মেসিরা কেন স্বপ্ন দেখছেন লাপোর্তাকে নিয়ে?

মেসি আগামী মৌসুমে এভাবে ছুটবেন কোন জার্সি গায়ে?ছবি: রয়টার্স

নতুন সভাপতি হিসেবে হোয়ান লাপোর্তার পুনরাগমনই যে আপাতদৃষ্টে বার্সেলোনার জন্য সবচেয়ে ভালো সমাধান, এটা মোটামুটি সবাই বুঝে গিয়েছিলেন। ‘ওপেন সিক্রেটের’ মতো মোটামুটি সবাই জেনে গিয়েছিলেন, যত যা-ই হোক না কেন, ক্লাবের ইতিহাসের সফলতম সন্তান লিওনেল মেসিকে ধরে রাখার জন্য সভাপতি হিসেবে লাপোর্তার বিকল্প নেই। তা যতই বাকি দুই প্রার্থী ভিক্তর ফন্ত আর টনি ফ্রেইক্সা হম্বিতম্বি করুন না কেন!

বাইরের মানুষই যেখানে বুঝছেন, বার্সার সদস্যরা সেটা বুঝবেন না? বার্সা নামের নৌকাটাকে ডোবার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য তাই ঘুরেফিরে আবারও লাপোর্তার হাতেই সভাপতির দায়িত্ব সঁপে দিয়েছেন তাঁরা। লক্ষ্য একটাই, ক্লাবে যেন আবারও সোনালি সময় ফিরে আসে। ২০০৩ সাল থেকে সাত বছর বার্সায় প্রথম দফা সভাপতি থাকার সময়ে যা ফিরিয়ে এনেছিলেন লাপোর্তা।

কিন্তু কেন বার্সেলোনা লাপোর্তার ওপর এত ভরসা করছে? একটু পেছনে ফিরে তাকানো যাক।

২০০৩ সালে বার্সার সভাপতি নির্বাচনে যখন দাঁড়িয়েছিলেন পেশায় উকিল এই লাপোর্তা, কেউ কল্পনাও করেনি তিনি জিতবেন। বরং লুইস বাসাত বার্সেলোনার পরবর্তী সভাপতি হবেন, এমনটাই ধরে নিয়েছিলেন সবাই। এতই ছিল বাসাতের জনপ্রিয়তা।

বার্সার সভাপতি পদে নির্বাচিত হওয়ার পর লাপোর্তা।
ছবি: রয়টার্স

কিন্তু পাল্লা লাপোর্তার দিকে হেলে পড়ে দুটি কারণে। এক. নির্বাচিত হলে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে ইংলিশ মিডফিল্ডার ডেভিড বেকহামকে দলে আনবেন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন লাপোর্তা। দুই. ক্লাব কিংবদন্তি ইয়োহান ক্রুইফ প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছিলেন লাপোর্তাকে। অনানুষ্ঠানিকভাবে লাপোর্তার পরামর্শক হিসেবেও কাজ করতেন ক্রুইফ।

সঙ্গে লাপোর্তার বৈচিত্র্যময় ব্যক্তিত্ব ও বাগ্মিতা তো ছিলই। শেষমেশ হোয়ান গাসপার্ত ও হোসে লুইস নুনিয়েসের উত্তরসূরি হিসেবে লাপোর্তাকেই বেছে নেন বার্সার সদস্যরা। বয়সী ও বৃদ্ধ নেতৃত্বের জায়গায় লাপোর্তার তারুণ্যে আস্থা রাখে বার্সেলোনা।

কিন্তু সভাপতিত্বের শুরুতেই হোঁচট খান লাপোর্তা। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার এক সপ্তাহের মাথায় বার্সেলোনা নয়, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদে নাম লেখান বেকহাম। এমনকি রিয়ালে যোগ দেওয়ার আগে সংবাদ সম্মেলন করে বেকহাম জানিয়ে দেন, লাপোর্তার সঙ্গে কথা হলেও বার্সায় যাওয়ার জন্য রাজি হননি তিনি। বেশ বড় একটা ধাক্কা নিঃসন্দেহে।
মুখরক্ষা করার জন্য পিএসজি থেকে ব্রাজিলিয়ান উইঙ্গার রোনালদিনিওকে দলে টানলেন লাপোর্তা।

ব্রাজিলের এই মিডফিল্ডার তখন সদ্যই বিশ্বকাপ জিতেছেন। প্রতিভাবান ছিলেন নিঃসন্দেহে, কিন্তু তাই বলে ক্লাব ফুটবলে তাঁর ক্যারিয়ার তখনো বেকহামের মতো অত আলো-ঝলমলে হয়নি। লাপোর্তা চেয়েছিলেন আর্সেনালের স্ট্রাইকার থিয়েরি অঁরিকেও। আর্সেনালে তখন শিরোপায় ভাসতে থাকা অঁরি পাঁচ বছর ধরে কোনো শিরোপা না জেতা বার্সায় আসতে চাননি। বলা যায়, কোনো রকমে সমর্থকদের ঠান্ডা করার জন্যই রোনালদিনিওর মুখের দিকে চেয়েছিলেন লাপোর্তা। সেই রোনালদিনিওই যে তাঁর সভাপতি জীবনের অন্যতম বড় সাফল্যগাথা হিসেবে থাকবেন, সেটা হয়তো নিজেও বোঝেননি।

শুধু নতুন খেলোয়াড়ই নয়, ইয়োহান ক্রুইফের পরামর্শে লাপোর্তা দলের কোচ হিসেবে নিয়ে আসেন ডাচ কিংবদন্তি ফ্রাঙ্ক রাইকার্ডকে। বার্সায় আসার আগে রাইকার্ডের কোচিং ক্যারিয়ার তেমন উজ্জ্বল ছিল না। তাই তাঁর নিয়োগেও বার্সা সমর্থকেরা তেমন উল্লসিত হতে পারেননি। কিন্তু লাপোর্তা, রোনালদিনিও কিংবা রাইকার্ডকে নিয়ে সংশয়বাদীদের চুপ করিয়ে দিতে সময় লেগেছে মাত্র এক মৌসুম।

এক মৌসুম পর থেকেই লাপোর্তা-রাইকার্ড-রোনালদিনিও ত্রয়ী বার্সায় আনা শুরু করেন একের পর এক শিরোপা। লাপোর্তার প্রথম মৌসুমে কিছু না জিতলেও এরপর টানা দুই মৌসুম লিগ জেতে বার্সেলোনা। জেতে ২০০৬ চ্যাম্পিয়নস লিগও। শুধু রোনালদিনিওই নন, দলে একে একে আসা শুরু করেন স্যামুয়েল ইতো, ডেকোর মতো তারকারা।

লাপোর্তার সভাপতি থাকার সময়ের আরেকটা সাফল্য, ক্লাবের একাডেমি ‘লা মাসিয়া’র উত্তরোত্তর উন্নয়ন। লিওনেল মেসির ‘মেসি’ হয়ে ওঠা, মূল দলে জেরার্ড পিকে, সের্হিও বুসকেতস, জাভি হার্নান্দেস, আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা, পেদ্রোদের আসা এই লাপোর্তার আমলেই।

মেসির পাশে পেদ্রি, দেম্বেলে, ডি ইয়ংদের মতো তরুণদের ঘিরেই আগামী দিনের স্বপ্ন দেখে বার্সা।
ছবি: রয়টার্স

এবার তাই বার্সা সমর্থকেরা এটা ভেবে আশাবাদী হতেই পারেন যে, একাডেমির আনসু ফাতি, ইলাইশ মরিবা, রিকি পুচ, অস্কার মিঙ্গেসা, ওরিওল বুসকেতস, আলেক্স কোলাদো, কনরাদ দে লা ফুয়েন্তে, ম্যাথিউস পেরেইরা, ইয়ান্দ্রো ওরেয়ানা, গুস্তাভো মাইয়ারা হয়তো মূল দলে নিজেদের প্রতিভা আরও বেশি করে দেখানোর সুযোগ পাবেন। হবেন আগামীর জাভি-মেসি-ইনিয়েস্তা। অর্থাৎ দল গঠন করার জন্য, আদর্শ একটা ক্রীড়াপ্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য অন্য যে কারোর চেয়ে লাপোর্তা অনেক বেশি যোগ্য।

‘ক্রীড়া প্রকল্প’ শব্দজোড়ায় বার্সা সমর্থকদের অনেক আশা-ভরসা লুকিয়ে। বার্সেলোনাকে মাঠের ফুটবলের শীর্ষ পর্যায়ে আবারও সব সময়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো দল হিসেবে গড়ে তোলার মতো একটা ক্রীড়া প্রকল্প বার্সার আগের সভাপতি জোসেপ মারিয়া বার্তোমেউর সময়ে ছিল না। মেসি যে গত আগস্টে দল ছাড়তে চেয়েছিলেন, তা তো বার্সেলোনার সুনির্দিষ্ট কোনো ক্রীড়া প্রকল্প নেই বলেই!

গত কয়েক মাসে স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যমে বারবার শোনা গেছে, বার্সার নতুন নির্বাচিত সভাপতির ক্রীড়া প্রকল্প ও পরিকল্পনা পছন্দ হলেই কেবল মেসি চুক্তি নবায়ন করবেন। আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড নিজেই গত জানুয়ারিতে সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, জুনে তাঁর চুক্তি শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন, আইনগতভাবে অন্য কোনো ক্লাবের সঙ্গে কথা বলতে স্বাধীন হলেও তা করবেন না। লাপোর্তা এসে মেসিকে পছন্দের একটা ক্রীড়া প্রকল্প উপস্থাপন করতে পারবেন, এটাই আশা বার্সা সমর্থকদের।

কাল বার্সার সভাপতি নির্বাচনে ছেলেকে নিয়ে ভোট দেন মেসি।
ছবি: টুইটার

লাপোর্তা তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় বারবার দাবি করেছেন, তিনি ছাড়া অন্য কেউ সভাপতি হলে মেসি থাকবেন না বার্সায়। আর কাল নির্বাচিত হওয়ার পর যখন সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেন, ‘আপনি কি কাল হোর্হে মেসির (লিও মেসির বাবা, তাঁর এজেন্টও) সঙ্গে কথা বলবেন?’ সেটির উত্তরে লাপোর্তা বলেছিলেন, ‘কাল কেন? আমি তো আজই কথা বলতে পারি!’ পরে জানিয়েছেন, মেসিকে দলে ধরে রাখার জন্য নতুন চুক্তি নিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই দেখা করতে যাবেন দলের অধিনায়কের সঙ্গে।

দেনার দায়ে ধুঁকতে থাকা বার্সায় মেসির বেতন কমিয়ে তাঁকে নিজের ক্রীড়া প্রকল্পের ব্যাপারে বুঝিয়ে থাকতে রাজি করাবেন লাপোর্তা, এমনই গুঞ্জন স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যমে। এখন দেখার বিষয়, লাপোর্তার প্রকল্প মেসির পছন্দ হয় কি না!