মোহামেডানের গোলপোস্টে তিনি যেন ‘কানন’, ‘আমিনুল’

মোহামেডানের কিংবদন্তি গোলরক্ষকদের স্মৃতি ফেরালেন আহসান হাবীবছবি: প্রথম আলো

ম্যাচের তখন ৯০ মিনিট। স্কোরলাইনে ২-২ গোলের সমতা। এই পর্যায়ে যে দল গোল করবে, নিঃসন্দেহে বলা যায়, তারাই জয় নিয়ে মাঠ ছাড়বে। এমন অবস্থায় নিজেদের অর্ধ থেকে লম্বা এক পাসে প্রতি আক্রমণ শুরু করলেন সাইফ স্পোর্টিংয়ের ফরোয়ার্ড রহিম উদ্দিন। মাঝমাঠে বলটা চলে গেল সাইফের নাইজেরিয়ান মিডফিল্ডার জন ওকোলির পায়ে।

গোটা ৯০ মিনিট একই গতিতে খেলে যাওয়া ওকোলির সঙ্গে এমনিতেই মোহামেডানের হাঁপিয়ে যাওয়া তারকারা তেমন পারছিলেন না, এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। একে একে আতিকুজ্জামান আর উরু নাগাতাকে কাটিয়ে একাই ছুটে চললেন গোলপোস্টের দিকে। পথে মুনাজির কুলদিয়াতি কিংবা হাবিবুর রহমানের মতো ডিফেন্ডাররাও আটকাতে পারলেন না এই মিডফিল্ডারকে। সামনে শুধুই মোহামেডানের গোলরক্ষক আহসান হাবীব। আহসানকে পরাস্ত করতে পারলেই গোল, আর গোল মানেই সাইফের জয় একরকম সুনিশ্চিত।

এমন অবস্থায় একদম ‘পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ’ থেকে ওকোলির শটটা আটকে দিলেন আহসান। তাঁর বাঁ পায়ে লেগে বল চলে গেল মাঠের বাইরে। শটটা নেওয়ার পরই হতাশ ওকোলির মাঠের মধ্যেই শুয়ে পড়া, কিংবা সতীর্থ স্ট্রাইকার কেনেথ এনগোকের কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রকাশ করে, আসলে ঠিক কত বড় সুযোগটা হারিয়েছেন ওকোলি! সে শটে গোল হলে হয়তো টাইব্রেক নামক ভাগ্যের খেলায় নামতে হতো না কোনো দলকেই, তখনই ফেডারেশন কাপ থেকে বিদায় নিতে হতো দেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ক্লাব মোহামেডানকে। আহসান হাবীব সেটা হতে দেননি। দলকে টেনে নিয়ে গেছেন টাইব্রেকারে।

দারুণ কিপিং করেছেন আহসান হাবীব।
ছবি: প্রথম আলো

শুধু ওকোলির এই শটটা বলেই নয়, গোটা ম্যাচে ওকোলি, ফাহিম, কেনেথদের আরও বেশ কিছু শট আটকে নিজের জাত চিনিয়েছেন এই গোলরক্ষক। টাইব্রেকেও দলকে বাঁচিয়েছেন একবার। শুধু তা-ই নয়, যেসব শটগুলো আটকাতে পারেননি, সেগুলোতেও হাত ছুঁইয়েছিলেন অন্তত, ঠিক দিকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। কিন্তু এত কিছুর পরও ভাগ্য সহায় ছিল না মোহামেডানের। রাইটব্যাক আতিকুজ্জামানের লক্ষ্যভ্রষ্ট এক শট নিশ্চিত করে দেয়, সেমিতে ওঠা হচ্ছে না মোহামেডানের। তা সত্ত্বেও আহসান হাবীব যেভাবে দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে বুক চিতিয়ে লড়ে গেলেন, শুধু মোহামেডান সমর্থকেরাই নন, মাঠে আসা বা টিভিতে খেলা দেখা প্রত্যেকের চোখে লেগে থাকবে সেই পারফরম্যান্স।

আহসানের নিজের কেমন মনে হচ্ছে কালকের ম্যাচের পর? নিজের এমন দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পর জয় নিয়ে কেমন আশাবাদী ছিলেন তিনি? প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবে অনেকটা অদৃষ্টবাদীই হয়ে গেলেন যেন, ‘মনে হচ্ছিল আমরা জিতে যাব, কিন্তু ভাগ্য সহায় ছিল না শেষ পর্যন্ত!’

আর অদৃষ্টবাদী হবেন নাই-বা কেন? টাইব্রেকে যেভাবে সঠিক দিকে ঝাঁপ দেওয়ার পরও হাত ছুঁয়ে বল ঢুকে যাচ্ছিল, তাতে এমনটাই মনে হওয়ার কথা হয়তো। সেই হতাশা স্পষ্ট আহসানের কণ্ঠে, ‘পেনাল্টি শুটআউট ব্যাপারটাই অনেকটা ভাগ্যের ওপর। শেষের দিকে সাইফ জিতবে, এ জন্য মনে হয় বল হাতে লাগার পরও গোল হয়েছে ওদের!’

বিদেশিদের ফিটনেস যে এমন স্নায়ুক্ষয়ী ম্যাচে অনেক বড় ভূমিকা রাখে, সেটা সাইফের জন ওকোলি ম্যাচের গোটা সময় ধরেই বুঝিয়ে গেছেন। মোহামেডানেরও একজন অমন বিদেশি ছিলেন, যিনি মুক্তিযোদ্ধার বিপক্ষে আগের ম্যাচেই জোড়া গোল করে নিজের জাত চিনিয়েছিলেন। সেই আবিওলা নুরাতকে এই ম্যাচে কার্ড সমস্যার কারণে পায়নি মোহামেডান। ওকোলির দাপট দেখে সতীর্থ নুরাতের কথাটাও বারবার মনে হয়েছে আহসানের, ‘এমন ম্যাচে একজন বিদেশির থাকাটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ও থাকলে অবশ্যই ভালো হতো আমাদের। আর এই পর্যায়ে টানা ১২০ মিনিট ম্যাচ খেলাও তো অনেক কষ্টের ব্যাপার।’

মোহামেডান ফেডারেশন কাপ থেকে বিদায় নিলেও আহসানের খেলা মুগ্ধ করেছে অনেক পাঁড় মোহামেডান-ভক্তকে। আমিনুল হক থেকে শুরু করে ছাঈদ হাসান কানন, পনির-উজ-জামান থেকে শুরু করে মোহাম্মদ মহসীন কিংবা শহীদুর রহমান সান্টু— দেশের সাবেক কিংবদন্তি অনেক গোলরক্ষকই অতীতে মোহামেডানের গোলবার আগলেছেন। আহসানের পারফরম্যান্স দেশের অতীতচারী সেসব সমর্থকের মনে আবারও আশার সঞ্চার করেছে, হয়তো আহসানের হাত ধরেই মোহামেডানে ফিরবে সুদিন। আহসান নিজে অবশ্য ওসব কিংবদন্তিদের সঙ্গে নিজের নামটা আলোচনাই করতে চান না, ‘মাত্র শুরু করলাম, দেখি আল্লাহপাক কতটুকু সফল করেন আমাকে। যাদের নাম করলেন, তাঁদের ধারকাছ দিয়েও আমি নেই। দোয়া করবেন যেন তাঁদের মতো হতে পারি। তবে এখন আমি শুধুই নিজের কাজটা ঠিকঠাক করে যেতে চাই।’

মোহামেডানের কিংবদন্তি গোলরক্ষক কাননও মাঝেমধ্যে এসে আহসানকে পরামর্শ দিয়ে যান, বোঝা গেল। সঙ্গে নিজের উন্নতির পেছনে অন্যদের ভূমিকা স্বীকার করতেও ভুল করলেন না এই গোলরক্ষক, ‘শুধু আমি নই, আমাদের ম্যানেজার, কোচ, টিম লিডার, আমিসহ দলের সবাইকেই প্রয়োজনীয় টিপস দেন। আমাদের গোলকিপিং কোচ নিজাম মজুমদার ভাই সব সময় আমাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে উজ্জীবিত রাখেন খেলার ব্যাপারে। সবাই কমবেশি উৎসাহ দেন। আর কানন ভাইয়ের কথা আর কী বলব, উনিও ক্লাবে এলে আমাকে প্রায়ই টিপস দেন। তাঁর মতো কিংবদন্তির পরামর্শ পাওয়াটাও আমার জন্য অনেক বড় ব্যাপার।’

গোলকিপার হিসেবে কাকে আইডল মানেন আহসান? কার খেলা দেখে মনে হয় যে না, আমার রিফ্লেক্সটা এমন হওয়া উচিত, কিংবা পজিশনিংটা এর মতো করতে হবে আমাকে? উত্তরে দুই কিংবদন্তি গোলরক্ষকের নাম শোনা গেল আহসানের কাছ থেকে, ‘দেশে আমিনুল ভাই, বিদেশে চেলসি আর আর্সেনালের পিওতর চেক।’

জাতীয় দলের গোলরক্ষকদের মধ্যে এখন ঘুরেফিরে আবাহনীর শহীদুল আলম সোহেল, মোহামেডানের আশরাফুল ইসলাম রানা, বসুন্ধরা কিংসের আনিসুর রহমান জিকো ও সাইফ স্পোর্টিংয়ের পাপ্পু হোসেনদের নামই ঘুরেফিরে আছেন। তবে এবারের ফেডারেশন কাপে আহসান যেভাবে খেলেছেন, এই ফর্ম ধরে রাখলে সামনের সেপ্টেম্বরে সাফে বাংলাদেশের কোচ জেমি ডের পরিকল্পনায় যে থাকবেন না, সেটা বলা যাচ্ছে না। জাতীয় দলের গোলবার আগলানো নিয়ে আহসানের মনেও কি স্বপ্ন দোলা দেয় না?

উত্তরে একটু কৌশলীই মনে হলো মোহামেডানের গোলরক্ষককে। হয়তো বুঝেছেন, তাঁর চাওয়া-পাওয়ার ওপর নির্ভর করে না জাতীয় দলে জায়গা পাওয়া বা না পাওয়া। গোলবারের নিচে প্রতিযোগিতা যে দুর্দান্ত! তাই অত বেশি পরিকল্পনা করে নিজের ওপর বাড়তি চাপ আনতে চান না এই গোলরক্ষক, ‘সবারই তো আশা থাকে জাতীয় দলে খেলার, আমারও তাই। আগে লিগে ভালো খেলি, তারপর না হয় পরিকল্পনা করা যাবে এসব নিয়ে!’

এই মোহামেডানের হয়ে খেলতে গিয়েই বছর দুয়েক আগে হাত ভেঙেছিলেন আহসান। নিজের অনেক স্বপ্ন, অনেক পরিকল্পনাকে চোখের সামনে ধূলিসাৎ হতে দেখেছেন সেবার। এই জন্যই হয়তো আগে থেকে পরিকল্পনা করে নিজের ওপর চাপ বাড়াতে চান না। ধীরে ধীরে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে চান, ‘আমি ২০১৮-১৯ মৌসুমে মোহামেডানে খেলার সময় হাত ভেঙেছিলাম। ওই সময় হাত না ভাঙলে এখন আরও ভালো জায়গায় থাকতাম হয়তো! আর আমি বেশি পরিকল্পনা করলে কিছুই পাই না, এই জন্য পরিকল্পনা কম করি!’

অবশ্য যেখানে আহসানের আইডল পিওতর চেক মাথার খুলির হাড় ভেঙে যাওয়ার পরও নিজেকে বছরের পর বছর বিশ্বসেরা গোলরক্ষকদের কাতারে রেখেছেন, সেখানে হাত ভেঙে সাময়িকভাবে পিছিয়ে পড়া আহসান যে আবারও ঝলসে উঠবেন, সেটা এই ফেডারেশন কাপেই বোঝা গেছে বেশ!