রামোসের মতো আর কাকে পাবে রিয়াল মাদ্রিদ

আর একজন রামোসকে পাবে রিয়াল?ফাইল ছবি

কিংবদন্তি আসলে কাকে বলে? সত্যিকারের কিংবদন্তির সংজ্ঞা কী! এ প্রশ্নগুলো সের্হিও রামোসের প্রসঙ্গে যে কারও মাথায় আসতে বাধ্য। খেলাধুলায় অনেক সময় এই ‘কিংবদন্তি’ শব্দটি অতি ব্যবহারে ক্লিশে হয়ে পড়ে। কিন্তু এটা বলতে বাধা নেই যে রামোসের বেলায় এই ‘কিংবদন্তি’ শব্দের কোনো অপপ্রয়োগ নেই। রিয়াল মাদ্রিদে রামোসের গত ১৬ বছরের অবদান আসলে এই ‘কিংবদন্তি’ শব্দটি দিয়ে পুরোপুরি বোঝানো সম্ভব নয়। রিয়ালের জন্য রামোস একজন কিংবদন্তির চেয়েও অনেক বেশি।

এমন একজন খেলোয়াড়কেই রিয়াল ছেড়ে দিল! পেশাদার জগৎ কী নির্মম, নিষ্ঠুর! ২০০৫ সালে সেভিয়া থেকে তিনি এসেছিলেন ইউরোপের অন্যতম সেরা এই ক্লাবে। ১৬ বছর ধরে তিনি প্রায় সবকিছুই জিতিয়েছেন রিয়ালকে। এর মধ্যে আছে টানা তিন মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা। তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আধুনিক যুগে রিয়ালের অন্যতম সেরা এই তারকা যেকোনো বিচারেই থেকে যাবেন ইতিহাসের অংশ হয়ে।

রামোস যে খুব ঠান্ডা মাথার খেলোয়াড় ছিলেন সেটি বলা যাবে না। দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে অনন্য ক্রীড়াশৈলী তাঁকে তুলে দিয়েছে অন্য উচ্চতায়। যে উচ্চতায় ওঠার স্বপ্নটা থাকে অনেকেরই। কিন্তু সেটি সম্ভব হয় না সবার পক্ষে।

টানা তিনবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতিয়েছেন রিয়ালকে
ছবি: এএফপি

তাঁর বিদায় নিয়ে অনেক কথাই আছে। গত দুই মৌসুমজুড়ে ক্লাব সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের সঙ্গে যে তাঁর একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল, সেটি অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তবে এটা ঠিক, এতে রিয়াল-ইতিহাসে রামোস অধ্যায়ের কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি ঘটেনি। যদিও চোটগ্রস্ত হয়ে শেষ মৌসুমের বেশির ভাগ কাল মাঠের বাইরে কাটান রামোস। রিয়াল থেকে নীরবে-নিভৃতে রামোসের বিদায় তাঁর অর্জনের সঙ্গে ঠিক যায় না। তাঁর বিদায়টা আরও ভালোভাবে হতে পারত কিংবা রিয়াল তাঁকে ধরেও রাখতে পারত।

রিয়ালে এই ১৬ বছরে রামোস প্রতিনিয়ত নিজেকে ভেঙেছেন-গড়েছেন। ২০০৫ সালে সেভিয়া থেকে মাদ্রিদে আসার পর তিনি রিয়ালের হয়ে খেলেছেন ৬৭১টি ম্যাচ। রক্ষণের তারকা হয়েও তাঁর গোলের সংখ্যা অবাক করে দেবে যে কাউকেই—১০১টি গোল! চারটা চ্যাম্পিয়নস লিগসহ জিতেছেন ২২ শিরোপা।

গত বছর লা লিগা ট্রফিতে চুমু খাচ্ছেন রিয়াল অধিনায়ক সের্হিও রামোস। অবশেষে রিয়াল ছাড়ছেন তিনি।
ছবি: রয়টার্স

রিয়ালের তারকাদের মধ্যে একমাত্র পাকো জেন্টো (২৩) তাঁর চেয়ে বেশি শিরোপা জিতেছেন। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে জেন্টোর জেতা ওই শিরোপাগুলোর চেয়ে রামোসের ২২ শিরোপা এগিয়ে থাকবে যোজন ব্যবধানে। রামোসের সাফল্যগুলোর সব কটিই আধুনিক ফুটবলের তীব্র প্রতিযোগিতাময় যুগের।

১৯৯২ সালে ইউরোপিয়ান কাপ যখন চ্যাম্পিয়নস লিগে রূপান্তরিত হলো, তখন থেকে কোনো ক্লাবেরই টানা দুই মৌসুমই শিরোপা জেতার রেকর্ড নেই। অথচ রিয়াল এটি জিতেছে টানা তিনবার। বলা বাহুল্য, সবগুলোই রামোসের অধিনায়কত্বে। এমন রেকর্ড যে খেলোয়াড়ের অধীনে রিয়াল গড়েছে তাঁকেই ছেড়ে দেওয়া হলো কেবল ক্লাবের নীতির সঙ্গে মিল না পড়ায়। ওই যে আগেই বলা হয়েছে পেশাদার দুনিয়া বড় নির্মম!

২০১৪ চ্যাম্পিয়নস লিগের প্রসঙ্গে তো কেবলই রামোসের চেহারাই ভেসে ওঠে রিয়াল-সমর্থকদের মনে! কেবল রিয়াল সমর্থক নয়, ফুটবলপ্রেমীদের কাছেও ২০১৪ চ্যাম্পিয়নস লিগ আর রামোস মিলেমিশে হয়ে গেছেন একাকার। আতলেতিকো মাদ্রিদ আর রিয়াল মাদ্রিদের ফাইনালে ম্যাচের ৯৩ মিনিট পর্যন্ত ১-০ গোলে এগিয়ে ছিল আতলেতিকো। কিন্তু দৃঢ় প্রত্যয়ী রামোস মাদ্রিদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের জিততে দেবেন কেন! ৯৩ মিনিটে হেডে গোল করে রিয়ালকে সমতায় ফেরালেন তিনি। খেলাটা গড়াল অতিরিক্ত সময়ে। ভাগ্য সব সময় সাহসীদের পক্ষে থাকে—এ আপ্তবাক্যের কী চমৎকার এক উদাহরণ হয়ে আছে ২০১৪ চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল। যে ‘লা দেসিমা’ বা (দশম) জয়ের জন্য রিয়াল মাদ্রিদ অপেক্ষায় ছিল, রামোসের কারণে ২০১৪ সালে সেটিই সম্ভব হয়েছিল।

রামোসের বেলায় পরিসংখ্যান জিনিসটাকেই কেমন যেন ‘বোকা বোকা’ মনে হয়। রামোসের শ্রেষ্ঠত্ব কি কয়েকটি সংখ্যা দিয়ে বোঝানো সম্ভব! নাকি উচিত। এ সংখ্যাগুলো দিয়ে কেবল গত ১৬ বছরে রিয়ালে রামোসের গুরুত্বটা বোঝানো যায়। কিন্তু গল্পের পুরোটা এই কটি সংখ্যা দিয়ে আসলেই বোঝানো সম্ভব নয়।

রামোস যখন রিয়ালে গিয়েছিলেন।
ছবি: টুইটার

আতলেতিকোকে ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগ-গৌরব গায়ে মাখতে না দেওয়া, রিয়ালকে সামনে থেকে নেতৃত্ব, রক্ষণে তাঁর দৃঢ়তাপূর্ণ উপস্থিতি, বার্সেলোনা আর লিওনেল মেসির সঙ্গে নিরন্তর টক্কর, রিয়াল-বার্সা ‘এল ক্লাসিকো’ দ্বৈরথের অবিচ্ছদ্য অঙ্গ হয়ে ওঠা, সমর্থকদের ভালোবাসা, সর্বোপরি রিয়াল মাদ্রিদের ‘মুখ’ হয়ে ওঠা তাঁর শ্রেষ্ঠত্বেরই কয়েকটা দিক। তবে সবটা নয়।

রামোসকে নিয়ে দারুণ কয়েকটা কথা আছে রিয়ালে ফেরা কোচ কার্লো আনচেলত্তির, ‘রামোসের ব্যক্তিত্বটাই একজন নেতার।’ তাঁর একটি বইয়ে রামোসের নেতৃত্বগুণ নিয়ে লিখেছেন। তাঁর কথা, ‘রামোস এমন একজন নেতা, যে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবে। কখনো ভেঙে পড়বে না, কখনো ভয়ে কুঁকড়ে যাবে না। এমনকি সাফল্যহীনতার ইঙ্গিতে দুশ্চিন্তাও করবে না।’

রিয়ালের কিংবদন্তি রামোস।
ছবি: টুইটার

রিয়ালের জার্সি গায়ে তাঁর উদ্দাম-উন্মত্ত ডিফেন্ডিংগুলোও মনে পড়বে সমর্থকদের। নিন্দুকেরা তাঁর ক্যারিয়ারের ২৬টি লাল কার্ডের প্রসঙ্গ নিয়ে আসবে অবশ্যই। আনাই স্বাভাবিক। কিন্তু এটাও তো ঠিক যে এই ২৬টি লাল কার্ড তাঁর লড়াকু মানসিকতাকেও সামনে নিয়ে আসে। ওই যে আনচেলত্তি বলেছেন, তিনি ভাঙবেন না, ভয়ে কুঁকড়ে যাবেন না—২৬টি লাল কার্ডকে রিয়াল সমর্থকেরা দেখতে পারেন সেভাবেই। রিয়ালের সমর্থকদের খুব কষ্ট হবে। একটা প্রজন্মের সমর্থকেরাই তো রামোসহীন রিয়াল কল্পনাও করতে পারেন না।

২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে সেল্তা ভিগোর বিপক্ষে রিয়ালের হয়ে প্রথম ম্যাচটা খেলেছিলেন রামোস। সেভিয়া থেকে ২৭ মিলিয়ন ইউরো দিয়ে নিয়ে আসা রামোসকে নিয়ে সমর্থকদের অনেক প্রত্যাশাই ছিল। গত ১৬ বছরে সেই প্রত্যাশা মিটিয়ে সাফল্যক্ষুধাকে তিনি অচিন্তনীয় পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। নতুন উদাহরণ তৈরি করে যে মানদণ্ড তৈরি করেছেন, তার ধারকাছ দিয়ে যাওয়া নতুন কারও পক্ষে ভীষণ, ভীষণ কঠিন। ক্লাবের জন্য ১৫০ শতাংশ বিলিয়ে দেওয়া রামোসের মতো আর একজন কি কখনো রিয়াল খুঁজে পাবে?

মনে তো হয় না!