মোহামেডানে বাদল রায়ের শেষ দিন

মোহামেডানেই কাটিয়ে দিয়েছেন গোটা খেলোয়াড়ি জীবন। ১০ নম্বর জার্সি নিয়ে ক্লাবকে এনে দিয়েছেন কত গৌরবের মুহূর্ত। আজ বিদায়বেলাতেও বাদল রায় এলেন তাঁর প্রিয় ক্লাবে।
সংগৃহীত ছবি

ঘড়ির কাঁটায় তখন বেলা ১১টা। মতিঝিলের মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে এলেন বাদল রায়। খাটিয়ায় শুয়ে, সারা দেশে প্রিয় ক্লাবের সাদা-কালো পতাকা জড়িয়ে। যে ক্লাবকে খেলোয়াড় হিসেবে এনে দিয়েছেন অজস্র গৌরব, সাফল্য, সে ক্লাবে চিরবিদায়ের লগ্নে আসবেন না তা কীভাবে হয়! নিজেদের অন্যতম সেরা সন্তানকে আজ চোখের জলে বিদায় জানিয়েছে দেশের ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটি। চলে যাওয়ার সময় ভক্তদের ভালোবাসা পেলেন, ফুলে ফুলে ভরে গেল তাঁর বিদায়ের শয্যা, কিন্তু বাদল রায়ের সেদিকে আর ফিরে তাকানো হলো না।

সেই আশির দশকের মতোই ভিড় হলো আজ ক্লাব প্রাঙ্গণে। বাদল রায় যখন ক্লাবে আসতেন, সমর্থকেরা তাঁকে একনজর চোখের দেখা দেখতে চাইতেন। স্বপ্নের তারকাকে নিজেদের চোখে দেখার সেই আনন্দ উপভোগ করতেন তাঁরা। আজ ভিড়ে মিশে রইল প্রিয় তারকাকে হারানোর হাহাকার। আজ যে অতীত হয়ে গেলেন তিনি।

অনেক সমর্থকের মানসপটেই ভেসে উঠেছিল সেই দিনগুলোর স্মৃতি। ১৯৮৬ সালে অধিনায়ক হিসেবে বাদল রায় ঘুচিয়েছিলেন টানা তিন বছর শিরোপা না পাওয়ার দুঃখ। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনীর বিপক্ষে লিগের দুই লেগেই জয় পেয়েছিল মোহামেডান। প্রথম লেগে তিনিই গোল করে এনে দিয়েছিলেন দুর্দান্ত এক জয়। শিরোপা হারাতে হারাতে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে বসা দলটা সেদিনই খুঁজে নিয়েছিল শিরোপা জয়ের শক্তি। ১৯৭৭ সালে যে ক্লাবের হয়ে তাঁর পথচলার শুরু, খেলোয়াড়ি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাটিয়েছেন সেই মোহামেডানেই। নিজের বাড়ির মতোই প্রিয় এই শিবিরে চিরবিদায়ের মুহূর্তটি ছিল সমর্থক ও তাঁর সতীর্থদের জন্য আবেগঘন, অশ্রুসিক্ত।

মোহামেডান ক্লাবে বাদল রায়কে শেষ শ্রদ্ধা।
ছবি: প্রথম আলো

এই মোহামেডান তাঁর অভিভাবকত্বেই ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছিল। গত বছর ক্যাসিনো-কাণ্ডে এলোমেলো হয়ে পড়া ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটির দল গঠনের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। সঙ্গে নিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় সতীর্থদের, যাঁদের নিয়ে একসময় বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের মাঠে লড়তেন, সেই কায়সার হামিদ, ইমতিয়াজ সুলতান জনি, আবদুল গাফফাররা মোহামেডানের নতুন শুরুর লগ্নে বাদল রায়ের পাশে যেভাবে ছিলেন, আজ তাঁর বিদায়ের লগ্নেও থাকলেন, এক বুক কান্না নিয়ে। তাঁদের মনে পড়ল সেই পুরোনো দিনগুলি। ক্লাবের বারান্দায় আড্ডা, সেই আনন্দমুখর মুহূর্তগুলো। ছিলেন তাঁর স্ত্রী মাধুরী রায়, মেয়ে আর ছেলে।

বাদল রায়ের কন্যা মোহামেডান ক্লাবে দাঁড়িয়েই বললেন ফুটবলের প্রতি তাঁর বাবার ভালোবাসার কথা, ‘ফুটবলকে অসম্ভব ভালোবাসত বাবা। চেয়েছিল আরও কিছুদিন ফুটবলের সঙ্গে থাকতে। সেটা হলো না দেখে কষ্ট হচ্ছে। আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি, কিন্তু সবাই আমার বাবাকে এত ভালোবাসে, এটা দেখে ভালো লাগছে। আজ বাবার বিদায়ের দিনে অনেককেই দেখছি, যাঁরা আমাদের মাথার ওপর ছায়া হয়ে রইবেন।’

একসময়ের সতীর্থ কায়সার হামিদ নিজের কৃতজ্ঞতা জানালেন বাদল রায়ের প্রতি, ‘আমাকে মোহামেডানে এনেছেনই বাদল দা। তিনি আমার চেয়ে বয়সে ৫/৭ বছরের বড়। ক্যারিয়ারের শুরুতে ওনার খেলা মুগ্ধ চোখে দেখতাম। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত মোহামেডান লিগে অপরাজিত ছিল। এই সময়ের শুরুটা তাঁর হাত দিয়েই হয়েছিল। তিনি এই সময় রেখেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান।’

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ফজলে নূর তাপসও শোক জানাতে এসেছিলেন। বলেছেন, ‘দেশের ফুটবল একজন ঐতিহ্যের ধারককে হারাল। তিনি ছিলেন দেশের ফুটবলের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব।’

মোহামেডান ক্লাব থেকে তাঁকে নেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে, যে মাঠের প্রতিটি তৃণকণায় মিশে রয়েছে দেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই তারকার স্মৃতি। সে স্মৃতিই তো বাদল রায়কে বাঁচিয়ে রাখবে ফুটবলপ্রেমীদের হৃদয়ে।