ম্যারাডোনা বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ আমার হৃদয়ে’

ম্যারাডোনার হৃদয়ে ছিল বাংলাদেশছবি: এএফপি

ডিয়েগো ম্যারাডোনা চলে গেলেন। কাটিয়ে গেলেন ঝড়ের বেগে ধাবমান এক জীবন। যে জীবন ছিল বিস্ময়কর; উত্থান–পতন আর নানা চমকে ঠাসা। খেলার মাঠে তিনি সব সময়ই অদ্বিতীয়, ব্যক্তিগত জীবনেও তেমনই। তাঁর জীবনাচার ছিল উথাল–পাতাল রোমাঞ্চে ঠাসা। কখনো তিনি নায়ক, কখনো পথ হারানো খলনায়ক। কিন্তু মানুষের ভালোবাসায় সব সময়ই ছিলেন সিক্ত। তিনি ছিলেন জনমানুষের। খেলার গণ্ডি পেরিয়ে নিজেকে জনতার কাতারে আনতে পেরেছিলেন বলেই হয়তো তিনি সবার এত প্রিয়।

ম্যারাডোনার মতো ব্যক্তিত্বের দেখা পাওয়া যেকোনো মানুষের জীবনেই স্মরণীয় অভিজ্ঞতা। তেমনই এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল ১৮ বছর আগে। জাপানে তখন চলছে বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর। আমন্ত্রিত হয়েই ফুটবলের অন্যতম সেরা এই তারকা এসেছিলেন জাপানে। কিছুক্ষণের জন্য ঢুঁ মেরেছিলেন টোকিওর বিদেশি সাংবাদিকদের প্রেসক্লাবে। সেখানেই এক সংবাদ সম্মেলনে তাঁকে প্রশ্ন করার সুযোগ হয়েছিল আমার। বাংলাদেশ নামটি শুনেই তিনি বুকে হাত দিয়ে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ আমার হৃদয়ে সব সময়।’

সংবাদ সম্মেলনে অনেক বিষয় নিয়েই ম্যারাডোনাকে প্রশ্ন করেছিলেন সাংবাদিকেরা। অবধারিতভাবেই উঠে এসেছিল তাঁর সেই বিখ্যাত ‘ঈশ্বরের হাত’–এর গোলটি। ১৯৮৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে করা সেই গোলটি চিরকালীন বিতর্কের অংশ হয়েই আছে। গার্ডিয়ান পত্রিকার সাংবাদিক ওয়াটস ছিলেন সেই অনুষ্ঠানের সঞ্চালক। ইংলিশ হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই তিনি ম্যারাডোনাকে সেই ‘ঈশ্বরের হাতে’র গোল নিয়ে প্রশ্নটা করেছিলেন। উত্তরে ম্যারাডোনা কিছুটা রসিকতাই করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমি আশা করি আর্জেন্টিনার কোনো খেলোয়াড় আর এই কৌশল অবলম্বন করবে না।’

নিউইয়র্ক টাইমস কিংবা ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক ম্যারাডোনাকে প্রশ্ন করেছিলেন, তিনি কেন কিউবাকে এতটা পছন্দ করেন এবং বারবার সেই দেশটিতে এ কথা জানার পরও ছুটে যান যে কিউবা হচ্ছে একনায়কতান্ত্রিক একটি দেশ, মানবাধিকার যেখানে লঙ্ঘিত হচ্ছে এবং যে দেশটিতে বাকস্বাধীনতা বলতে কিছু নেই।

ম্যারাডোনা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সেই সাংবাদিকের মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, তিনি যেখানেই সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন, গ্রিঙ্গো সাংবাদিকেরা (লাতিন আমেরিকার দেশজুড়ে মার্কিনদের অবজ্ঞাসুলভ নাম হচ্ছে গ্রিঙ্গো) সব সময় এই একই প্রশ্ন তাকে করে। কেন তিনি কিউবাকে পছন্দ করেন এবং ফিদেলের এতটা ভক্ত তিনি কেন, সেই ব্যাখ্যা ম্যারাডোনা সেদিন দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘হতে পারে কিউবায় মানবাধিকার সেই অর্থে নেই। হতে পারে সেখানে এক ব্যক্তি ও একটি গোষ্ঠী অনেক দিন ধরে ক্ষমতাসীন। তবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে তিনি দেখেছেন, সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সেখানে চিকিৎসাসেবা সবাই ভালোভাবেই পান। সেখানে কাউকে রাস্তায় ভিক্ষা করতে দেখা যায় না। তিনি স্পষ্ট করে সেদিন বলেছিলেন, ‘দেশটি অন্যের গলা টিপে ধরে রক্ত চুষে খায় না। যেটি করছেন আপনারা।’ ম্যারাডোনার মুখে এ কথা শুনে উপস্থিত সাংবাদিকদের অনেকেই হাততালি দিয়েছিলেন।

আর্জেন্টাইন তারকাকে প্রশ্ন করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সেটি সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ ছিল। তাই অনুষ্ঠানের আগেই ওয়াটসকে অনুরোধ করেছিলাম, আমাকে সেই সুযোগটা দেওয়ার। তিনি কথা রেখেছিলেন। আমি প্রশ্ন করার সুযোগ পেয়েছিলাম। উত্তরে ম্যারাডোনা যা বলেছিলেন, সত্যিই আমি সেদিন তাতে আপ্লুত হয়েছিলাম দারুণভাবেই।

সেই সংবাদ সম্মেলনের ছবি, যেখানে ম্যারাডোনা বাংলাদেশকে স্থান দিয়েছিলেন তাঁর হৃদয়ে।
ছবি: লেখক

আমি তাঁকে ১৯৯৪ বিশ্বকাপের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলাম। নিষিদ্ধ ওষুধ সেবনের অভিযোগ তাঁকে সেবার বহিষ্কার করেছিল ফিফা। দুটি ম্যাচ খেলেই ইতি ঘটেছিল তাঁর বিশ্বকাপ অভিযাত্রার। ম্যারাডোনার নিষেধাজ্ঞার খবরে বাংলাদেশে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল আমি তাঁকে সেদিন সেটিই মনে করিয়ে দিয়েছিলাম। বাংলাদেশে সেবার মিছিল হয়েছিল। ম্যারাডোনার নিষেধাজ্ঞা বাতিল করার দাবি জানিয়ে স্লোগান উঠেছিল সেই মিছিলে। ম্যারাডোনার কাছে প্রশ্ন ছিল, তিনি এ বিষয়টি জানেন কি না!

উত্তর দিতে গিয়ে হাসি ফুটে উঠেছিল ম্যারাডোনার মুখে। বলেছিলেন, ‘আমি ভালো করেই জানি ওখানে কী হয়েছিল। ওই সময় বাংলাদেশের মানুষ যা করেছে, সে জন্য আমি কৃতজ্ঞ।’ ম্যারাডোনা এর পরপরই তাঁর হাত বুকের ওপর নিয়ে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ আমার হৃদয়ে।’

ম্যারাডোনার কথা শুনে সেদিন আমার চোখ ভিজে গিয়েছিল। তাঁর কণ্ঠে সেদিন প্রকাশ পেয়েছিল মানুষের প্রতি ভালোবাসা। আর ভালোবাসার প্রতিদানে হৃদয় নিংড়ানো আবেগ। সেটি সত্যিই অভিভূত করেছিল আমাকে।

অনুষ্ঠান শেষে প্রচণ্ড ভিড় ঠেলে তাঁর কাছে যেতেই আমার দিকে তাকিয়ে হেসে আবারও হাত রাখলেন বুকের ওপর। সে সময় সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর সঙ্গে একটা ছবি তোলার। সেই মুহূর্তটা অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা হয়েই আছে আমার জন্য।

ম্যারাডোনার মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকেই তাঁর সেই কণ্ঠ কানে বাজছে, ‘বাংলাদেশ আমার হৃদয়ে।’ আমরাও বলি, ডিয়েগো, আপনিও চিরদিন আমাদের হৃদয়েই থেকে যাবেন। আপনার মতো কিংবদন্তির যে মৃত্যু নেই।