তিটির বিরুদ্ধে? তারা কি টাকার ভাগ চায় না?

উত্তর: তারা অবশ্যই চায়। কিন্তু দুটি ক্লাবের পক্ষ থেকে এ কথাও বলা হয়েছে, চুক্তিটি তাদের অগোচরে করা হয়েছে। এতে ক্লাবের ভবিষ্যৎ গিয়ে পড়বে ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারীদের হাতে। এ ছাড়া লা লিগা ও সিভিসি তহবিল কীভাবে পুনর্বণ্টন করবে, সেটি নিয়েও তারা খুশি নয়। লা লিগার ক্লাবগুলোর তরফ থেকে এখন এই চুক্তি অনুমোদন পাওয়ার অপেক্ষায়। রিয়াল ও বার্সা স্বাভাবিকভাবেই এই চুক্তি নিয়ে ‘না’ বলবে।

মেসিকে বার্সার হয়ে শিরোপা হাতে এভাবে আর দেখা যাবে না
ছবি: এএফপি

প্রশ্ন: মেসির চুক্তির সঙ্গে এর সম্পর্ক?

উত্তর: খুব সহজ। লা লিগাকে পণ্য ধরলে মেসিকে ছাড়া লিগ আবেদন হারাবে, দাম কমবে। তাঁর চলে যাওয়া, এমনকি চলে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হলেও তেবাস এবং তাঁর পরিকল্পনার বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হতে পারে। লা লিগার রাজস্বের অনেক বড় অংশের জোগান দিয়ে থাকে রিয়াল ও বার্সা। অন্যান্য ক্লাব ভাগ হিসেবে এর মোটা অংশ পেয়ে থাকে। মেসির চলে যাওয়া মানে শুধু বার্সার ক্ষতি নয়, লা লিগারও ক্ষতি। সেটি শুধু তাঁর ইমেজ ঘিরে নয়, বাণিজ্যিক দিক থেকেও লোকসান হবে লা লিগার। এটি বেশ কিছু তত্ত্ব কিংবা ধারণার একটি। তৃতীয় আরেকটি ধারণাও আছে...।

প্রশ্ন: তৃতীয়টি কী?

উত্তর: বিশ্বাস করা কঠিন। মাসের পর মাস ধরে মেসি এবং তাঁর পরিবারের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে কথা বলেছে বার্সা। কিন্তু চুক্তিতে আর্থিক হিসাব ঠিক রাখতে পারেনি ক্লাবটি। একদম শেষ মুহূর্তে এসে তারা বুঝতে পেরেছে, মেসিকে ধরে রাখা অসম্ভব। যে পাঁচ বছরের চুক্তির কথা বলা হচ্ছে, সেখানে লা লিগার বেতনকাঠামো নীতির মধ্যে সাবধানে থাকতে হচ্ছে। আর দলবদলের বাজার তো সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চালু আছে। মেসিকে ধরে রাখতে বার্সা অন্য কিছু খেলোয়াড়কে বেচে দিতে পারে। যদিও সে জন্য যেসব খেলোয়াড়কে বেচতে হবে, তাদের বেতন দেওয়ার সামর্থ্য কয়টি ক্লাবের আছে, তা প্রশ্ন থাকেই। কিন্তু মেসি যদি বার্সায় সত্যিই থাকতে চান—যেটা দাবি করে এসেছে বার্সা, তাহলে বেতন কমাতে পারেন কিংবা চুক্তির প্যাকেজে আরও বোনাস যোগ করতে পারেন...।

বার্সেলোনায় আরও পাঁচ বছরের জন্য অনেকেই দেখেছেন মেসিকে
ছবি: এএফপি

প্রশ্ন: এত কৌশলের কারণ?
উত্তর: তেবাসের ভিত নড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা। সেটি সিভিসি চুক্তি কিংবা সুপার লিগ নিয়েও হতে পারে কিংবা বেতনকাঠামো নীতিতে সামান্য পরিবর্তন আনা, যা করলে মেসিকে বার্সা ধরে রাখতে পারবে। মেসিকে বার্সা যেভাবে ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে, সেটি দেখে মনে হচ্ছে লড়াই ছাড়াই তাদের সেরা খেলোয়াড়টিকে ছেড়ে দিচ্ছে ক্লাবটি। মেসি ও বার্সার পক্ষ থেকে তা হওয়ার কথা নয়।

প্রশ্ন: ধরা যাক, সব সম্ভাবনাই ভুল। সত্যিই মেসির সঙ্গে বার্সার সম্পর্কচ্ছেদ হচ্ছে। তাহলে তিনি কোথায় যেতে পারেন?

উত্তর: পিএসজি, ম্যানচেস্টার সিটি, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের নামই আগে আসে কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের মেজর সকার লিগও হতে পারে। বাস্তবতা হলো, মেসি গত ১ জুলাই ফ্রি এজেন্ট হয়েছেন, আইনগত দিক থেকে তিনি ফ্রি এজেন্ট হয়েছেন ১ জানুয়ারি। যেকোনো ক্লাবের সঙ্গেই তিনি প্রাকচুক্তি সেরে ফেলতে পারেন। এক বছর আগে মেসিকে কিনতে আগ্রহ দেখিয়েছে ম্যানচেস্টার সিটি, যখন বুরোফ্যাক্সে ক্লাব ছাড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন আর্জেন্টাইন। এত দিন সিটি ছাড়াও বাকি ক্লাবগুলো চুপ ছিল।

কারণ, সবাই মনে করেছে, মেসি বার্সাতেই থাকছেন। এর মধ্যে মেসির প্রতি আগ্রহ দেখানো ক্লাবগুলো ছুটছে অন্য খেলোয়াড়দের পেছনে। হ্যারি কেইনকে কেনার চেষ্টা করছে সিটি। কিলিয়ান এমবাপ্পেকে ধরে রাখার চেষ্টা করছে পিএসজি। এ ছাড়া বেশ বড় অঙ্কের বেতনে ভাইনালডম, দোন্নারুম্মা ও সের্হিও রামোসকেও দলে ভিড়িয়েছে ফরাসি ক্লাবটি। মেসিকে এর মধ্যে নিয়ে আসা হবে অলৌকিক বিষয়। আগামী পাঁচ বছরের জন্য হুট করেই অর্ধবিলিয়ন ডলারের পরিকল্পনায় নামা চাট্টিখানি কথা নয়!