রামোসের ১০০-র রাতে রিয়ালে ব্রাজিলিয়ান ঝলক

বল জালে জড়িয়ে উদ্‌যাপন রদ্রিগোর, সঙ্গী ভাসকেজ। হতবুদ্ধি ইন্টারের ভিদাল।ছবি: এএফপি

যে দুটি দল গ্রুপের সবচেয়ে শক্তিশালী, দুই ম্যাচ শেষে তারাই কিনা গ্রুপের তলানিতে! চ্যাম্পিয়নস লিগটা এবার রিয়াল মাদ্রিদ আর ইন্টার মিলানের জন্য মোটেও সুখবর নিয়ে আসেনি।

জিনেদিন জিদানের রিয়াল মাদ্রিদ আগের দুই ম্যাচ থেকে পেয়েছে এক পয়েন্ট—এক ম্যাচ হেরেছে, আরেকটি ড্র। আর আন্তোনিও কন্তের ইন্টার মিলান দুই ম্যাচেই করে ড্র! হার তো নয়ই, ড্রও দুই দলের কারও জন্যই ভালো ফল হতো না। ম্যাচে দুই দলেরই জেতার সুযোগ থাকলে জিদান-কন্তে দুজনই নিশ্চিত তাতে রাজি হয়ে যেতেন। কিন্তু তা তো আর হওয়ার নয়, রিয়ালের ‘আপৎকালীন’ হোম ভেন্যু স্তাদিও আলফ্রেদো দি স্তেফানোতে কাল স্মিত হাসিটা রইল জিদানের মুখেই।

দুই গোলে পিছিয়ে পড়া ইন্টার দ্বিতীয়ার্ধে দারুণ প্রত্যাবর্তনের গল্প লেখার আভাস দিয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দারুণ জমে ওঠা ম্যাচটা ৩-২ গোলে জিতেছে রিয়াল। ম্যাচে রিয়াল অধিনায়ক সের্হিও রামোস মাদ্রিদের কুলীন জার্সিতে ১০০ গোলের মাইলফলক ছুঁয়েছেন। তবে রিয়াল ম্যাচটা জিতেছে শেষ পর্যন্ত দুই তরুণ ব্রাজিলিয়ানের ঝলকে। ৮০ মিনিটে ভিনিসিয়ুস জুনিয়রের পাস থেকে রদ্রিগোর গোলটিই শেষ পর্যন্ত হয়ে থেকেছে রিয়ালের জয়সূচক।

জিদানের কপালের ভাঁজ নিশ্চিত বেড়ে গিয়েছিল ম্যাচের আগে। একে তো টুর্নামেন্টের আগের দুই ম্যাচে জয় পায়নি রিয়াল, খেয়েছে পাঁচ গোল; তারওপর কাগজে-কলমে গ্রুপের সবচেয়ে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীর বিপক্ষে নামার আগে জিদানের দুশ্চিন্তা হয়ে এসেছিল রাইটব্যাক জায়গাটা।

মূল দুই রাইটব্যাক দানি কারভাহাল ও আলভারো অদ্রিওসোলা চোটের কারণে নেই, ম্যাচের আগে সংশয়ে ছিল মাঝেমধ্যেই রাইটব্যাকে ‘গেস্ট অ্যাপিয়ারেন্স’ দেখানো লুকাস ভাসকেজ। মজার ব্যাপার, ওদিকে ইন্টারের রাইটব্যাক এই মৌসুমে রিয়ালে নিয়মিত সুযোগ পাবেন না জেনে গত জুলাইয়ে ৪ কোটি ইউরোতে রিয়াল ছেড়ে ইন্টারে যাওয়া আশরাফ হাকিমি!

শেষ পর্যন্ত ভাসকেজ ফিট হয়ে জিদানের দুশ্চিন্তা কমিয়েছেন, শুরু থেকেই খেলেছেন। তাঁর পাশাপাশি রক্ষণের বাঁ প্রান্তে ফারলাঁ মেন্দি, সেন্টারব্যাক জুটিতে রামোসের সঙ্গী রাফায়েল ভারান, মাঝমাঠে ভালভার্দে-কাসেমিরো-ক্রুস, আর আক্রমণে এডেন হ্যাজার্ডের সঙ্গে করিম বেনজেমা ও মার্কো আসেনসিও—৪-৩-৩ ছকে রিয়ালের একাদশটা মোটামুটি অনুমিতই ছিল।

আর ইন্টারে স্ট্রাইকার রোমেলু লুকাকু চোটে থাকায় কন্তের ৩-৫-২ ছকে তাঁর বদলে আক্রমণে লওতারো মার্তিনেজের সঙ্গী হয়ে নামেন ইভান পেরিসিচ। রক্ষণে তিনজন বাস্তোনি, ডি ভ্রাই ও দাম্ব্রোসিও; উইংব্যাক হিসেবে হাকিমির উল্টো পাশে অ্যাশলি ইয়াং। মাঝমাঠে বারেল্লা আর ব্রোজোভিচের সঙ্গে রিয়ালের পরিচিত একটা মুখ—দুই মৌসুম বার্সেলোনায় খেলে এই মৌসুমেই ইন্টারে যাওয়া আর্তুরো ভিদাল।

দাপটটা প্রথমার্ধে রিয়ালেরই ছিল। চোট কাটিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগের আগের ম্যাচেই মৌসুমে প্রথমবার মাঠে নামা হ্যাজার্ড লিগে দুদিন আগে দারুণ আলো ছড়িয়েছিলেন, কিন্তু কাল চ্যাম্পিয়নস লিগে সেভাবে জ্বলে উঠতে পারেননি। তবু তাঁর কাটব্যাক ধরেই রিয়ালকে এগিয়ে দেওয়ার খুব কাছে চলে গিয়েছিলেন আসেনসিও।

এরপর অবশ্য ইন্টারের পাল্টা। বারেল্লার একটা শট ফেরে ক্রসবারে লেখে, মার্তিনেজের শট ঠেকিয়ে দেন রিয়াল গোলকিপার থিবো কোর্তোয়া। পাল্টাপাল্টি জমে ওঠা ম্যাচে রিয়ালকে এরপর এগিয়ে দেওয়ার বড় সুযোগ পেয়েছিলেন ফেদে ভালভার্দে, কিন্তু বেনজেমার হেডে তাঁর হাফ-ভলিটা ঠিকঠাক লাগেনি।

গোলের পর সতীর্থদের সঙ্গে উদ্‌যাপন রামোসের। গোলটা তাঁর জন্য মাইলফলক সূচক হয়েই এসেছে।
ছবি: রয়টার্স

২৫ মিনিটে এরপর রিয়ালকে এগিয়ে দেওয়ার দায়িত্বটা নিজের কাঁধে তুলে নেন বেনজেমা নিজেই। গোলের সূত্র? রিয়াল থেকে যাওয়া হাকিমির ভুল পাস! এগিয়ে আসা ইন্টার গোলকিপার হান্দানোভিচকে কাটিয়ে ঠান্ডা মাথায় বলটা জালে ঠেলে দেন বেনজেমা।

আট মিনিট পর আবার রিয়ালের গোল! এবার রামোসের মাইলফলকের মুহূর্ত। টনি ক্রুসের কর্নারে দারুণ হেডে গোল রিয়াল অধিনায়কের। হেড যে রামোসের কত বড় অস্ত্র, তার প্রমাণ, রিয়ালের জার্সিতে সব টুর্নামেন্ট মিলিয়ে তাঁর এই ১০০ গোলের ৫৫টিই হেডে!

আট মিনিটের মধ্যে দুই গোলে রিয়ালের সহজ জয়ই তখন মনে হচ্ছিল ম্যাচের লিপি, কিন্তু অনুভূতিটা পাল্টে যেতে দুই মিনিটও লাগল না! বারেল্লার চোখধাঁধানো ব্যাকহিলে স্ট্রাইকারসুলভ দক্ষতায় প্রথম স্পর্শেই বল জালে জড়ান মার্তিনেজ। ম্যাচে ইন্টারের পরের গোলটিও এসেছে এই আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকারের হেডে বাড়ানো পাস থেকে। মার্তিনেজ যেন রিয়ালের মাঠে এসে বার্সেলোনাকে বুঝিয়ে দিলেন, তাঁকে পাওয়া বার্সার জন্য জরুরিই ছিল।

ইন্টারের দ্বিতীয় সেই গোলটা এসেছে ৬৮ মিনিটে। ততক্ষণে হ্যাজার্ডকে মাঠ থেকে তুলে নিয়েছেন রিয়াল কোচ জিদান, দ্বিতীয়ার্ধে একটু ছন্দও কেটে গিয়েছিল রিয়ালের। সেটিরই পুরো ফায়দা তুলে নিয়েছে কন্তের ইন্টার। মার্তিনেজের হেড করা পাসটা দৌড়ে গিয়ে ধরে দারুণ শটে গোল করেন পেরিসিচ। ২-০ গোলে পিছিয়ে পড়া থেকে ইন্টার তখন ২-২ সমতায়! এরপর মার্তিনেজের বাঁকানো একটা শট গেল বার উঁচিয়ে, পেরিসিচ মারলেন বাইরে। ইন্টার তখন যেন জয়ের ঘ্রাণ পেয়েছে!

রিয়ালের মূল মাঠ সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে সংস্কার চলছে বলে এখন আলফ্রেদো দি স্তেফানো স্টেডিয়ামে খেলছে তারা, করোনার কারণে দর্শকও নেই, তবে টিভি পর্দার সামনে বসে থাকা রিয়াল–সমর্থকদের অবস্থা তখন অনুমান করাই যায়! আগের দুই ম্যাচে ১ পয়েন্ট পাওয়া রিয়াল এই ম্যাচেও পয়েন্ট হারাবে—শঙ্কাটা তখন এই।

কিন্তু ভিনিসিয়ুস ও রদ্রিগো—দুই তরুণ ব্রাজিলিয়ানের চিন্তাটা ছিল ভিন্ন। ম্যাচে ভাগ্যবদলের আশায় ৬৪ মিনিটে একসঙ্গে দুজনকে মাঠে নামান জিদান হ্যাজার্ড আর আসেনসিওর বদলে। ১৬ মিনিট দুজনের সৌজন্যে এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগে প্রথমবার স্বস্তি রিয়ালে।

বাঁ প্রান্ত থেকে ২০ বছর বয়সী ভিনিসিয়ুসের ক্রস বক্সে রিয়াল ও ইন্টারের কয়েকজন খেলোয়াড়কে এড়িয়ে এল রদ্রিগোর পায়ে। এমনিতেই মাত্র ১৯ বছর বয়সেই ঠান্ডা মাথার জন্য বেশ পরিচিতি পেয়ে গেছেন ব্রাজিলিয়ান এই তরুণ, বক্সে ও এর আশপাশে তাঁর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দারুণ প্রশংসিত। সেটি যে এমনি এমনিই নয়, তা-ই আরেকবার বুঝিয়ে দিলেন রদ্রিগো। তাঁর ডান পায়ের দারুণ শট যখন জালে জড়াচ্ছে, ইন্টার গোলকিপার হান্দানোভিচ অসহায়!

বল জালে জড়িয়ে উচ্ছ্বাস লওতারো মার্তিনেজের। হতাশ রিয়ালের কাসেমিরো।
ছবি: রয়টার্স

মজার ব্যাপার কি, গ্রুপের পয়েন্ট তালিকায় এখনো রিয়াল আর ইন্টার শেষ দুটি দল হিসেবেই আছে। তবে রদ্রিগোর ওই গোলে স্বস্তির পারদ চড়েছে রিয়াল। ৪ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপে তৃতীয় জিদানের দল, তবে গ্রুপে দুইয়ে থাকা শাখতারের পয়েন্টও ৪, শীর্ষে থাকা মনশেনগ্লাডবাখের পয়েন্ট ৫। ইন্টার ২ পয়েন্ট নিয়ে তালিকার তলানিতে।

‘খুব গুরুত্বপূর্ণ তিনটি পয়েন্ট ছিল আমাদের জন্য। আমাদের জিততেই হয়, সেটি আমরা করেছি দারুণ দৃঢ়তা দেখিয়ে, খুব ভালো একটা দলের বিপক্ষে অনেক সংগ্রামের পর’—ম্যাচের পর জিদানের তৃপ্তি। আর ইন্টার কোচ কন্তের বিশ্লেষণ, ‘রিয়ালে অনেক অভিজ্ঞ খেলোয়াড় আছে। ওরা জানে একটা ম্যাচ কীভাবে শেষ করে আসতে হয়। আমাদের সেদিকেও একটু ঘাটতি আছে।’