যে ৬ কারণে মেসি আর বার্সার লিগ–স্বপ্ন রং হারিয়েছে

মেসিদের লিগ জেতার স্বপ্ন এখন ফিকে।ছবি: রয়টার্স

নিজেদের শিরোপা–স্বপ্ন উজ্জ্বল রাখতে বার্সেলোনাকে জিততেই হবে, কিন্তু বার্সেলোনা জিততে পারেনি; মৌসুমে আরও অনেকবারের মতো কালও একই চিত্র দেখিয়ে শেষ হলো বার্সেলোনা-আতলেতিকো মাদ্রিদ ম্যাচ। এই মৌসুমে এমন কিছু দেখতে দেখতে হয়তো একটু বেশিই হতাশ কাতালান ক্লাবটির সমর্থকেরা।

লিগ শিরোপার দৌড়ে এগিয়ে যাওয়ার বেশ কিছু সুযোগ পেয়েও সেটা নিতে পারেননি লিওনেল মেসি, আঁতোয়ান গ্রিজমান, ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ংরা। যেমনটা পারেননি গতকাল নিজেদের মাঠে আতলেতিকোর বিপক্ষে। করেছে গোলশূন্য ড্র।

বার্সেলোনা জিতলেই যে লিগের শিরোপাদৌড়ে একেবারে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যেত, এমন নয়। বরং বার্সা জিতলে রিয়াল মাদ্রিদের সুবিধা বেশি হতো। কিন্তু জিতলে অন্তত এ সুবিধা রোনাল্ড কোমানের বার্সার হতো যে তখন আতলেতিকো মাদ্রিদ কী করছে, সেটা না ভাবলেও চলত। মেসিদের তখন শুধু নিজেদের বাকি ৩ ম্যাচ জিততে হতো আর অপেক্ষা করতে হতো রিয়াল মাদ্রিদের পা হড়কানোর।

না জেতায় এখন যে বার্সার শিরোপা–স্বপ্ন একেবারে বিলীন হয়ে গেছে, তা-ও নয়। এখনো রিয়াল মাদ্রিদেরই হাতে লিগের নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু এখন বার্সার জন্য বাড়তি ভাবনার ব্যাপার এই যে নিজেদের সব ম্যাচ জেতার পাশাপাশি রিয়াল মাদ্রিদের হোঁচট তো প্রার্থনা করতেই হবে, পাশাপাশি চাইতে হবে আতলেতিকোও যাতে পা হড়কায়!

প্যাঁচ লাগছে? আচ্ছা, আগে পয়েন্ট তালিকার হিসাবটা বলে দেওয়া যাক। এই মুহূর্তে ৩৫ ম্যাচে ৭৭ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষে আতলেতিকো, সমান ম্যাচে ৭৫ পয়েন্ট নিয়ে ২ নম্বরে বার্সেলোনা। আজ বাংলাদেশ সময় রাত ১টায় পয়েন্ট তালিকায় ৪ নম্বরে থাকা সেভিয়ার (৩৪ ম্যাচে ৭০ পয়েন্ট) বিপক্ষে নামবে রিয়াল মাদ্রিদ, তার আগে ৩৪ ম্যাচে ৭৪ পয়েন্ট নিয়ে রামোস-হ্যাজার্ডরা আছেন তালিকার ৩ নম্বরে।

সেভিয়াকে আজ রিয়াল মাদ্রিদ হারালেই তাদের পয়েন্ট হয়ে যাবে আতলেতিকোর সমান। কিন্তু রিয়ালের সুবিধা হলো, লিগে এবার আতলেতিকো আর বার্সা—দুই দলের বিপক্ষেই মুখোমুখি লড়াইয়ে এগিয়ে আছে তারা। স্প্যানিশ লিগে দুই দলের পয়েন্ট সমান হলে মুখোমুখি লড়াইয়ের ফলই ব্যবধান গড়ে দেয় কিনা!

সব মিলিয়ে হিসাবটা এই, লিগের শিরোপাদৌড়ে বার্সার এখন আর নিয়ন্ত্রণ নেই। কেন এ অবস্থায় এসেছে বার্সা, মৌসুমের ফেলে আসা পথে চোখ ফিরিয়ে সেটির ছয়টি কারণ বের করেছে মাদ্রিদভিত্তিক স্প্যানিশ দৈনিক মার্কা।

ভুলে যাওয়ার মতো প্রথম রাউন্ড

কাতালানদের জন্য লিগের প্রথম রাউন্ড ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। বিশেষ করে ডিসেম্বর পর্যন্ত লিগের প্রথম ১৫ ম্যাচ! ওই ১৫ ম্যাচের মধ্যে ৪টিতে হেরেছে বার্সা, ড্র করেছে আরও ৪টি। ওই চার হারের দুটি আবার হেতাফে আর কাদিজের মতো অপেক্ষাকৃত দুর্বল দলের বিপক্ষে। চার ড্রয়ের দুটি আলাভেস আর এইবারের বিপক্ষে। এখন এসে ওই ম্যাচগুলো হয়তো বার্সার হতাশা আরও বাড়াচ্ছে।

লিগে গুরুত্বপূর্ণ সব অবস্থায় গিয়ে পয়েন্ট হারিয়েছে বার্সা।
ছবি: রয়টার্স

বড় দলকে হারাতে না পারা

মৌসুমজুড়ে বার্সার বড় দুর্বলতা হয়ে ছিল এটি। কি লিগ কি চ্যাম্পিয়নস লিগ...বার্সা এই মৌসুমে বড় দল বলতে শুধু চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপ পর্বে জুভেন্টাসকে হারিয়েছে তাদের মাঠে। তা-ও সে ম্যাচে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে পায়নি জুভ। এর বাইরে চ্যাম্পিয়নস লিগে তো বড় দলকে সেভাবে হারাতেই পারেনি, লিগেও বড় দলের বিপক্ষে বারবার হতাশ হয়েছে বার্সা। রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে লিগে দুই ম্যাচেই হেরেছে, পরশুর ড্রয়ের আগে আতলেতিকোর বিপক্ষে লিগে প্রথম দেখায়ও হেরেছিল। ‘বড়’ দলের মধ্যে লিগে শুধু সেভিয়াকেই হারিয়েছেন মেসিরা!

গ্রানাদার ধাক্কা

বার্সার কোনো ভক্তকে যদি এখন টাইম মেশিনে চড়ে অতীতে ফিরে এই মৌসুমের কোনো ম্যাচের ফল বদলে দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়, তিনি হয়তো বেশি দূর যাবেন না, গত ২৯ এপ্রিল নিজেদের মাঠে গ্রানাদার কাছে ২-১ গোলের হারটাকেই বদলে দিতে চাইবেন। লিগে ৩৩তম ওই ম্যাচের আগে বার্সার সমীকরণ ছিল, জিতলেই লিগের শীর্ষে উঠে যাবে তারা, তখন রিয়াল মাদ্রিদ বা আতলেতিকো কী করছে না করছে, সেদিকে তাকাতেই হতো না। কিন্তু মেসির গোলে এগিয়ে গিয়েও সেদিন শেষ পর্যন্ত হেরে গিয়ে নিজেদের পায়ে কুড়াল মেরেছে বার্সা।

গ্রানাদার কাছে হারটা বড় ধাক্কা হয়ে এসেছে বার্সার জন্য।
ছবি: রয়টার্স

চড়া দামের ভুল

মৌসুমজুড়ে বার্সার নড়বড়ে রক্ষণ বার্সাকে ডুবিয়েছে। পিকে-আলবা মৌসুমের শুরুতে বার্সার ‘দায়’ হয়ে ছিলেন। পিকে তো অনেকটা সময় চোটেই কাটিয়েছেন। তাঁর জায়গায় তরুণ মিঙ্গেসা-আরাউহোদের খেলাতে হয়েছে। রাইটব্যাক জায়গা নিয়ে তো এখনো বার্সাকে ভুগতে হয়, বলতে গেলে দানি আলভেজের বিদায়ের পর থেকে গত কয়েক মৌসুমেই এই জায়গা নিয়ে ভুগেছে বার্সা!

গোলকিপার মার্ক আন্দ্রে টের স্টেগেন অনেক ম্যাচে বার্সাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন বটে, কিন্তু বেশ কিছু ভুলও করেছেন। বছরের শুরুর দিকে কোমান দলকে ৩-৫-২ ছকে খেলানো শুরু করার পর থেকে রক্ষণ কিছুটা শক্তিশালী হয়েছে, মাঝমাঠে সের্হিও বুসকেতসও নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন, কিন্তু চোখে পড়ার মতো ভুল এখনো করে বার্সার রক্ষণ, গোলও খায়।

খোলসবন্দী, ভিতু ফুটবল

নির্ভীক, বল দখলে রেখে আক্রমণের উল্লাসে মেতে ওঠা ফুটবল...গত এক দশকে বার্সার পরিচয় এমনই। কিন্তু আর্নেস্তো ভালভার্দে কোচ হয়ে আসার পর থেকে সেটি আস্তে আস্তে কমতে শুরু করেছে, অন্যদিকে দল হিসেবেও ক্রমেই আরও ভারসাম্যহীন হয়ে উঠেছে বার্সা। যে কারণে এখন বার্সাকে অনেক সময়ই ধীরগতির, ভয়ে জর্জর ফুটবল খেলতে দেখা যায়। নিজেদের মাঠে কাল জিততেই হবে, এমন সমীকরণের ম্যাচে আতলেতিকোর বিপক্ষেও তো বার্সার ফুটবল মাঝেমধ্যে সুন্দর হলেও অনেকটা সময়ই ছিল খোলসবন্দী।

সুয়ারেজের মতো স্ট্রাইকারের অভাব পূরণ করতে পারেনি বার্সা।
ছবি: রয়টার্স

স্ট্রাইকারের অভাব

বিশ্বমানের একজন ‘নাম্বার নাইন’ না থাকলে কী হয়, তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে বার্সা। আগামী জুনে ৩৪-এ পা দিতে যাওয়া মেসি এখনো বার্সার গোল করা আর আক্রমণ গড়ে দেওয়ার বড়, বেশির ভাগ সময়ে একমাত্র ভরসা। এর বাইরে গ্রিজমান-দেম্বেলে মাঝেমধ্যে যোগ দেন গোল করার কাজে, কিন্তু দুজনের কেউই প্রথাগত স্ট্রাইকার নন। এই মৌসুমেই আতলেতিকোর কাছে বেচে দেওয়া লুইস সুয়ারেজের অভাব পূরণে ব্যর্থ বার্সা।

বিশ্বমানের খেলোয়াড়ের অভাব

সের্হিও বুসকেতস কাল প্রথমার্ধে চোট নিয়ে মাঠ ছাড়ার পর বার্সা বদলি হিসেবে নামিয়েছে ১৮ বছরের ইলাইশ মরিবাকে। তাতে বার্সার মাঝমাঠের গড় বয়স হলো ১৯! ডি ইয়ং, পেদ্রি ও মরিবাকে ঘিরে ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনতে পারেন বার্সা সমর্থকেরা, কিন্তু বর্তমানে শিরোপার লড়াইয়ের ভাগ্য গড়ে দেওয়া ম্যাচে আতলেতিকোর বিপক্ষে লড়াই করার মতো মাঝমাঠ এটি নয়। রিকি পুচের ওপর কোমানের ভরসা নেই; পিয়ানিচকে তো জোসেপ মারিয়া বার্তোমেউর বোর্ড বার্সাতে এনেছিলই মাঠের চেয়ে বেশি করে ব্যালান্স শিটের ফাঁক ঢাকতে। বার্সার হয়ে রক্ষণ-মাঝমাঠ মাতানোর মতো বড় তারকা তাই এখন নেই।