মেসির সঙ্গী হওয়ার অধিকার হারিয়ে ফেলেছেন গ্রিজমান

মেসি ও গ্রিজমানকে একসঙ্গে বড় ম্যাচে নামাবেন না বার্সা কোচ?ছবি: রয়টার্স

এক পিএসজি ম্যাচই আবার আঁতোয়ান গ্রিজমানের ভাগ্য বদলে দিল বার্সেলোনায়?

এই মাসের মাঝামাঝিতে পিএসজির বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ ষোলোর প্রথম লেগে বার্সেলোনা নিজেদের মাঠে ৪-১ গোলে হেরেছে, বলতে গেলে চ্যাম্পিয়নস লিগে দলটার কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়ার আশা শেষই। সেই ম্যাচে খুব একটা ভালো খেলতে না পারার মূল্যই কি দিতে হচ্ছে গ্রিজমানকে? ফরাসি ফরোয়ার্ডকে যে এরপর থেকে খুব একটা খেলাচ্ছেন না বার্সেলোনার কোচ রোনাল্ড কোমান!

বার্সেলোনাভিত্তিক স্প্যানিশ দৈনিক স্পোর্ত জানাচ্ছে, বার্সার আক্রমণে লিওনেল মেসির সঙ্গী হওয়ার অধিকারই হারিয়ে ফেলেছেন গ্রিজমান। বিশেষ করে বড় দলের বিপক্ষে ম্যাচগুলোতে গ্রিজমানের বদলে আক্রমণে মেসির সঙ্গে শুধু দেম্বেলেকেই খেলানোর কথা কোমান ভাবছেন বলে জানাচ্ছে স্পোর্ত। গতকাল লিগে সেভিয়ার মাঠে ম্যাচে বার্সার ২-০ গোলের জয়ে মেসি-দেম্বেলেকেই আক্রমণে খেলিয়েছেন বার্সা কোচ, দুজনের গোলেই বার্সা ম্যাচটা জিতেছে।  

অথচ পিএসজির বিপক্ষে ওই ম্যাচের আগে ঠিক উল্টোটাই মনে হচ্ছিল। ২০১৯/২০ মৌসুমে ১২ কোটি ইউরোতে আতলেতিকো মাদ্রিদ থেকে বার্সেলোনায় আসার পর থেকে এ বছরের জানুয়ারির আগ পর্যন্ত কখনোই খুব ভালোভাবে দলে জায়গা করে নিতে পারেননি গ্রিজমান। টানা কয়েক ম্যাচে ছন্দে ছিলেন, এমনটাও গত জানুয়ারির আগে তেমন দেখা যায়নি। কিন্তু নতুন বছর আসতেই বার্সেলোনা খেলার ধাঁচ কিছুটা পাল্টেছে, গ্রিজমানও আলো ছড়িয়েছেন।

মেসি ও গ্রিজমান।
ছবি: রয়টার্স

কতটা? ফুটবলে সংখ্যা দিয়ে সবকিছু বিবেচনা করতে যাওয়া ভুল। শুধু গোল কিংবা অ্যাসিস্টের হিসাব দিয়ে একজন খেলোয়াড়ের পারফরম্যান্স বিচার করতে যাওয়াও ঠিক নয়। তবু গোল-অ্যাসিস্টের সংখ্যা কিছুটা ধারণা দিতে পারে একজন খেলোয়াড় কতটা আত্মবিশ্বাসী আছেন, সেটির। আর সেই সংখ্যা বলছে, লিগে এই মৌসুমে ২৩ ম্যাচে ৬ গোল করেছেন গ্রিজমান, তার ৩টিই ২০২১ সালে। স্পেনের ঘরোয়া দুই টুর্নামেন্ট কোপা দেল রে ও স্প্যানিশ সুপারকোপাতে ৪ গোল করেছেন গ্রিজমান, চারটিই এই জানুয়ারিতে। গোল করিয়েছেনও বেশ কয়েকটি।

গ্রিজমানের এমন ছন্দে ফেরার পেছনে বার্সা কোচ রোনাল্ড কোমানের কৌশলের বদলকে বড় কারণ ধরা হচ্ছিল। এই মৌসুমে বার্সার ডাগআউটে এসে দলকে প্রথমে ৪-২-৩-১ ছকে খেলাতে শুরু করেছিলেন কোমান। কিন্তু ওসমান দেম্বেলে তখন চোটে ছিলেন, তরুণ আনসু ফাতি মৌসুমের প্রথম কয়েক ম্যাচে ঝলক দেখালেও পরে চোটে পড়েন। আগস্টে ক্লাব ছাড়তে চাওয়া মেসিও তখনো গুছিয়ে নিতে পারেননি। ছন্নছাড়া, চোটগ্রস্ত বার্সার আক্রমণে দিশেহারা ছিলেন গ্রিজমানও।

আক্রমণে কোথায় খেলবেন ফরাসি ফরোয়ার্ড, সেটিও যেন ঠিক ছিল না। সেটি অবশ্য গ্রিজমান বার্সায় আসার পর থেকে দেড় বছরে কখনোই ঠিক ছিল না। ঠিক যে থাকবে না, সেটিও গ্রিজমান বার্সায় আসার সময়েই শঙ্কা ছিল। থাকবে কীভাবে, আতলেতিকো মাদ্রিদ কিংবা ফ্রান্স জাতীয় দলে গ্রিজমানের ভূমিকা যে বার্সায় মেসির ভূমিকার মতোই। গ্রিজমানের চেয়ে কৌশলে, দক্ষতায় এগিয়ে থাকা মেসির খেলা নষ্ট করে বার্সার কোনো কোচ নিশ্চয়ই গ্রিজমানকে বার্সায় মেসির ভূমিকা দেবেন না! আর্নেস্তো ভালভার্দে, কিকে সেতিয়েন কিংবা কোমান—বার্সায় এখন পর্যন্ত যে তিন কোচের অধীনে খেলেছেন গ্রিজমান, কেউই তা করেননি।

কাদিজের বিপক্ষে বার্সার ১-১ গোলে ড্র ম্যাচে সবার আগে যে দুই খেলোয়াড়কে উঠিয়ে নেন কোমান, তাঁদের একজন গ্রিজমান। এরপর এলচের বিপক্ষে ম্যাচে গ্রিজমানকে বেঞ্চে বসিয়ে রাখেন, সবার শেষে যে তিনজন খেলোয়াড়কে নামিয়েছেন তাঁদের একজন গ্রিজমান। আর কাল সেভিয়ার বিপক্ষে তো কোমান নামানই-নি গ্রিজমানকে।

কিন্তু ডিসেম্বরে লিগে কাদিজের কাছে হারের পর কোমান খেলার কৌশল বদলে ফেলেন। ৪-২-৩-১ থেকে আবার ফেরেন বার্সার চিরপরিচিত ৪-৩-৩ ছকে। মেসি স্বাধীন ভূমিকায়, তাঁর দুই পাশে গ্রিজমান আর দেম্বেলে নিজেদের মতো অদলবদল করে খেলবেন—এ-ই ছিল কৌশলের মূল ভাবনা। মেসির ছন্দে ফেরা, মেসি-গ্রিজমানের সমন্বয় ভালো হয়ে ওঠা আর কৌশলের এই বদল মিলিয়ে বার্সা ও গ্রিজমান দুই পক্ষই ছন্দে ফিরেছে। কিন্তু পিএসজির বিপক্ষে ম্যাচে আবার সব যেন শেষ হয়ে গেল গ্রিজমানের জন্য।

শুধু পিএসজিই নয়, এরপর গত রোববার লিগে কাদিজের বিপক্ষে বার্সার ১-১ গোলে ড্র ম্যাচেও ম্রিয়মাণ ছিলেন গ্রিজমান। সে ম্যাচে সবার আগে যে দুই খেলোয়াড়কে উঠিয়ে নেন কোমান, তাঁদের একজন গ্রিজমান। এরপর এলচের বিপক্ষে ম্যাচে গ্রিজমানকে বেঞ্চে বসিয়ে রাখেন, বার্সার ৩-০ গোলে জেতা সেই ম্যাচে সবার শেষে যে তিনজন খেলোয়াড়কে নামিয়েছেন তাঁদের একজন গ্রিজমান। আর কাল সেভিয়ার বিপক্ষে তো কোমান নামানই-নি গ্রিজমানকে। এমনকি ৮২ মিনিটে বার্সা ১-০ গোলে এগিয়ে থাকা অবস্থায় গ্রিজমানকে বসিয়ে রেখেই দেম্বেলের বদলে নামিয়েছেন মার্টিন ব্রাথওয়েইটকে। ম্যাচ শেষে এ নিয়ে প্রশ্নে অবশ্য কোমান বলেছেন, গ্রিজমানকে এভাবে বসিয়ে রাখা ‘কোনো শাস্তি ছিল না।’

কিন্তু স্পোর্ত বলছে ভিন্ন কথা। বার্সেলোনাভিত্তিক ক্রীড়া দৈনিকটির প্রতিবেদনে লেখা, পিএসজির বিপক্ষে ম্যাচে গ্রিজমানের পারফরম্যান্সে খেপেছেন কোমান। নেইমার ও আনহেল দি মারিয়া না থাকায় পিএসজির বিপক্ষে বার্সা সমানে-সমানে লড়তে পারবে, এমনটাই নাকি ভেবেছিলেন কোমান। কিন্তু কিলিয়ান এমবাপ্পের চোখধাঁধানো হ্যাটট্রিকে গুঁড়িয়ে গেছে বার্সা। প্রায় মিলিয়ে গেছে মেসিদের চ্যাম্পিয়নস লিগের ক্ষয়িষ্ণু স্বপ্ন।

স্পোর্ত লিখেছে, পিএসজির বিপক্ষে ম্যাচের পর কোমানের উপলব্ধি, বড় দলের বিপক্ষে ম্যাচে বার্সা এখন আর দাপুটে ফুটবল খেলার মতো দল নেই। এমন ম্যাচে কোনো ফল বের করতে হলে দলকে সাবধানী ফুটবল খেলানোর পক্ষে কোমান। কেমন সাবধানী? স্পোর্তের ভাষায়, ‘হিসাব করে আক্রমণে উঠবে, মাঝমাঠে আরও পরিশ্রমী হবে।’ আর সে ক্ষেত্রে মাঝমাঠে খেলোয়াড় বাড়িয়ে আক্রমণে মেসি আর দেম্বেলের জুটি চান কোমান।

গতকাল লিগে সেভিয়ার বিপক্ষেও প্রায় এমন কৌশলেই খেলেছেন। ৩-৪-২-১ ছকে তিন সেন্টারব্যাক হিসেবে পিকে-লংলে-মিঙ্গেসাকে খেলিয়েছেন। মাঝমাঠে চারজনের মধ্যে দুই পাশে উইংব্যাক হিসেবে খেলিয়েছেন রাইটব্যাক সের্হিনিও দেস্ত ও লেফটব্যাক জর্দি আলবাকে। মাঝমাঠের কেন্দ্রে বুসকেতস-ডি ইয়ংয়ের সামনে পেদ্রি। আর দুই ফরোয়ার্ড মেসি ও দেম্বেলে।

স্পোর্তের ভাষ্য, গ্রিজমান যেভাবে দলের জন্য নিজেকে উজাড় করে দেন, রক্ষণে নেমে আসেন বারবার...সেসব কোমান বেশ পছন্দ করেন। কিন্তু আক্রমণের ক্ষেত্রে আরও গতিময় খেলোয়াড় চান বার্সা কোচ, সে জন্য মৌসুমের শুরু থেকেই ডাচ ফরোয়ার্ড মেম্ফিস ডিপাইকে চেয়েছেন তিনি।

সেভিয়ার বিপক্ষে গতকাল পেদ্রি চোটে পড়ায় গ্রিজমানের দলে ফেরার রাস্তা খুলতে পারে বলে জানাচ্ছে স্পোর্ত। তবে সঙ্গে এ-ও জানাচ্ছে, এই মুহূর্তে দেম্বেলের পেছনেই আছেন গ্রিজমান। আর বড় ম্যাচে তাঁর খেলা এখন থেকে অনিশ্চয়তায় ঘেরাই থাকবে।