‘রিয়াল মাদ্রিদ হাসপাতালে’র খবর জেনে নেওয়া যাক
আলফ্রেডো ডি স্তেফানোর আশপাশের উত্তাপ এখনো হয়তো কমেনি। কাল নিজেদের স্টেডিয়ামে সেভিয়ার বিপক্ষে মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে খেলতে নেমেছিল রিয়াল মাদ্রিদ। সে ম্যাচে সেভিয়ার পাওয়া পেনাল্টিতে উত্তাপ ছড়িয়েছে অনেক। জিনেদিন জিদানের মতো ঠান্ডা মাথার লোকও রেফারির সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কাল জয় পেলেই লিগের শীর্ষস্থান পেয়ে যেত রিয়াল। এমন অবস্থায় প্রতিটি পয়েন্টই গুরুত্বপূর্ণ। মৌসুমের শুরুতে যেসব সিদ্ধান্ত হালকা বিতর্কের জন্ম দিত, সেগুলোই এখন তীব্র প্রতিবাদের মুখে পড়ছে।
জিদান অবশ্য এর মধ্যেই জানিয়েছেন, পরের তিন ম্যাচ নিয়েই ভাবছেন। আতলেতিকো মাদ্রিদের চেয়ে ২ পয়েন্ট পিছিয়ে থাকলেও আশা ছাড়ছেন না। লিগ শিরোপা জেতার পথে তাঁর আর তিনটি ‘ফাইনাল’ বাকি। এর প্রথমটি গ্রানাদার মাঠে। কদিন আগেই বার্সেলোনাকে হারিয়ে দেওয়া দলের মুখোমুখি হতে হবে রিয়ালকে ১৩ মে। সে ম্যাচের আগেই জিদান পেয়েছেন দুঃসংবাদ। নতুন করে নাকি চোটে পড়েছেন রাইটব্যাক আলভারো ওদ্রিওসোলা। যদিও ক্লাবের পক্ষ থেকে এখনো কিছু বলা হয়নি।
সেক্ষেত্রে এ নিয়ে মৌসুমে রিয়ালের চোটের সংখ্যা দাঁড়াল ৬২! রিয়ালের মেডিকেল রুম এ মৌসুমে বাস্তবেই হাসপাতালে রূপ নিয়েছে।
ওদ্রিওসোলার চোটে মূল স্কোয়াডে জিদানের হাতে মাত্র তিন ডিফেন্ডার বাকি থাকল। এ মৌসুমে এমন অবস্থায় জিদান এই প্রথম পড়েননি। এর আগেও পছন্দের চার ডিফেন্ডারই চোটে পড়ায় একাডেমি দল বা কাস্তিয়া থেকে ভিক্তর চুস্তকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। লেফটব্যাক হিসেবে মিগুয়েল গুতিরেজকে খেলিয়েছেন। রাইটব্যাক হিসেবে মার্ভিন পার্ককেও দেখা গেছে। গ্রানাদার বিপক্ষে জিদানের হাতে মূল স্কোয়াডের তিন ডিফেন্ডার হিসেবে আছেন দুই সেন্টারব্যাক নাচো ও মিলিতাও। সে সঙ্গে লেফটব্যাক মার্সেলো।
এ মৌসুমে রিয়ালের রক্ষণভাগে নিজের পছন্দের চারজনকে প্রায় পুরোটা সময় একসঙ্গে পাননি জিদান। সবার আগে ছিটকে পড়েছেন দানি কারভাহাল। এর পর অধিনায়ক সের্হিও রামোস ছিটকে পড়েছেন। রাফায়েল ভারান ও ফারলাঁ মেন্দিও মাঝেমধ্যেই চোটের ‘ছুটি’ নিয়েছেন। কারভাহালের চোটের সময় সুযোগ পেতে পারতেন ওদ্রিওসোলা। কিন্তু সাবেক সোসিয়েদাদ খেলোয়াড়ও একই সময়ে চোটে পড়ায় মৌসুমের বড় একটা সময় রাইট উইঙ্গার লুকাস ভাসকেজ ডিফেন্ডার বনে গিয়েছিলেন। জিদানের এমনই ভাগ্য ভাসকেজও চোটে পড়ে পুরো মৌসুমের জন্য ছিটকে গেছেন।
শুধু রক্ষণ কেন, মধ্যমাঠ ও আক্রমণভাগের খেলোয়াড়েরা যখন-তখন শুশ্রূষা নিতে ছুটেছেন। সে সঙ্গে করোনা তো আছেই। করোনা ও চোট মিলিয়ে রিয়াল মূল স্কোয়াডের ২২ খেলোয়াড় মোট ৬৭ বার বিভিন্ন মেয়াদের জন্য মাঠ থেকে ছিটকে গেছেন।
সংখ্যাটি কত অবিশ্বাস্য, সেটা বোঝা যায় লিগে রিয়ালের গোল সংখ্যা দেখে। ৩৫ ম্যাচে রিয়ালের গোল ৬০টি। অর্থাৎ লিগে ম্যাচপ্রতি গোলের চেয়ে রিয়ালের চোটসংখ্যা বেশি!
মাঠে সব সময় দলকে অনুপ্রাণিত করেন, সত্যিকারের নেতার মতো দলকে আগলে রাখেন রামোস। এ মৌসুমে সেটা করতে পারেননি। বারবার চোটে পড়েছেন, করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। সব মিলিয়ে ৭টি ভিন্ন ঘটনায় রামোসকে মাঠের বাইরে থাকতে হয়েছে। মৌসুমের শেষ পর্যন্ত মাঠে আর নামার সুযোগ পাবেন না বলেই জানানো হচ্ছে। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে এই মৌসুমের চুক্তি শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে তাঁকে আর কখনো রিয়াল মাদ্রিদের জার্সিতে দেখা না যাওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
হ্যাজার্ডকে অবশ্য গ্রানাদার বিপক্ষেই মাঠে দেখার কথা। যদিও এই উইঙ্গারের চোটের সঙ্গে যেমন সখ্য, তাতে এর আগেই যে আবার চোটে পড়বেন না, সে নিশ্চয়তা কেউ দিতে রাজি নন। এ মৌসুমে এর মধ্যে ছয়বার চোটে পড়েছেন হ্যাজার্ড। তাঁর মতোই কদিন পর পর চিকিৎসকের সেবা নিয়ে ফেরার অভ্যাস দেখা যাচ্ছে কারভাহালের মধ্যেও। কয়েক মৌসুম ধরেই চোটাঘাতে সময় কাটানো কারভাহাল এ মৌসুমে পাঁচবার চোট পেয়েছেন। এখনো মাঠের বাইরেই আছেন।
ওদিকে মৌসুমের অর্ধেক কাটিয়েই ধারে ফ্রাঙ্কফুর্টে চলে গেছেন লুকা ইয়োভিচ। মৌসুমের প্রথমার্ধে দলের খেলায় খুব একটা অবদান রাখেননি। অনেকের অভিযোগ, করিম বেনজেমার জন্য এই তরুণকে সুযোগ দিচ্ছেন না জিদান। অথচ মৌসুমের প্রথম পাঁচ মাসেই পাঁচবার চোট পেয়েছেন ইয়োভিচ। অর্থাৎ চাইলেও তাঁকে সুযোগ দেওয়া সম্ভব ছিল না জিদানের পক্ষে। ইয়োভিচের মতোই মাঝপথে ধারে ক্লাব বদলানো মার্টিন ওডেগার্ডও স্বল্প সময়ে তিনবার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছেন।
আক্রমণে সুযোগ না পাওয়ার দাবি করতে পারেন মারিয়ানো। এই স্ট্রাইকারকে পারতপক্ষে নামাতে চান না জিদান। তা-ও যখন সুযোগ এসেছিল বেনজেমার চোটের কারণে, সে সময় নিজেই চোটে পড়েছিলেন। সব মিলিয়ে মৌসুমে চারবার চোটে পড়েছেন মারিয়ানো। মিডফিল্ডার ফেদে ভালভার্দেও চোটে পড়েছেন চারবার। ওদ্রিওসোলাও কাল চতুর্থবারের মতো চোটে পড়লেন। তিনবার করে চোটে পড়েছেন ভাসকেজ, মিলিতাও ও মার্সেলো।
মৌসুমের মাঝপথে দুজন খেলোয়াড় অন্য দলে চলে গেছেন। সেটা হিসাবে নিলে মূল স্কোয়াডে ২০ জন খেলোয়াড় পেয়েছেন জিদান, আর ওডেগার্ড ও ইয়োভিচের অর্ধেক সময় যোগ করে আর একজন খেলোয়াড় যদি ধরে নেওয়া হয়, তবে সেটা ২১ জন। এই ২১ জন খেলোয়াড় সব মিলিয়ে ১৪০০ দিন মাঠের বাইরে ছিলেন বা থাকা নিশ্চিত। সেটাও ওদ্রিওসোলার নতুন করে চোট পাওয়ার আগের খবর। এর মানে প্রত্যেক খেলোয়াড়কে গড়ে ৬৭ দিন হাতে পাননি জিদান।
অবশ্য এসব ক্ষেত্রে গড় হিসাবটা একটা বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে। যেমন ভিনিসিয়ুস জুনিয়রকে মাত্র তিন দিন পাননি। থিবো কোর্তোয়া প্রত্যেক ম্যাচেই ছিলেন। লুকা মদরিচ চোটের কারণে মাত্র ৯ দিন জিদানের ডাকে সাড়া দিতে পারেননি। এর উল্টো দিকেই আছেন কারভাহাল। এবারের মৌসুম এমনিতেই ৯ মাসের কম দৈর্ঘ্যের, এর মধ্যেই ১৯১ দিন অনুপস্থিত কারভাহাল! হ্যাজার্ডকে জিদান পাননি ১৭২ দিন। রামোস মাঠে ছিলেন না বা থাকবেন না ১৬০ দিনের জন্য। পছন্দের লুকাস ভাসকেজকে জিদান পাননি ১১০ দিন। আর গতকালকের আগে ওদ্রিওসোলা ১০৪ দিন অনুপস্থিত ছিলেন। এবার কত দিনের জন্য ছিটকে যাচ্ছেন, এখনো নিশ্চিত জানা যায়নি।
এমন চোটাক্রান্ত এক স্কোয়াড নিয়ে কখনোই পছন্দের স্কোয়াড সাজাতে পারেননি জিদান। ২০১৯-২০ প্রাক্ মৌসুমেই নিজের পছন্দের একাদশ সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন জিদান। সে একাদশে থাকার কথা ছিল কোর্তোয়া, কারভাহাল, রামোস, ভারান, মেন্দি, টনি ক্রুস, মদরিচ, কাসেমিরো, হ্যাজার্ড, বেনজেমা ও মার্কো আসেনসিওর। এই মৌসুমে এই একাদশ নিয়ে নামার সুযোগই পাননি জিদান। শুরুতে হ্যাজার্ড ছিলেন না। হ্যাজার্ড ফিরতে ফিরতেই চোটে পড়েছেন কারভাহাল, এর মধ্যেই রামোস চোটে পড়েছেন। আসেনসিও, ভারান এমনকি বেনজেমাও বাদ যাননি।
এ মৌসুমে এখন পর্যন্ত ৭৯টি ম্যাচ খেলেছে রিয়াল। এর মধ্যে প্রতিটি ম্যাচের জন্য জিদান হাতে পেয়েছেন শুধু গোলকিপার কোর্তোয়াকে। ভিনিসিয়ুস জুনিয়র এক ম্যাচে অনুপস্থিত ছিলেন, আসেনসিও অনুপস্থিত ছিলেন দুই ম্যাচে। বর্ষীয়ান লুকা মদরিচকে ৪৬ ম্যাচে হাতে পেয়েছেন জিদান। আর অধিকাংশ ম্যাচেই বেঞ্চে থাকা ইসকো মাঠে নামার জন্য প্রস্তুত ছিলেন ৪৫ ম্যাচে। ওদিকে দানি কারভাহালের মতো গুরুত্বপূর্ণ এক খেলোয়াড় ৩৩ ম্যাচেই (মৌসুম শেষে আরও ৩ ম্যাচ বাড়বে) অনুপস্থিত ছিলেন।
নিজের পছন্দের একাদশের কাকে কাকে জিদান কদিন পেয়েছিলেন দেখে নেওয়া যাক—
এভাবে চোটের পর চোট জিদানের হাতে খেলোয়াড়সংখ্যা থাকা সুযোগ কমিয়ে দিয়েছে। এরই প্রভাব গত কয়েক ম্যাচে দেখা যাচ্ছে। মূল খেলোয়াড়েরা দলকে টানতে টানতে যে ক্লান্ত, সেটা খেলাতেই বোঝা যাচ্ছে। কোর্তোয়া গোলকিপার। তাই তাঁর ৪ হাজার ৩২০ মিনিট মাঠে থাকা অবিশ্বাস্য কিছু নয়। কিন্তু ৩৩ বছর বয়সেও করিম বেনজেমা ৩ হাজার ৬২৭ মিনিট মাঠে ছিলেন এবার। ৩৬ বছরের লুকা মদরিচ ৩ হাজার ৪৫১ মিনিট খেলেছেন। ৩২ ছুঁতে যাওয়া ক্রুস ৩ হাজার ১৯৩ মিনিট মাঠে ছিলেন।
সবচেয়ে ব্যস্ত থাকা অন্য খেলোয়াড়দের মধ্যে আছেন ২৯ বছর বয়সী কাসেমিরো ও ২৮ বছরের ভারান। এদের মধ্যে কাসেমিরো আউটফিল্ডের খেলোয়াড়দের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় মাঠে ছিলেন, ৩ হাজার ৬৯২ মিনিট। ম্যাচের প্রতি মুহূর্তে ব্যস্ত থাকা এক মিডফিল্ডারের জন্য সংখ্যাটি অবিশ্বাস্য। সে তুলনায় ভারান একটু কম ব্যস্ত ছিলেন, ৩ হাজার ৪৮১ মিনিট। ওদিকে মারিয়ানো, ওদ্রিওসোলা ও হ্যাজার্ড মাঠে ছিলেন যথাক্রমে ৬৪৫, ৭৫৬ ও ৮৫৫ মিনিট। ৪৫ ম্যাচই জিদানের হাতের কাছে থাকার পরও ইস্কো খেলেছেন ১ হাজার ৩০ মিনিট!