‘যদি’র টমেটো, ‘কিন্তু’র শসা—তৈরি বার্সার শব্দ–সালাদ

সুপার লিগ নিয়ে নিজেদের অবস্থান জানিয়েছে বার্সেলোনা।ছবি: এএফপি

ইউরোপিয়ান সুপার লিগের কবর দিয়ে ফেলেছেন অনেকেই। গত রোববার ঝড় তুলে জন্ম নেওয়া এই বিদ্রোহী লিগের প্রতিষ্ঠাতা ১২টি দলের মধ্যে ১০টিই সরে গেছে প্রকল্প থেকে। ফুটবলদুনিয়ার ‘ভালো’র জন্য যে প্রকল্প জন্ম দিয়েছিলেন রিয়াল মাদ্রিদ সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ, সেটা দুই দিনের মধ্যেই কোমায় চলে গেছে। পেরেজের জেদের কারণেই এখনো লাইফ সাপোর্ট নিয়ে টিকে আছে সুপার লিগ। আর তাঁকে এ দুঃসময়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে বহু পুরোনো সঙ্গী।

সঙ্গী? চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী, অন্তত মাঠে তা-ই। রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সেলোনা—স্প্যানিশ ফুটবল শুধু নয়, বিশ্ব ফুটবলেরই প্রতিদ্বন্দ্বিতার রূপক হয়ে উঠেছে এ দুই দল। শতবর্ষের পুরোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা দুই দলের মধ্যে যে অন্য রকম বন্ধুত্বের এক সম্পর্কও সৃষ্টি করে দিয়েছে, সেটা বুঝিয়ে দিয়েছে সুপার লিগ। একে একে সব দলই নাম কাটিয়ে নিয়েছে। প্রকল্পের অন্যতম উদ্যোক্তা জুভেন্টাসও আপাতত সুপার লিগ স্থগিত করার বাস্তবতা মেনে নিয়েছে। কিন্তু পেরেজ এ দুঃসময়ে ঠিকই পাশে পাচ্ছেন বার্সেলোনাকে।

গতকাল সুপার লিগ নিয়ে অবশেষে মুখ খুলেছেন বার্সেলোনার নবনির্বাচিত সভাপতি হোয়ান লাপোর্তা। পরে রাতেই আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়েছে বার্সেলোনা। সে বিবৃতি পড়ে যে শব্দযুগল মাথায় আসে, সেটা হলো ‘শব্দ-সালাদ!’ শব্দের জগাখিচুড়ি পাকিয়ে বারবার নিজেদের মনোভাব জানিয়েছে বার্সেলোনা, যা পড়ে পাঠকের মাথা বনবন করার কথা, বায়ু শনশন মনে হওয়ার দশা!

দুঃসময়ে লাপোর্তাকে পাশে পাচ্ছেন পেরেজ।
ছবি: এএফপি

গতকাল রাতে স্প্যানিশ টিভি থ্রি-তে দেওয়া সাক্ষাৎকারে লাপোর্তাই সুপার লিগকে ‘একান্ত জরুরি’ বলে রায় দিয়েছেন, এরপর আর বার্সেলোনার এ লিগ নিয়ে মনোভাব বোঝার বাকি ছিল না কারও। তবু যদি কারও মনে কোনো সন্দেহ থাকে, সেটা দূর করে দিয়েছে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি। সে বিবৃতি তারা দুটি ভাগ করে দিয়েছে। প্রথম ভাগে তারা সুপার লিগের মতো একটি প্রকল্পে কেন যুক্ত হয়েছে, সেটা ব্যাখ্যা করেছে। সেখানেই কথার জঙ্গলে পাঠককে দ্বিধায় ফেলে দেওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল।

ইংলিশ দৈনিক গার্ডিয়ান ও ফুটবলবিষয়ক সাইট ইএসপিএনের স্প্যানিশ ফুটবল প্রতিনিধি সিড লো, ইএসপিএনের রিয়াল মাদ্রিদবিষয়ক প্রতিনিধি আলেক্স কার্কল্যান্ডসহ কয়েকজন বিখ্যাত সাংবাদিককে নিয়ে গড়া ‘দ্য স্প্যানিশ ফুটবল পডকাস্ট’ নামে টুইটার অ্যাকাউন্টটি লিখেছে, ‘এর চেয়ে অর্থহীন, অন্তঃসারশূন্য শব্দ-সালাদ আর হতে পারে না!’ যেন ঢোলের দুদিকেই বাড়ি দিয়েছে বার্সা। সুপার লিগ থেকে সরে গেছে, এমনটা সরাসরি বলেনি। বরং সব সিদ্ধান্ত ক্লাবের সোশিও বা নিবন্ধিত সদস্যরাই নেবেন জানিয়েও যদি-কিন্তুর আড়ালে বারবার সুপার লিগের ‘গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা’ বুঝিয়ে দিয়েছে!

বার্সেলোনার বিবৃতির প্রথম ভাগে লেখা হয়েছে, ‘বর্তমান আর্থসামাজিক পরিবেশ চিন্তা করে ইউরোপিয়ান শীর্ষ অন্য সব দলের মতো বার্সেলোনাও বিশ্বাস করে, বিশ্ব ফুটবলকে টিকিয়ে রাখতে চাইলে ও আর্থিক সুস্থিতি দিতে চাইলে বর্তমান কাঠামো বদলাতে হবে। এর পাশাপাশি সারা বিশ্বের ভক্তদের খেলা দেখার অভিজ্ঞতাটা আরও উন্নত করতে হবে। এর মাধ্যমে ভক্তদের বর্তমান সংখ্যা তো ধরে রাখতেই হবে, ভবিষ্যতে ভক্তের সংখ্যা আরও বাড়াতেও হবে। কারণ, ভক্তরাই এ খেলার মূল শক্তি, তাঁরাই একে টিকিয়ে রেখেছেন।’

‘এই প্রেক্ষাপটে, বার্সেলোনার পরিচালকেরা জরুরি ভিত্তিতে সুপার লিগ প্রকল্পের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হওয়ার প্রস্তাবে রাজি হয়েছেন। এ প্রতিযোগিতা সমর্থকদের খেলা দেখার অভিজ্ঞতা আরও সুন্দর করবে, আকর্ষণ বাড়াবে। সে সঙ্গে বার্সেলোনার সবচেয়ে অবিচ্ছেদ্য মূলনীতিও মানছে এ লিগ, আর তা হলো গোটা ফুটবল পরিবারের সঙ্গে একাত্ম থাকার নতুন পথ খোঁজা।’

‘আমাদের মনে হয়েছে এ প্রকল্পের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া হবে একটি ঐতিহাসিক ভুল। সেটা করতে চাইনি বলেই আমরা প্রস্তাবে রাজি হয়েছি। বিশ্বের শীর্ষ ক্লাবগুলোর একটি হিসেবে আমরা সব সময় সব উদ্যোগের সামনের সারিতে থাকতে চাই। কারণ, ক্লাবের পরিচয়, এর খেলা, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্রের অংশ এটি।’

‘তবে বার্সেলোনা সব সময় ক্লাবের প্রতিটি সদস্যের ছিল এবং সব সময় প্রতিটি সদস্যের মালিকানাধীন থাকবে। এত গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত অনুমোদনের সিদ্ধান্ত তাদের হাতেই থাকবে। যে সিদ্ধান্ত নিবিড় ও সতর্ক পর্যবেক্ষণের পরই সোশিওরা (ক্লাবের নিবন্ধিত সদস্য) নেবেন।’

তাঁরা ১২জন।
ছবি: এএফপি

এটা যদি হয় বিবৃতির প্রথম ভাগ, বার্সেলোনার বিবৃতির মূল উদ্দেশ্য টের পাওয়া গেছে দ্বিতীয় ভাগে। সেখানেই ইনিয়ে-বিনিয়ে কেন সুপার লিগে তারা যোগ দিয়েছিল, সেটা জানানোর সঙ্গে সঙ্গে বারবার সোশিওদের (বার্সেলোনা ক্লাবের সদস্যরা) কেন এ লিগের পক্ষে থাকা উচিত, সেটা বোঝানোর চেষ্টা করেছে।

সে উদ্দেশ্যে তারা বিবৃতির ভাষা যতটা সম্ভব জটিল করেছে এবং আইনি ভাষায় লেখা সে অংশে বারবার ‘যদি এমনটা হয় তবে ওটা হবে’ জানিয়ে আশ্বস্ত করা হয়েছে সমর্থকদের। আবার এরপরই ‘কিন্তু’ দিয়ে শুরু বাক্যে ‘আমাদের এটাও ভাবা দরকার’ বলে বার্সেলোনার সদস্যদের কাছে সুপার লিগ কেন দরকার, কেন অন্যদের কথা শুনে এখনই এটিকে বাতিলের খাতায় ফেলা উচিত নয়, সেটা বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে।

বার্সেলোনার বিবৃতির দ্বিতীয় ভাগে লেখা আছে, ‘বিভিন্ন মাধ্যমে এ প্রকল্প নিয়ে মানুষের মাঝে যে প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে, তাতে কেন এমন প্রতিক্রিয়া এসেছে, সেটা নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ প্রয়োজন; এটা বার্সেলোনারও উপলব্ধি হচ্ছে। এবং বিশ্ব ফুটবলের সামগ্রিক ভালোর জন্য প্রাথমিক প্রস্তাবের কোনো অংশে যদি পরিবর্তন আনার প্রয়োজন হয়, সে সমস্যাও দূর করার কথা ভাবা দরকার। এমন গভীর পর্যবেক্ষণের জন্য সময় ও সংযম দরকার যেন তাড়াহুড়া করে কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত না নেওয়া হয়।’

‘সুপার লিগ প্রকল্পের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে আমাদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আদালতের কাছ থেকে যে জরুরি আইনি নিরাপত্তা নেওয়া হয়েছে, এটাও জানিয়ে রাখা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। তাই বার্সেলোনা মনে করে, অযৌক্তিক চাপ ও ভয়ের মধ্যে থেকে এ ব্যাপারে চিন্তা করা ও সিদ্ধান্ত নেওয়া ভুল হবে।’

‘এ ব্যাপারে (সুপার লিগ) যে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে এবং যে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, বার্সেলোনা সেটি বুঝতে পারছে। বার্সেলোনা সব সময় বিচক্ষণতা দেখিয়েই কাজ করবে। কারণ, বার্সেলোনা সব সময় স্বচ্ছতা বজায় রেখে কাজ করার গুরুত্বটা বোঝে। বার্সেলোনা এটাই চাইছে যে ক্লাবের সব সমর্থক ও সাধারণ মানুষ এটা (ক্লাবের বর্তমান অবস্থা ও নেওয়া ব্যবস্থা) বুঝবে, সম্মান করবে এবং সবচেয়ে বড় কথা ধৈর্য ধরবে।’

টুইটারে স্প্যানিশ ফুটবল–সংশ্লিষ্টরা যে বার্সেলোনার এ বিবৃতিকে ‘শব্দ-সালাদ’ বলছে, তাতে আর বিস্ময় কী!