মেসির সঙ্গী, আর্জেন্টিনার ভবিষ্যৎ যে কারণে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিতে চেয়েছিলেন

আর্জেন্টিনা দলে মেসি, দি মারিয়া, মাচেরানোদের সঙ্গী মাম্মানাছবি: মাম্মানার ইনস্টাগ্রাম

পেশাদার ক্যারিয়ারের বয়স মাত্র সাত বছর, কিন্তু এই ছোট্ট ক্যারিয়ারেই তাঁকে অনেক পথ ঘুরতে হয়েছে। আর্জেন্টাইন ক্লাব রিভারপ্লেটে শুরু, আলো ছড়ানোও। আর্জেন্টিনার আগামী দিনের সেন্টারব্যাক হবেন বলে ভাবা হচ্ছিল, রিভারপ্লেটে দুই মৌসুম শেষে গেলেন ফ্রান্সের লিওঁতে। আর্জেন্টিনার জার্সিতেও সে সময় ডাক পেয়ে যান। কিন্তু এরপর আর সেভাবে আলো ছড়ানো হয়নি। এমানুয়েল মাম্মানা নামটাও আর আর্জেন্টিনা সমর্থকদের মনে দাগ কাটার সুযোগ পায়নি।  

অনেক দিন পর আবার সংবাদের শিরোনামে মাম্মানা, তবে সেটি করুণ এক বর্ণনায়। ২৫ বছর বয়সী আর্জেন্টাইন ডিফেন্ডারের ক্যারিয়ার তো চোটের কারণে আগেই পথ হারিয়েছে, তাঁর জীবনই গতি হারিয়েছে ব্যক্তিগত শোকে। এমনই যে আত্মহত্যাই করতে বসেছিলেন মাম্মানা!

কেন চলতি ট্রেনের সামনে পড়তে চেয়েছিলেন, কীভাবে অন্য এক ব্যক্তি তাঁকে বাঁচিয়েছেন, সেসব ঘটনা নিজেই আর্জেন্টাইন রেডিও ‘রাদিও দে লা রেদ’-এ বলেছেন মাম্মানা।

আর্জেন্টিনার ভক্তদের কাছে তাঁর নামটি একেবারে অপরিচিত মনে না-ও হতে পারে। ২০১৪ সালে রিভারপ্লেটের জার্সিতে তাঁর অভিষেক, কিন্তু তার আগে বয়সভিত্তিক ফুটবলে আলো ছড়ানোয় বিশ্বকাপের আগে স্লোভেনিয়ার বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচেই আকাশি-সাদা জার্সিতে অভিষেক হয়ে যায় মাম্মানার।

মেসির সঙ্গে মাম্মানা
ছবি: মাম্মানার ইনস্টাগ্রাম

ব্রাজিল বিশ্বকাপে তাঁর যাওয়ার সম্ভাবনা কমই ছিল, তবে সে সময়ের আর্জেন্টিনা কোচ আলেহান্দ্রো সাবেয়ার তাঁর খেলা পছন্দ হয়েছিল। রক্ষণে ভালো মাম্মানা যে বল পায়েও স্বচ্ছন্দ। ‘ভবিষ্যতের জন্য ওর দিকে চোখ রাখতেই হবে’—স্লোভেনিয়ার বিপক্ষে ৭৬ মিনিটে মাঠে নামা মাম্মানাকে নিয়ে সেদিন বলেছিলেন সাবেয়া। আর্জেন্টিনার কিংবদন্তি ডিফেন্ডার রবার্তো আয়ালাকে টেনে এনে সে সময় স্প্যানিশ দৈনিক মার্কা শিরোনামে লিখেছিল, ‘এমানুয়েল মাম্মানা, ভবিষ্যৎ আয়ালা!’

এরপর রিভারপ্লেটে দুই বছর শেষে লিওঁতে আলো ছড়ানো। চেলসি, টটেনহাম, আর্সেনাল, ইন্টার মিলান, এসি মিলান, ফিওরেন্তিনা, আতলেতিকো মাদ্রিদসহ ইংল্যান্ড, ইতালি ও স্পেনের বেশ কয়েকটি ক্লাবের আগ্রহ জাগে তাঁকে ঘিরে। কিন্তু লিওঁ থেকে ২০১৭ সালে মাম্মানা গেলেন দলবদলে বেশ ভালো কয়েকজন খেলোয়াড় কিনে নেওয়া রাশিয়ান ক্লাব জেনিত সেন্ট পিটার্সবার্গে। ২০১৮ বিশ্বকাপ রাশিয়ায়, জেনিতে আর্জেন্টিনার আরও দুয়েকজন খেলোয়াড় ছিলেন। সব মিলিয়ে তাই দলবদলটা মাম্মানার জন্য ভালো হবে বলেই ভাবা হচ্ছিল!

এর মধ্যে ২০১৭ সালে হোর্হে সাম্পাওলি দায়িত্ব নিয়েই ব্রাজিলের বিপক্ষে ম্যাচে ডাকেন মাম্মানাকে। আর্জেন্টিনার ১-০ গোলে জয়ের সে ম্যাচে মেসি-দি মারিয়াদের সঙ্গে খেলার সুযোগ মেলে মাম্মানার, নামেন বদলি হয়ে। সিঙ্গাপুরকে ৬-০ গোলে হারানোর পরের ম্যাচে শুরু থেকেই খেলেছেন। সাম্পাওলির রক্ষণরেখা ওপরে রেখে আক্রমণাত্মক ফুটবলের কৌশলে মাম্মানার মতো গতিশীল, বল পায়ে স্বচ্ছন্দ ডিফেন্ডারই ভালো যান বলে ধরে নেওয়া হচ্ছিল।

কিন্তু এরপর এসিএল (অ্যান্টেরিয়র ক্রুসিয়েট লিগামেন্ট) চোট তাঁর বড় প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। ২০১৮ সালের মার্চে একবার, ২০১৯-এর অক্টোবরে আবার। ডেভিড বেকহামকে ভুগিয়ে বিখ্যাত হয়ে যাওয়া এই চোটে পরপর দুই বছরেই পড়লেন, তাতে দুই দফায় ১৫ মাস ছিলেন মাঠের বাইরে। মাঝে রাশিয়ায় হয়ে যাওয়া ২০১৮ বিশ্বকাপেও তাই আর খেলা হলো না মাম্মানার।

এ তো গেল শারীরিক ধাক্কা, মানসিকভাবে এর চেয়ে বড় একটা ধাক্কা এর অনেক আগেই পেয়েছেন মাম্মানা। তাঁর মা আগেই অন্যলোকে পাড়ি জমান, ২০১৭ সালে জেনিতে যাওয়ার আগে বাবাকেও হারান মাম্নানা। সে ধাক্কা আর সইতে পারছিলেন না আর্জেন্টাইন ডিফেন্ডার। এতটাই যে আত্মহত্যার কথাই ভেবেছিলেন তিনি!

‘যাঁরা মা-বাবা হারিয়েছেন, শুধু তাঁরাই জানেন এটা কতটা কষ্টের। অনেকবারই আত্মহত্যার কথা মাথায় এসেছে। পাগলাটে কিছু একটা করে ফেলার কথা মনে আসত সব সময়’—আর্জেন্টাইন রেডিও ‘দে লা রেদ’-এ কষ্টটা ভাগাভাগি করে নিয়েছেন মাম্মানা। ভাবনাটা বাস্তবেও রূপ পেয়েই যাচ্ছিল প্রায়! কিন্তু হয়নি এক অচেনা পথিক ‘দেবদূত’ হয়ে আসায়।

মাম্মানা খুলে বলেছেন সে ঘটনা, ‘একদিন অনুশীলনে যাচ্ছিলাম। (বাবার মৃত্যুর) দুই মাস পার হয়ে যাওয়ার পরও আমি কিছু ভাবতে পারছিলাম না। কিছু ভালো লাগত না। একা একাই ট্রেনে চড়ার উদ্দেশে পথ ধরলাম। দেখলাম ট্রেন আসছে। জীবনে আর কিছু ভালো লাগছিল না বলেই হয়তো, আমি ট্রেনের দিকে ঝাঁপ দেওয়ার জন্য এগিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তখনই পেছন থেকে কেউ একজন আমার কলার ধরে টান দেন, আমাকে ধাক্কা দিয়ে দেয়ালের দিকে নিয়ে আসেন।’

এত দিন পর এসে পিছু ফিরে এখন অচেনা ওই ব্যক্তির কাছেই অনেক কৃতজ্ঞতা মাম্মানার, ‘ওই লোকটা আমাকে বাঁচিয়েছেন। আমি জানি না তিনি কে। তবে হৃদয়ের গভীর থেকে তাঁকে ধন্যবাদ জানাই।’ মৃত্যুর পথ থেকে ফিরে যে জীবনের স্বাদ আবার পেতে শুরু করেছেন আর্জেন্টাইন ডিফেন্ডার! এখন তাঁর উপলব্ধি, তাঁর মৃত্যু তাঁর মৃত মা-বাবাও মেনে নিতে পারতেন না, ‘আজ আমার একটা পরিবার আছে, সন্তান আছে। আমার মা-বাবাও চাইতেন না সেটা (আত্মহত্যা)।’

শারীরিক-মানসিক এত চাপের মধ্যে জেনিতে আর নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি মাম্মানা। দুই দফায় আরেক রাশিয়ান ক্লাব সোচিতে ধারে খেলেছেন। ইউরোপে পাঁচটি বছর কাটানোর পর এখন আবার পুরোনো ‘ঘর’ রিভার প্লেটেই ফিরছেন।

সব গুলিয়ে ফেললে যে আবার শূন্য থেকেই শুরু করতে হয়! ছোটবেলার চকের লেখা মুছে ফাঁকা স্লেটে নতুন করে লেখার মতো করে জীবনের নতুন গল্প লিখতে হয়।