যেভাবে রিয়াল মাদ্রিদ হারাল বার্সেলোনাকে

রামোস ফিরেই জিতিয়েছেন দলকে।ছবি : রয়টার্স

ম্যাচের আগে রিয়াল কোচ জিনেদিন জিদানের ওপরই চাপটা বেশি ছিল। একে তো আগের সপ্তাহে কাদিজের মতো দলের বিপক্ষে লিগে হার, সে জ্বালা জুড়োতে না জুড়োতেই করোনায় জর্জরিত শাখতার দোনেৎস্কের কাছে চ্যাম্পিয়নস লিগে ৩-২ গোলে হার; জিদানের চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ে গেছে, অন্তত স্প্যানিশ মিডিয়ার খবর এমনই ছিল। ওদিকে আগের সপ্তাহে লিগে বার্সেলোনা হারলেও, ক্লাসিকোর ঠিক আগে চ্যাম্পিয়নস লিগে ফেরেনৎভারোসের বিপক্ষে নিজেদের শক্তিমত্তার জানান দিয়েছিল বার্সেলোনা। বার্তা দিয়ে রেখেছিল, রামোস-বেনজেমাদের নিজেদের মাঠে ভালোভাবেই মোকাবিলায় প্রস্তুত তারা। কিন্তু চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের মাঠে জিদান যে হারতে জানেন না একেবারেই!

রিয়ালের খেলোয়াড়দের অবস্থানটা অনেকটা এমনই ছিল।
নিজস্ব গ্রাফিকস

এর আগে ক্যাম্প ন্যু তে পাঁচ বার দলকে নিয়ে এসেছিলেন জিদান। দুই ম্যাচ জেতার পাশাপাশি ড্র করেছিলেন বাকি তিন ম্যাচে। এই ম্যাচেও অপরাজেয় থাকার ধারাটায় ছেদ পড়ল না। মেসিদের ৩-১ গোলে হারিয়ে রিয়াল জানিয়ে দিল, লিগ শিরোপা রক্ষার লড়াইয়ে এত আগে থেকে হাল ছাড়তে রাজি নয় তারা।

নিজেদের ছকে তেমন কোনো পরিবর্তনই আনেননি জিদান। ৪-৩-৩ ছকের প্রতিই বিশ্বস্ত থেকেছেন। প্রশ্ন ছিল, এই ছকে রামোস-ভারানদের পাশে খেলানোর মতো আদর্শ রাইটব্যাক কে? কারভাহাল-ওদ্রিওসোলার চোটে, জিদান ভরসা রাখলেন নাচো ফার্নান্দেজের ওপর। বাঁ দিকে মার্সেলোর রক্ষণকাজটা গত কয়েক মাস ধরেই ঠিকঠাক হচ্ছে না, ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবে জিদানেরও চোখ এড়ায়নি। ফলে এই ম্যাচে অভিজ্ঞ এই লেফটব্যাকের জায়গায় ফর্মে থাকা স্বদেশি ফারলাঁ মেন্দির ওপরেই আস্থা রেখেছিলেন তিনি। কি দুর্দান্তভাবেই না সেই আস্থার প্রতিদান দিলেন মেন্দি! মেন্দি-ভিনিসিয়ুসের সতর্ক নজরে বার্সার ডানদিকটা থাকল নিষ্ক্রিয়, ১৭ বছরের তরুণ পেদ্রি থাকলেন বাক্সবন্দী। পাশে রামোসকে পেয়ে ভারান নিজেও আগের ফর্ম ফেরত পেয়েছেন সামান্য হলেও। তবে এটা ঠিক যে সবমিলিয়ে রিয়াল রক্ষণ যে খুব মজবুত ছিল, ব্যাপারটা এমন নয়। বার্সেলোনা বেশ কয়েকবারই প্রতিপক্ষের রক্ষণের ফাঁক-ফোকর খুঁজে বের করতে পেরেছে। তবে এক গোল দেওয়া ছাড়া বার্সা রিয়াল-রক্ষণের দুর্বলতার ফায়দা তুলতে পেরেছে সামান্যই।

ওদিকে বার্সা বল পায়ে অনেকটা ৪-৪-২ রূপ নিচ্ছিল।
নিজস্ব গ্রাফিকস

রিয়াল ম্যাচটা মূলত জিতেছে মিডফিল্ডের লড়াইয়ে। ৪-৩-৩ ছকে রিয়ালের মিডফিল্ডে ছিলেন তিনজন। বল পায়ে মাঝে মধ্যে জাদুকরের মতো ঝলক দেখালেও বয়স হয়ে গেছে লুকা মদরিচের। আগের মতো গোটা মাঠ দৌড়ে খেলেন না তিনি। ফলে মদরিচের জায়গায় প্রাণশক্তিতে ভরপুর উরুগুইয়ান মিডফিল্ডার ফেদেরিকো ভালভার্দেকে নামান হলো। এর আগেও ক্লাসিকোতে মদরিচের জায়গায় ভালভার্দেকে খেলিয়েছিলেন জিদান, সুফলও পেয়েছিলেন হাতে হাতেই। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। ক্রুসের সঙ্গে মিলেমিশে ভালভার্দে মিডফিল্ডের দখল রাখলেন রিয়ালের হাতেই। সঙ্গে কাসেমিরো তো তাঁদের আগলে রাখার জন্য ছিলেনই।

মেসি খেটে খেলেছেন, লাভ হয়নি।
ছবি : রয়টার্স

বার্সা এমনিতেই তেমন প্রেস করে না, একটু-আধটু যা প্রেস করতে গিয়েছে, ক্ষিপ্রগতির ছোট ছোট পাসের সমন্বয়ে সে প্রেসিং অনায়াসে ভাঙতে পেরেছে রিয়ালের মিডফিল্ড। ওদিকে ক্রুস-ভালভার্দে-কাসেমিরোর কার্যকরী মিডফিল্ডের সামনে বার্সা মিডফিল্ডার বুসকেতস ও ডি ইয়ং তেমন কিছু করার সুযোগই পাননি। বিশেষ করে বুসকেতসের খেলা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে পৌঁছে গেছেন তিনি। ক্লাসিকো তো দূরের কথা যেকোনো ছোট দলের বিপক্ষেও প্রথম একাদশে বুসকেতসকে জায়গা দিতে কয়েকবার ভাবা উচিত কোচ কোমানের।

বার্সার ছক প্রশ্নবিদ্ধ ছিল না, এটা বলা যাবে না। তবে তাতে চমক ছিল। ১২ কোটি ইউরো দিয়ে খেলোয়াড় কিনে তাঁকে এমন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে যদি না খেলানো হয়, তাহলে তো সেটিকে চমকই বলতে হবে। হ্যাঁ, ফরাসি ফরোয়ার্ড আতোয়াঁন গ্রিজমানকে কাল খেলাননি কোচ কোমান। তাঁর জায়গায় ছিলেন ১৭ বছর বয়সী আনকোরা তরুণ পেদ্রি। সেই পেদ্রিই বোতলবন্দী হয়ে রইলের সারাক্ষণ।

রামোসকে এভাবে ফেলে দিয়ে পেনাল্টি হজম করেন লংলে।
ছবি : রয়টার্স

বার্সা নেমেছিল ৪-২-৩-১ ছকে। তবে মাঠে খেলা শুরুর পর বোঝা গেল, বল পায়ে সে ছকটা পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে ৪-৪-২ তে। সবার ওপর স্ট্রাইকার হিসেবে ফাতি, তাঁর একটু নিচে সহকারী স্ট্রাইকার হিসেবে লিওনেল মেসি। দুই সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার বুসকেতস-ডি ইয়ংয়ের দুপাশে পেদ্রি (ডানে) আর কুতিনিও (বাঁয়ে)। ডি-বক্সে ঢুকে চতুর স্ট্রাইকারের মতো ফাতির গোল করার প্রবণতা কিংবা মেসির প্রায়শই নিচে নেমে যাওয়ার স্বভাবের কথা চিন্তা করলে কৌশলটা অনেকটা এমন— খেলোয়াড়েরা নিজেদের দায়িত্ব ঠিকঠাক মতো পালন করলে সুফল পাবে বার্সা, নয়তো পাবে না। আর সেখানেই পিছিয়ে গেল বার্সা। প্রত্যাশা অনুযায়ী পারফর্ম করতে পারলেন না বুসকেতস। পাশে থাকা ডি ইয়ংয়ের অবস্থাও কমবেশি একই রকম। এত দিন সেন্ট্রাল মিডফিল্ডে দুই মিডফিল্ডারের একজন হয়ে ৪-২-৩-১ ছকে বেশ ভালো খেললেও রিয়ালের বিপক্ষে বড় এই ম্যাচটা ডি ইয়ংয়ের দুর্বলতা দেখিয়ে দিল। বুঝিয়ে দিল, একা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে খেললেই হয়তো ভালো করবেন তিনি, কারওর সঙ্গী হয়ে নয়, বিশেষ করে বুসকেতসের সঙ্গী হয়ে তো অবশ্যই নয়!

শেষ গোলটা করার পথে নেতোকে বোকা বানিয়েছেন মদরিচ।
ছবি : রয়টার্স

মিডফিল্ডে এই দুজনের বাজে খেলার সুফল পুরোদমে নিলেন ক্রুস-ভালভার্দে ও কাসেমিরো। ওদিকে বল পায়ে ছক ৪-৪-২ হয়ে যাওয়ার কারণে কুতিনিওর ভূমিকা হয়ে গেল সেন্ট্রাল অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার থেকে একদম লেফট মিডফিল্ডার কিংবা উইঙ্গারের, যে জায়গায় খেলতে তিনি তেমন স্বচ্ছন্দ নন। এ ম্যাচেও এই ব্রাজিল তারকা তেমন ঝলক দেখাতে পারেননি সে কারণেই। তবে যাকে ভালো খেলানোর জন্য ছকের এই হালকা পরিবর্তন, সেই ফাতি কিন্তু নিজের জাত ঠিকই চিনিয়েছেন। তরুণ এই তারকার কপাল খারাপ, তাঁর ভালো খেলার দাম দিতে পারেননি তাঁর সতীর্থরাই। কোমানও নিজের কপাল চাপড়াতে পারেন এই ভেবে, তাঁর পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়ন করার মতো পারফরম্যান্স যদি বুসকেতস-পিকেরা দিতে পারতেন!

কোমানের অধীনে আগের ম্যাচগুলো দেখে একটা বিষয় পরিষ্কার হওয়া গিয়েছিল, মেসির ওপর চাপ কমাতে চান এই ডাচ কোচ। ফলে মেসি মাঠের মধ্যে যেসব এলাকায় বিচরণ করেন, সেখান থেকে এই মৌসুমে তুলনামূলকভাবে কম আক্রমণ হচ্ছিল। বরং বাঁ দিকে থাকা লেফট ফরোয়ার্ড ফাতি, অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার কুতিনিও ও লেফটব্যাক আলবার রসায়ন আশাবাদী করছিল বার্সা সমর্থকদের। ডানদিকে আসেনসিও-নাচোদের পজিশনগত ভুলের সুবিধা নিয়ে সদর্পে ওপরে উঠে গিয়েছিলেন আলবা, সেখান থেকে ফাতিকে পাস— গোল। এর আগে, ভালভার্দের গোলে রিয়াল এগিয়ে গিয়েছিল ৫ মিনিটেই। আট মিনিটেই স্কোরলাইন ১-১। বাঁ দিক কে এভাবে ধারালো করতে গিয়ে ডান দিক প্রায়ই নিষ্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছে বার্সার। গ্রিজমান ওই জায়গায় খেলতে স্বচ্ছন্দ না, কাল তাঁর জায়গায় পেদ্রি নেমেও তেমন সুবিধা করতে পারলেন না।

ওদিকে রিয়ালের আক্রমণভাগ গোটা নব্বই মিনিট ধরে অসাধারণ খেলেনি ঠিক, তবে যে দুই-একটা সুযোগ পেয়েছে, কাজে লাগিয়েছে। পাঁচ মিনিটে ভালভার্দের গোলটার কথাই ধরুন। যে গোলে রিয়াল প্রথম ম্যাচে এগিয়ে গিয়েছিল। বেনজেমা স্বভাবজাত স্বতঃস্ফূর্ততায় নিচে নেমে এসেছেন, আকৃষ্ট করেছেন পিকে কে, তাঁর নিজের জায়গা থেকে সরে আসার জন্য। পিকের ফেলে আসা জায়গায় হুট করে চলে গিয়েছেন ভালভার্দে। ভালভার্দে পিকের পেছনে গিয়েই দেখেছেন, থালায় বাড়া সুখাদ্যের মতো বেনজেমার পাস ততক্ষণে প্রস্তুত পায়ের কাছে। ব্যস, ১-০ গোলে এগিয়ে রিয়াল!

তবে, ম্যাচ থেকে আনসু ফাতির পারফরম্যান্স ছাড়াও বার্সেলোনা সমর্থকদের আশাবাদী হওয়ার যে জিনিস একদমই নেই, বলা যাবে না। আয়াক্স থেকে বার্সায় যোগ দেওয়া পর এই প্রথম নিজের পছন্দের পজিশন - রাইটব্যাকে খেলতে পেরেছিলেন আমেরিকান ডিফেন্ডার সের্হিনিও দেস্ত। এসেই বাজিমাত। যেভাবে খেলেছেন, সেভাবে নিজের উন্নতি বজায় রাখতে পারলে বলাই যায়, দানি আলভেসের যোগ্য উত্তরসূরি পেয়ে গেছে বার্সা। ক্রমাগত আদর্শ রাইটব্যাকের মতো নব্বই মিনিট ধরে ওঠানামা করতে থাকা দেস্তের কারণেই মেসি নিশ্চিন্ত হয়ে প্রচুর সময় নিচে নেমে এসেছেন, ওপরে দাঁড়িয়ে না থেকে, খেলা গড়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। চেষ্টা করেছেন কাসেমিরো-ভালভার্দে-ক্রুস ত্রয়ীর দৌরাত্ম্যে বারবার মিডফিল্ডের দখল হারান বুসকেতস-ডি ইয়ংকে সাহায্য করতে।

শেষমেশ ‘রামোস ইমপ্যাক্ট’ এর কথা না বললেই নয়। কাদিজের বিপক্ষে দ্বিতীয়ার্ধে মাঠে ছিলেন না, ছিলেন না শাখতারের বিপক্ষে গোটা ম্যাচে। ফলে রিয়ালও খাবি খেয়েছে। অনুপ্রেরণাদায়ী অধিনায়কের ফেরার ম্যাচে রিয়ালের প্রত্যেক খেলোয়াড় যেন নিজেদের পারফরম্যান্সের পারদটা একটু করে চড়িয়ে দিলেন।

আর তাতেই ন্যু ক্যাম্প থেকে ৩-১ গোলের জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ল রিয়াল। আর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের মাঠে জিদানও থাকলেন অপরাজিত।