যেভাবে আর্সেনালকে নিজের খাঁচায় বন্দী করলেন মরিনিও

মরিনিওর সঙ্গে কৌশলে হেরে গেছেন আরতেতা।ছবি: রয়টার্স ও এএফপি

ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে জোসে মরিনিওর জাদু চলছেই। সেই জাদুতেই গতকাল মন্ত্রমুগ্ধের মতো বিবশ হয়ে গেলেন আর্সেনালের কোচ মিকেল আরতেতা। মরিনিওর উদ্যমী টটেনহামের সামনে চুপচাপ বিজয়ের গালিচা পেতে দিল আরতেতার আর্সেনাল। আর তাতে গোটা ৩ পয়েন্ট নিয়ে মাঠ ছেড়েছেন হ্যারি কেইন, হিউং মিন সনরা।

বছরের পর বছর ফুটবলে অনেক কিছু বদলালেও জোসে মরিনিওর কোচিং স্টাইলের মধ্যে বিশেষ পরিবর্তন আসেনি। যে স্টাইলে তিনি চেলসি, রিয়াল মাদ্রিদ, ইন্টার মিলান ও পোর্তোর মতো ক্লাবে সফল হয়েছেন, ব্যর্থ হয়েছেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে—একই ঘরানার ফুটবল এবার নিয়ে এসেছে টটেনহাম। নিজেদের রক্ষণভাগ একদম নিশ্ছিদ্র বানিয়ে পরে দ্রুত প্রতি-আক্রমণে উঠে গোল করে এসো, প্রথমে গোল পেয়ে গেলে ম্যাচের বাকি সময় নিজেদের অগ্রগামিতা বজায় রাখার জন্য খেটে যাও—মোটা দাগে মরিনিওর খেলানোর ধরনটা এমনই।

তাঁর পাঁড় ভক্তও বলবেন না, কোচ হিসেবে মরিনিও ক্রুইফ, গার্দিওলা, ক্লপ কিংবা বিয়েলসাদের মতো খুব বেশি সৃষ্টিশীল। বরং মরিনিওকে কোচ হিসেবে প্রতিক্রিয়াশীল বলা চলে। প্রতিক্রিয়াশীল কোচদের ঘরানার নেতা বললেও ভুল বলা হবে না তাঁকে। প্রতিপক্ষ ম্যানেজার মাঠে ৯০ মিনিটের লড়াইয়ে নিজেদের খেলাটা যেন ঠিকঠাক না খেলতে পারেন, মরিনিওর নজর থাকে মূলত ওদিকেই। গতকাল আরতেতার আর্সেনালকে হারানোর পেছনেও ঠিক এই কৌশলই কাজে লেগেছে। বলা ভালো, আরতেতা নিজেই যেন মরিনিওকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, ‘এসো, নিজের পরিকল্পনামতো খেলে যাও!’

কিন্তু কীভাবে? মরিনিওর আদর্শ দলের মতো এই টটেনহামও জমাট রক্ষণ ও দ্রুত প্রতি–আক্রমণে বিশ্বাসী। এরিক ডায়ার ও টোবি অল্ডারভেইরেল্ড দুর্দান্তভাবে রক্ষণ করে যাচ্ছেন, তাঁদের গতির অভাব পুষিয়ে দিচ্ছেন রক্ষণভাগের বাকি দুজন—রাইটব্যাক সার্জ অরিয়ের ও লেফটব্যাক সের্হিও রেগিলন। সেন্টারব্যাকের সঙ্গে ফুলব্যাকের মাঝের ফাঁকা জায়গাটায় (হাফ স্পেস) যেন প্রতিপক্ষ আক্রমণ না করতে পারে, সে জন্য দলের দুই সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার পিয়েরে এমিল হইবিয়া ও মুসা সিসোকো নেমে যাচ্ছেন বিপদ দেখলেই। ম্যানচেস্টার সিটির বিরুদ্ধে ম্যাচটায় এই কৌশলের সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন মরিনিও।

মরিনিও বেশ ভালোই জানতেন, বলের অতিরিক্ত দখল নেওয়ার পাশাপাশি সিটি গোল পাওয়ার জন্য আরেকটা কাজ করতে চাইবে। সেটা হলো টটেনহামের ডি-বক্সের ঠিক বাইরে ‘হাফ স্পেস’গুলোয় ছোট ছোট পাসের মাধ্যমে আক্রমণ গড়ে তুলে প্রতিপক্ষ রক্ষণে চিড় ধরাবে। যে কাজ করতে কেভিন ডি ব্রুইনা, বের্নার্দো সিলভা, রিয়াদ মাহরেজরা সিদ্ধহস্ত। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, হাফ স্পেস আবার কোন জায়গা? একজন সেন্টারব্যাক ও তাঁর দিকে থাকা ফুলব্যাকের মাঝের জায়গাটুকুই হাফ স্পেস। অর্থাৎ রাইটব্যাকের (এই ম্যাচে সার্জ অরিয়ের) সঙ্গে ডান দিকের সেন্টারব্যাক (এই ম্যাচে টবি অল্ডারভেইরেল্ড), লেফটব্যাকের (সের্হিও রেগিলন) সঙ্গে বাঁ দিকের সেন্টারব্যাকের (এরিক ডায়ার) মাঝের জায়গাটা।

গত রাতেও একই কাজ করেছে টটেনহাম। মরিনিওর এই কৌশলের ফলে মাঠের মাঝখানটা একদম জমাট হয়ে যায়। ফলে প্রতিপক্ষ দলের ক্রস করা ছাড়া তেমন উপায় থাকে না। আর উড়ে আসা ক্রসগুলো সামলানোর জন্য নিজেদের ডি-বক্সে টটেনহামের দুই সেন্টারব্যাক ডায়ার আর অল্ডারভেইরেল্ড তো থাকেনই, উল্টো দীর্ঘদেহী হইবিয়া আর সিসোকোকেও দেখা যায়। ফলে ক্রস করেও লাভ হয় না। মরিনিওর এই কৌশল নিষ্ক্রিয় করার জন্য এমন কিছু করতে হতো, যাতে মাঝখানটা অত ভালোভাবে জমাট রাখতে না পারে মরিনিও। কিন্তু কিসের কী!

কেইন ও সনের (পেছনে) মতো দুর্দান্ত গতির পরিপূর্ণ ফরোয়ার্ড মরিনিওর প্রতি-আক্রমণনির্ভর ফুটবলের মূল অস্ত্র।
ছবি: এএফপি

আরতেতা কয়েক সপ্তাহ ধরেই দলকে ক্রসনির্ভর ফুটবল খেলাচ্ছেন। গত সপ্তাহে লিগ ম্যাচে উলভসের কাছে ২-১ গোলে হারা আর্সেনাল ৩৩ বার ক্রস ফেলার চেষ্টা করেছিল প্রতিপক্ষ ডি-বক্সে, লাভ হয়নি। এ ম্যাচেও তাই হলো। মরিনিও যেখানে মাঝমাঠ জমাট রেখে আক্ষরিক অর্থে আরতেতাকে আমন্ত্রণ জানালেন ক্রসনির্ভর ফুটবল খেলার জন্য, আরতেতাও সুবোধ বালকের মতো সেটাই করে গেলেন। গোটা ম্যাচে কিয়েরান টিয়েরনি, এক্তর বেয়েরিন, বুকায়ো সাকারা ক্রসের পর ক্রস দিয়ে গেলেন। ম্যাচ শেষে জানা গেল, একটি-দুটি নয়, ৪৪টা ক্রস দিয়েছেন আরতেতার শিষ্যরা। ক্রস দিয়ে যদি লাভ হতো, তা–ও হতো। এবার লিগে মাত্র ১৭ শতাংশ ক্রস সফল হয়েছে তাঁদের।

ক্রস সফলতার দিক দিয়ে তাঁদের চেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে লিগের আর মাত্র দুটি দল। গত মৌসুমে দলের অধিনায়ক পিয়েরে-এমেরিক অবামেয়াংকে বাঁ উইংয়ে খেলানো আরতেতা এবার প্রায় সময়েই খেলাচ্ছেন একক স্ট্রাইকার হিসেবে। তাঁকে মাঝখানে রেখে (কখনো আরেক স্ট্রাইকার আলেকসাঁদ্র লাকাজেতকে) বাকিদের ক্রস করতে বলছেন। লাকাজেত-অবামেয়াং মিলিয়ে গত দুই মৌসুমে হেড করে দশটাও গোল দিয়েছেন কি না, সন্দেহ। এমন অবস্থায় ক্রস করার কৌশলটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত, প্রশ্ন থেকেই যায়। যেন দিগ্‌বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে আর কোনো উপায় না পেয়ে একের পর এক ক্রস মেরে যাচ্ছিলেন আর্সেনাল তারকারা। মরিনিও তো এটাই চাচ্ছিলেন!

এভাবে একের পর এক ক্রস করেও ব্যর্থ হয়েছে আর্সেনাল।
ছবি: এএফপি

এমনকি আর্সেনাল যে দুটি গোল খেয়েছে, সে দুটিও এসেছে ক্রস-ব্যর্থতার হাত ধরেই। দুবারই ক্রস করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে বলের দখল হারিয়েছেন বেয়েরিন। সেখান থেকে দ্রুতগতির প্রতি–আক্রমণে বাকি কাজটা সেরেছেন সন আর কেইন। শুরুর দিকে সনের গোলে এগিয়ে যাওয়াটাও সুবিধা করে দিয়েছে মরিনিওকে। তিনি বাকি সময়টা মূলত মনোযোগ দিয়েছেন রক্ষণে। ম্যাচের অধিকাংশ সময়ে টটেনহামের তারকারা নিজেদের অর্ধেই ছিলেন, প্রেস করেননি মোটেও, আর্সেনাল তারকাদের পায়ে বলের দখল দিয়েই সন্তুষ্ট থেকেছেন। রক্ষণভাগের চারজনের সঙ্গে দুই সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার হইবিয়া আর সিসোকো তো ছদ্ম ডিফেন্ডারের কাজ করেছেনই, উইঙ্গার সন আর বের্গভেইনের খেলা দেখে মাঝেমধ্যে মনে হয়েছে, রেগিলন-অরিয়ের নয়, তাঁরাই বুঝি ফুলব্যাক!

মাঝমাঠ জমাট রেখে প্রতিপক্ষকে ক্রস করতে বাধ্য করা মরিনিওকে আরতেতা কীভাবে নিষ্ক্রিয় করেন, আগ্রহের বিষয় ছিল। আরতেতাই উল্টো মরিনিও নামের হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার ‘সুর’ শুনে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে কাটিয়ে দিলেন ৯০ মিনিট!