যে ইংলিশ বদলে দিয়েছেন স্প্যানিশ ফুটবলকে
বিলবাওতে পা রেখেছেন, ১০০ বছর হয়ে গেল। কিন্তু অ্যাথলেটিক বিলবাওয়ের কোনো সমর্থকের কাছে ফ্রেড পেন্টল্যান্ড নামটি উচ্চারণ করে দেখুন। এখনো সবাই ভালোবেসে তাঁকে নিয়ে কথা বলতে এগিয়ে আসবে।
‘এল বম্বিন’—এর আগেও ইংলিশ কোচ স্পেনের ফুটবলে হাজির হয়েছেন। বিলবাওতেই তাঁর আগেও দেখা গেছে দ্বীপরাষ্ট্রের ফুটবল ফেরিওয়ালাদের। কিন্তু বিলবাওর ইতিহাসে প্রথম ছাপ ফেলে গেছেন পেন্টল্যান্ড। এমনকি স্প্যানিশ ফুটবলও তাদের ফুটবল বিবর্তনের জন্য তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ।
বিলবাওতে দুই দফা কোচ হিসেবে ছিলেন পেন্টল্যান্ড। ১৯২৩ সালে বিলবাওকে কোপা দেল রে জিতিয়েছেন। এরপর আতলেতিকো মাদ্রিদের দুই দফা কোচ ছিলেন, মাঝে গিয়েছিলেন রিয়াল ওভিয়েদোতে। কিন্তু ১৯২৯ সালে আবার বিলবাওতে ফিরিয়েই দেখিয়েছেন সেরা সাফল্য। ১৯৩০ ও ১৯৩১ সালে লা লিগা ও কোপা দেল রের ডাবল জিতিয়েছেন। ১৯৩০ থেকে ১৯৩৩—টানা চার বছর কোপা দেল রে জিতিয়েছেন। বার্সেলোনাকে তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পরাজয় ১২-১ ব্যবধানের হারের সে ম্যাচেও বিলবাওর কোচের দায়িত্বে ছিলেন পেন্টল্যান্ড।
শুধু সাফল্য এনে দেননি; স্প্যানিশ ফুটবলে ছোট ছোট পাসে খেলা, আক্রমণাত্মক ফুটবল, বল দখলে রাখার যে মানসিকতা এনেছিলেন, সেটা অন্য বড় ক্লাবগুলোও অনুসরণ করতে শুরু করেছিল। বর্তমানেও স্প্যানিশ ফুটবলে মূলমন্ত্র পেন্টল্যান্ডের সেই ফুটবল। অ্যাথলেটিকের জাদুঘরের পরিচালক আসিয়ের আরাতের মতে, ‘ফ্রেড পেন্টল্যান্ড এমন একজন, যিনি সময়কে হারাতে পেরেছেন।’
উলভারহ্যাম্পটনে জন্ম নেওয়া পেন্টল্যান্ড খেলোয়াড়ি জীবনে সবচেয়ে বেশি সাফল্য পেয়েছেন ব্ল্যাকবার্ন ও মিডলবরোতে। ইংল্যান্ডের হয়েও পাঁচ ম্যাচ খেলেছেন এই উইঙ্গার। ১৯১৪ সালে জার্মানির অলিম্পিক ফুটবল দলের দায়িত্ব নেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়টায় বার্লিনে যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করে পার করেছেন। এরপর যুদ্ধ শেষে ১৯২০ অলিম্পিকে ফ্রান্স দলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন।
অলিম্পিকের পর তাঁর স্প্যানিশ ফুটবলে আবির্ভাব। শুরুটা রেসিং সান্তান্দারে। কিন্তু এক বছর পরই তাঁর কাজে মুগ্ধ বিলবাও টেনে নিয়ে যায় তাঁকে। বিবিসিকে বলছিলেন আরাতে, ‘অ্যাথলেটিক তাঁর জন্য খুব ভালো প্রস্তাব দিয়েছিল। তারা ভালো এক কোচে বিনিয়োগ করতে চেয়েছিল। তখনো খুব অপেশাদার ঘরানার ছিল, তাই আমরা বিখ্যাত এক কোচ খুঁজছিলাম। তিনি অনুশীলনে শৃঙ্খলা এনেছেন এবং পেশাদার, পরিশীলিত খেলার ভিত্তি গড়েছেন।’
খুঁতখুঁতে স্বভাবের জন্য বিখ্যাত ছিলেন পেন্টল্যান্ড। একটি গল্প আছে, নিজের প্রথম অনুশীলনে খেলোয়াড়দের ঠিকভাবে জুতার ফিতা বাঁধতে শিখিয়েছেন তিনি। তবে এমন কড়া মানুষটাকেও পছন্দ করতেন প্রতিটি খেলোয়াড়, ‘যুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের মানুষকে সামলানোর অভিজ্ঞতা হওয়ার পর যখন বিলবাওয়ে এলেন, তখন তাঁর মধ্যে ওই মানবিক ব্যাপারটা ছিল। তাঁর ব্যক্তিত্বটা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক ছিল। খুবই আশাবাদী মানুষ এবং বুদ্ধিমান। কয়েক মাসের মধ্যেই ক্রীড়া সাময়িকীতে তিনি লেখা শুরু করেছিলেন, কীভাবে দলগুলোর খেলা উচিত।’
সে সময়টায় ফুটবল ছিল একমুখী। বল দৌড়ে প্রতিপক্ষে রক্ষণে ঢুকে শট নেওয়াটাই ছিল সবার লক্ষ্য। পেন্টল্যান্ড তাঁর খেলোয়াড়দের একটু ভিন্ন কিছু করার ব্যাপারে উৎসাহিত করতেন। খেলোয়াড়দের পাস দিয়ে খেলতে বলতেন। লন্ডনের অ্যাথলেটিক বিলবাও–সমর্থক গোষ্ঠীদের সংস্থা মিস্টার পেন্টল্যান্ড ক্লাবের সভাপতি গাইৎসকা আতসা কিংবদন্তির দর্শন সম্পর্কে বলেছেন, ‘তখন ২-৩-৫ ফরমেশনই বেশি দেখা যেত, পাঁচ স্ট্রাইকার থাকত। মিস্টার পেন্টল্যান্ড সেটা বদলে মাঝমাঠে লোক বাড়ালেন, এবং প্রতিপক্ষের মতো স্বল্প সময়ে সাফল্যের চেয়ে বল দখলে রাখাকেই গুরুত্ব দিতেন। আমি জানি না ১০ থেকে ২০ বছর আগে বার্সেলোনা যে টিকিটাকা দেখিয়েছে, তার সঙ্গে এটা মেলানো যায় কি না।’
পেন্টল্যান্ড আর যা করেছেন, তা হলো ক্লাবের প্রতি সমর্থকদের আস্থা বাড়ানো, ‘আমরা ক্লাব হিসেবে কী করছি, সেটায় বিশ্বাস এনেছেন। এর ওপরই আমরা সাফল্য পেয়েছি, জেতার মানসিকতা পেয়েছি। তাঁর সৃষ্টি করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এটি।’
ওই যুগে ক্লাবে পেশাদারি মনোভাব আনার চেষ্টা করেছিলেন পেন্টল্যান্ড। স্পেনে অধিকাংশ ক্লাবই তখন অপেশাদার ছিল। পেন্টল্যান্ড ক্লাবের কর্মকর্তাদের বলতেন, যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান, তবে খেলোয়াড়দের বেতন বাড়াতেই হবে। ১৯২৫ সালে বিলবাওকে ছেড়ে যান। ওই সময়ে আতলেতিকো ও ওভিয়েদোর কোচিং করিয়েছেন। স্পেন দলের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। ১৯২৯ সালে ব্রিটেনের বাইরের প্রথম দল হিসেবে ইংল্যান্ডকে হারিয়েছিল স্পেন। সে দলের সঙ্গেও ছিলেন পেন্টল্যান্ড।
এরপরই আবার বিলবাওতে ফেরেন এবং শত শত হ্যাট হারানোর ব্যবস্থা করেন। গল্প শোনা যায়, প্রতিটি জয়ের পর এই উত্তেজিত কোচ নিজের হ্যাটের ওপর লাফাতেন! আতসা বলছিলেন, ‘এখানে সবাই জানেন, অ্যাথলেটিক শুরুতেই এত দুর্দান্ত এ দল হয়েছিল ব্রিটিশ প্রভাবেই। খুবই দৃঢ় এই সম্পর্ক—আর্থিক সম্পর্ক, শিল্পবিপ্লব, খনিশিল্প, জাহাজশিল্প। এটা একটা বন্দর নগরী। মিস্টার পেন্টল্যান্ড হলেন বোলার হ্যাট, ছাতা ও সিগার মুখের গৎবাঁধা ইংলিশ ভদ্রলোক। সবাই বলবেন তিনি উষ্ণ চরিত্রের মানুষ ছিলেন, খুব মিশুক। রাস্তায় দেখা হলে সমর্থকদের “হ্যালো” বলতেন, চাইলেই তাঁর সঙ্গে কথা বলা যেত।’
বিলবাওতেই কেন এত সাফল্য, সে প্রসঙ্গে আতসার ব্যাখ্যা, ‘এখানকার মানুষের সঙ্গে ওনার জমেছে, কারণ আমরাও সময়টা উপভোগ করতে পছন্দ করি। আমরা খেতে ভালোবাসি, পান করতে ভালোবাসি এবং আমার ধারণা, এখানেই তিনি তাঁর প্রাণ খুঁজে পেয়েছেন।’
বিলবাওকে টানা চার কোপা দেল রে জিতিয়েই বিদায় নিয়েছেন পেন্টল্যান্ড। এর পেছনে অবশ্য স্পেনের গৃহযুদ্ধের দায় আছে। তাঁর তৈরি করা দল ১৯৩৪ ও ১৯৩৬ সালের লা লিগা জিতেছে। এ কারণেই তো ‘রাস্তায় তাঁর নাম শুনলেই সবাই জানে এমন একজনের কথা হচ্ছে, যিনি বোলার হ্যাট পরেন এবং মুখে সিগার থাকে। এই কিংবদন্তিতুল্য অবস্থান এখনো ধরে রেখেছেন তিনি।’
(বিবিসি অবলম্বনে)